নিছক গোয়েন্দা নয়, সে 'সত্যান্বেষী'! কেন নিজেকে এমনটা বলত শরদিন্দুর ব্যোমকেশ?
Sharadindu Bandopadhyay Byomkesh Bakshi : শেষে তাঁর বুদ্ধির জোরেই খুনি পাকড়াও হল। পরিচয় সামনে এল, বাড়ির সামনে নম্বর প্লেট, ‘ব্যোমকেশ বক্সী, সত্যান্বেষী’।
উত্তর কলকাতার মেসবাড়িতে অন্য নাম নিয়ে থাকছিল সে। হাবভাব বেশ সন্দেহজনকই বলা যায়। সঙ্গী ছিল বাঙালি এক লেখক, নাম অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা ছিল গত শতকের তিরিশের দশক। সেই সময় এরকম অনেক বাঙালি যুবকই উত্তর কলকাতার মেসবাড়ি ছেয়ে থাকত। কারও একটা চাকরি জোটানোর লক্ষ্য, কেউ আবার ভবঘুরে প্রকৃতির, কেউ আবার এই অজিতের মতোই লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দিন গুজরান করছে। হঠাৎই সেই মেসবাড়িতে খুন হল। তারপর শুরু হল একের পর এক কাণ্ড। দেখা গেল, চুপচাপ থাকা রহস্যময় যুবকটিই আসল ‘খেলোয়াড়’। শেষে তাঁর বুদ্ধির জোরেই খুনি পাকড়াও হল। পরিচয় সামনে এল, বাড়ির সামনে নম্বর প্লেট, ‘ব্যোমকেশ বক্সী, সত্যান্বেষী’। অজিত, পুঁটিরাম তো রইলই, বেশ কয়েক বছর পর হাজির হবে সত্যবতীও।
ব্যোমকেশ না ফেলুদা, এ নিয়ে বাঙালির তর্ক চলতেই থাকবে। জয়ন্ত-মানিক, কাকাবাবু, কর্নেলরা মাঝেমধ্যে ফাঁকেতালে এসে পড়ে বটে; কিন্তু এ দ্বন্দ্ব চিরকালীন। যেন বাঙালির গোয়েন্দা সাহিত্য জগতের ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা, ইস্টবেঙ্গল নাকি মোহনবাগান। ব্যোমকেশের সঙ্গে পুলিশের ভালোমতো যোগাযোগ। দরকার পড়লে সে খাকি উর্দিকে ধমক দিতেও প্রস্তুত। চোয়াল শক্ত করে, সিগারেট টানতে টানতে ভাবনায় মশগুল হয়ে যায়। আর একের পর এক দুর্ধর্ষ রহস্য, ভয়ংকর খুনের সমাধান করতে থাকে। সেখানে পরতে পরতে লেগে থাকে বিস্ময়। অনেকেরই মত, বাঙালির ছোটবেলা কাটে ফেলুদায়, আর যৌবনের প্রেম ব্যোমকেশ।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ব্যোমকেশকে প্রথম খাতায় আর কলমে ধরলেন, তখন তিনিও মেসবাসী। তবে প্রথম থেকেই তাঁর বক্তব্য ছিল একটাই। ব্যোমকেশ হল ‘সকলের চেয়ে আলাদা’। সে আর পাঁচজন ‘গোয়েন্দা’র মতো নয়, সে সত্যান্বেষী। সত্যকে খোঁজা তাঁর কাজ। সেই ‘সত্য’ কথাটির মধ্যেই শরদিন্দু অনেক গোপন কথা ঢুকিয়ে রেখেছেন। যা প্রতিটা ব্যোমকেশের আখ্যান পড়তে পড়তে সামনে আসে। প্রস্ফুটিত হয় সেই সত্যের মানে।
অন্যান্য গোয়েন্দারাও যে আলাদা, সেটা প্রমাণ করতে সদা ব্যস্ত তার স্রষ্টারা। ফেলুদাকে যেমন একরকম ‘বাঙালি সুপারম্যান’-এর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। তোপসের বিস্ময় চোখে, তাঁর এই দাদা সব করতে পারে। প্রখর দৃষ্টিশক্তি, অব্যর্থ নিশানা, সঙ্গী পিস্তল, কোথাও যাওয়ার আগে খুঁটিনাটি পড়ে নেওয়া, যোগব্যায়াম, নেপোলিয়নের মতো অল্প ঘুমিয়েই শরীর চাঙ্গা করা – এরকম অজস্র গুণের অধিকারী ফেলুদা। কাকাবাবুও এক কথায় অতিমানব – একটা পা নেই, তবুও বীভৎস সব অ্যাডভেঞ্চারে ‘পা’ বাড়িয়েছেন তিনি। স্বয়ং শার্লক হোমসের চরিত্রেও বিভিন্ন উদ্ভট জিনিস দেখা যায়। নেশা করে, বেহালা বাজায়, বাড়িতে থাকে মড়ার খুলি। অর্থাৎ, সাধারণ নয়, উদ্ভট, অদ্ভুত কিন্তু ক্ষুরধার বুদ্ধি আর তীক্ষ্ণ নজরে ভরা। কমবেশি সমস্ত গোয়েন্দাদেরই এমনই একখান ছবি।
আর ব্যোমকেশ? সে-ও আলাদাই। বাড়িতে কে আসছে, সেটা জুতোর শব্দ শুনে বলে দিতে পারে। কলমের কালির মধ্যে যে মাকড়সার রস মিশে আছে, সেটা বোঝার জন্যও তো সেরকম বুদ্ধির দরকার! পঞ্চেন্দ্রিয় সবসময় সজাগ। কিন্তু একইসঙ্গে সে দারুণভাবে মধ্যবিত্ত। সে সংসারী, বউ-বাচ্চা মিলিয়ে জমজমাট। সেখানে ভালোবাসাও আছে, ঝগড়া-রাগারাগিও। চেহারায় অন্য কোনও বিশেষত্ব নেই, কেবল চোখ দুটো উজ্জ্বল। ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া আমার আপনার মতো আম বাঙালি। কিন্তু সত্যান্বেষী কেন? গোয়েন্দা বলতে এত দ্বিধা কেন শরদিন্দুর?
এর কারণ খুঁজতে গেলে ব্যোমকেশের প্রতিটি কাহিনিই মন দিয়ে পড়তে হবে। ব্যোমকেশের কাহিনি কেবল গোয়েন্দা, রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস নয়। সেখানে জড়িয়ে আছে মনস্তত্ত্ব, জড়িয়ে আছে সেই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এমনকী, দেশভাগ এবং সেই সময়ের দাঙ্গাও দিরে এসেছে শরদিন্দুর ব্যোমকেশের লেখায়। শুধু কি তাই? ব্যোমকেশের গল্পে আরও একটা জিনিস দেখা যায় – সম্পর্ক। সত্যবতীর সঙ্গে পরিচয়ও সেই রহস্য আর সম্পর্কের ভিতের কথা বলে। কিংবা চিত্রচোর, দুর্গরহস্যের মতো গল্পে একেকটা পরিবারের মধ্যে বয়ে চলা চোরাস্রোত। স্রেফ চুরি, ডাকাতি, খুনেই থেমে নেই ব্যোমকেশ। সেই সম্পর্ক আর ঘটনার ভেতরে বয়ে চলা সত্যের স্রোতকে বোঝার চেষ্টাই করে গিয়েছেন শরদিন্দু। কেবল চরিত্রের উত্তরণ নয়, লেখক হিসেবেও নিজের চিন্তাভাবনাকে ঝালাই করে নেওয়া।
মনে করুন ‘রক্তমুখী নীলা’র কাহিনি। যেখানে ব্যোমকেশ জানে, তার সামনে যে বসে আছে, সে-ই অপরাধী। সে-ই নীলাটি চুরি করেছে। কিন্তু কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ বিজ্ঞানে বিশ্বাসী ব্যোমকেশও রক্তমুখী নীলার মিথের ভেতর ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে অপরাধীর মনের ভেতর হাতড়ে চলল পথ, যদি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে সে। এবং শেষমেশ সে সফলও হল! স্রেফ গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে ব্যোমকেশকে আটকে রাখতে চাননি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ঠিক এই জায়গাতেই সে সকলের থেকে আলাদা। এজন্যই সে সত্যান্বেষী; যে কেবল অপরাধ নয়, সমাজের, রাজনীতির, সম্পর্কের সত্যিগুলোকেও খোঁজার চেষ্টা করে।