ইডি-সিবিআই অস্ত্রেই কাবু বিরোধীরা! বিজেপিকে ঠেকানোর যে পথ এখনও খোলা আছে

BJP Vs INDIA Block : অন্যদলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা যখন বিজেপিতে যোগ দেন তখন তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের আর তদন্ত হয় না কেন?

নিন্দুকেরা বলে থাকেন, সিবিআই আর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট নাকি শাসকদলের পোষা তোতা আর ময়না। যা শেখানো হয়, সেইরকমভাবেই কথা বলে। যখন যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকে, তাদের নাস্তানাবুদ করতে এই দুই অস্ত্রকে বিভিন্ন সময় শাসকদল ব্যবহার করে এসেছে বা আসে। এসব আমরা দেখে অভ্যস্ত কিন্তু যেভাবে কেন্দ্রের বর্তমান শাসকরা এই দুই অস্ত্রকে ব্যবহার করছেন, তা দেখে হয়তো নিন্দুকেরাও লজ্জায় মুখ ঢাকবেন। গত কয়েকদিন ধরে ঝাড়খণ্ডে যা চলছে, তা দেখে মনে হচ্ছে ইডি এবং সিবিআই এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে চলেছে! এবার আর তারা শুধু পোষা তোতা হয়েই থাকছেন না। এবার একেবারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঘ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছেন। ইডি এবং সিবিআইয়ের নজরে যে নেতা মন্ত্রীরা আছেন, তাঁরা সবাই বিজেপি বিরোধী। বারংবার এই সংস্থাদের বিরুদ্ধে যে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না।

বলা হচ্ছে, মূলত শাসকদলের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই এই সংস্থাদের প্রধানদের ব্যবহার করা হয়। যে বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে তাও বলা যায় না। তবে, বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও যে ধোয়া তুলসীপাতা তাও না। সেসব দুর্নীতি ধরার জন্য, ইডি সিবিআই পাঠানো শুধুই লোকদেখানো ছাড়া কিছু নয়। নাহলে ২০১৪ সাল থেকে ইডি সিবিআই যত তদন্ত করেছে তার ৯৫ শতাংশই বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হয়েছে কেন?

আরও পড়ুন- রাহুল গান্ধির সঙ্গে দু’ দশ মিনিট

সেসব বিতর্ক আপাতত সরিয়ে মনোনিবেশ করা যাক ঝাড়খণ্ডের দিকে। গত ৩১ জানুয়ারি রাতে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন পদত্যাগ করে, তাঁর বদলে তাঁদের দলেরই বিধায়ক চম্পাই সোরেনকে দায়িত্ব দেন। অথচ পদত্যাগের প্রায় এক দিন কেটে যাওয়ার পরে যখন বিধায়কদের ডাকা হয়, আশঙ্কা জেগে ওঠে আবার মহারাষ্ট্রের মতো ঘোড়া কেনা বেচা হবে না তো? যে বিজেপি সারাক্ষণ পরিবারতন্ত্র নিয়ে অভিযোগ করে তাদের উপযুক্ত জবাব হেমন্ত
সোরেন দিয়ে দেন। এক ভিডিও বার্তায় হেমন্ত বলেন, তিনি লড়াকু শিবু সোরেনের পুত্র। তাঁর রক্তে লড়াই আছে। অত সহজে মাথা নিচু করানো যাবে না তাঁর। তিনি আরও বুঝিয়ে দেন যে তিনি সুবিধাবাদী নীতিশকুমার নন। তাঁকে গ্রেফতার করলে তার প্রভাব যে আগামী নির্বাচনে পড়বে, তা বুঝতে পেরেই শেষমেশ রাজ্যপাল চম্পাই সোরেনকে সরকার গড়তে ডাক দিয়েছেন, এটাই সর্বশেষ খবর।

শুধু ঝাড়খণ্ডের দিকে তাকালে আজকের বিজেপির কার্যকলাপ বোঝা যাবে না। একদিকে বিজেপির দাবি রাম মন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে তাতেই আগামী লোকসভা নির্বাচনে চারশোর অধিক আসন পেয়ে যাবে বিজেপি। যদি এই সত্যি হিসেবে ধরতে হয়, তাহলে বিহারে নীতিশকুমারকে এনডিএতে যুক্ত করতে বাধ্য করা হলো কেন? তারপরেও না থেমে, চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনে বিরোধী দলের ব্যালট পেপার বাতিল করে নিজেদের
প্রার্থীকে জেতাতে হলো কেন?

যেদিন ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়েছিল সেদিন, বিজেপির তরফ থেকে প্রচার করা হয়েছিল যে ইন্ডিয়া জোট সুবিধাবাদী, দুর্নীতিগ্রস্তদের জোট। নীতিশ সেই ইন্ডিয়া ছেড়ে যখন এনডিএ জোটে যোগ দিচ্ছেন, তখন এই সুবিধাবাদের দিক পাল্টে যাচ্ছে। বিজেপি কোনওভাবেই দেখাতে চাইছে না যে ইন্ডিয়া জোট শক্তিশালী। তাই সেটাকে ভাঙার সবরকম চেষ্টা চলছেী। কখনও বিরোধী দলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে নিজেদের ধোলাই মেশিনে ঢুকিয়ে শুদ্ধ করে দল বদলিয়ে নেওয়া, কখনও তাদের জেলে পুরে, কখনও ব্যালট পেপার বাতিল করে আবার কখনও ইভিএম কিংবা ভিভিপ্যাটে কারচুপি করে। বিজেপি জানে, নির্বাচনে হেরে গেলে তাঁদের করা দুর্নীতিই যে সবচেয়ে বড়, তা প্রমাণিত হবে। নির্বাচনী বন্ড, রাফাল বা আদানির সঙ্গে তাদের দলের একদম প্রথম সারির নেতার সখ্যতা থেকে আদানির কী কী সুবিধা হয়েছে, তার তদন্ত হবেউ। তাই যেনতেন প্রকারে ২০২৪ সালের নির্বাচন জিততেই হবে বিজেপিকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিজেপি কি আদৌ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে চায়? না কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে বিরোধী স্বরকে দমন করাই তাদের লক্ষ্য? কেন গণমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে বিজেপি প্রচার করতে চায় যে, বিজেপি বাদে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতারাই দুর্নীতিগ্রস্ত, সুবিধাবাদী? আরও একটা বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে। যদি দুর্নীতি দমনই বিজেপি এবং ইডি-সিবিআইয়ের লক্ষ্য হতো, তাহলে অন্যদলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা যখন বিজেপিতে যোগ দেন তখন তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের আর তদন্ত হয় না কেন? কেন শুভেন্দু অধিকারীর প্রকাশ্যে টাকা নেওয়ার ভিডিও থাকা সত্ত্বেও সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যম থেকে কেন সরিয়ে নেওয়া হয়? কেন অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজওয়াল বা হেমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির নথি, ইডি আর
খুঁজেী পায় না? বিরোধী স্বরকে দমানো উদ্দেশ্য না হলে সচেতনভাবে ভুয়ো মামলা সাজিয়ে, প্রাক্তন আমলা হর্ষ মান্দারের বাড়িতে তল্লাশি হবে কেন? ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যার সময় থেকে এই দাঙ্গার বিরোধিতা করে আসছেন হর্ষ মান্দার, তিস্তা শীতলাবাদেরা। তার জন্য তিস্তাকে জেলেও যেতে হয়েছে। এবার বিজেপির লক্ষ্য হর্ষ মান্দার।

আরও পড়ুন- ২০২৪-এ ফিরে এল ২০১৯! কেন মমতারা বারবারই ‘বেলতলায়’ যান?

তবে বিজেপি একটা কথা ভুলে যাচ্ছে। সবাই হেমন্ত বিশ্বশর্মা কিংবা নীতিশ কুমার নন। এখনও শিবু সোরেন কিংবা সিপিআইএমএলের লড়াইয়ের ঐতিহ্য বহনকারী মানুষজন আছেন যাঁরা শত হুমকি বা প্ররোচনাতেও বিজেপির কাছে মাথা নোয়াবেন না। আছেন হর্ষ মান্দার কিংবা কান্নান গোপিনাথনের মতো মানুষ, যাঁরা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে ভয় পান না। তাই শত চেষ্টা করেও তাঁদের প্রশ্ন দমিয়ে দেওয়া বিজেপির পক্ষেও দুষ্কর হয়ে ওঠে। বিজেপি যতই
ইডি-সিবিআই দিয়ে বিরোধীদের হেনস্থা করার চেষ্টা করুক না কেন, এই প্রচেষ্টা সফল হবে না।

একদিকে অগ্নিবীর প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দেশের যুবকেরা রাস্তায় নামছেন। অন্যদিকে ইভিএম নিয়ে কৃষকেরা লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর
ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নিচ্ছেন। রাহুল গান্ধি ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার মাধ্যমে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলছেন, সাধারণ মানুষকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছেন। গিগ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, মহিলাদের সমস্যা, বেকারত্বের সমস্যা সামনে তুলে আনছেন। সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই বিজেপিকে আগামী নির্বাচনে পরাজিত করা সম্ভব। যত দ্রুত বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই কথাগুলোকে সামনে নিয়ে আসবে, তত বিজেপির মুখোশ খোলা সম্ভব হবে। ততই ‘মোদি কি গ্যারান্টি’র প্রচারের বেলুন ফুটো হবে।

More Articles