আরজি কর গণ আন্দোলন | কেন ফায়দা তুলতে পারছে না রাম-বাম?

Mamata Banerjee RG Kar: রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার কাছে বিচার চাইতে গেলে রাজনীতি না করে কি চ্যারিটি করবে জনগণ?

আরজি কর নিয়ে রাজনীতি করবেন না — বারবার এই সাবধান বাণী শোনা যাচ্ছে শাসকদলের নেতা থেকে শুরু করে জন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকেও। কিন্তু বিচার কি আকাশ থেকে পড়বে? মূল ঘটনার বিচার তো আদালত করবে কিন্তু সেই বিচারের জন্য তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহ করবে সরকারের ছায়ায় থাকা সংস্থা। দুর্নীতির তদন্তের বিচারও একই প্রক্রিয়ায় হবে কিন্তু সেই দুর্নীতিকে যাঁরা দেখেও এতদিন না দেখার ভান করলেন, তাঁদের বিচার কোথায় হবে? এমন নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরেও যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তাঁদের বিচার কে করবে? এমন ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে অন্য চারটে খুন-ধর্ষণের ঘটনার তদন্ত কীভাবে শুরু হয়। সেই প্রাতিষ্ঠানিক ঘুণের বিচার কে করবে? আর যে রোজকার দুর্নীতি, সরকারি অব্যবস্থা, শাসক দলের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রাজপথে আছড়ে পড়ছে তার বিচার কে করবে?

রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার কাছে বিচার চাইতে গেলে রাজনীতি না করে কি চ্যারিটি করবে জনগণ? যখন রাজনীতির কারবারিরা এই ব্যবস্থার মাথায় বসে রয়েছে!

তাই এই আন্দোলন থেকে মূলত বিজেপি ও সিপিএম বা বাম দলগুলিকে আলাদা করে রাখার প্রয়াস জারি রয়েছে। অদলীয় আন্দোলনের যে তেজ বেশি এবং তা যে শাসক দলকে অচেনা সিলেবাসে পরীক্ষার সামনে ফেলে দিয়েছে, তা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না শাসক দলের নেতা-নেত্রীরাও। কারণ এমন জন আন্দোলন গত চার দশকে দেখেনি পশ্চিমবঙ্গ। তার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ বাম-রামের বাইরের ছকটি তৃণমূল নেত্রীর কাছে অচেনা। তিনি জানেন না কীভাবে এর মোকাবিলা করা সম্ভব। তাই 'ফাঁসি চাই'-এর দাবিতে মিছিল শেষে তৃণমূল নেত্রীর সভা মঞ্চে বড় বড় করে রাম-বাম-শ্যামের কথা লেখা থাকলেও, 'শ্যাম' তাঁর কাছে নতুন। তিনি বারবার আরজি করের আন্দোলনকে রাম-বামের ছকে ফেলতে চাইছেন। কারণ তাঁর রাজনীতিটাই এই ছকে বাঁধা। শ্যামকে নিয়ে তিনি কখনও ভাবেননি।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিজেপি বা সিপিএমকে এই জন আন্দোলনের বাইরে রাখা বা এই আন্দোলন নিয়ে 'কোনও রাজনীতি চাই না' বলা যেতেই পারে। তাতে 'বিচার চাই' আন্দোলনের ধার বজায় থাকবে। কিন্তু ওই যে বললাম, বিচার তো আকাশ থেকে টুপ করে ঝরে পড়বে না। আন্দোলনের ফায়দা পেতে তাকে রাজনীতির আঙিনায় নিয়ে আসতেই হবে।

আরও পড়ুন- ‘টাকার কথা বলিনি!’ প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ উড়িয়ে কুৎসা-তত্ত্বেই জোর মমতার

এমনভাবেই দেড় দশক আগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের ফায়দা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় তুলেছিলেন। কৃষক ও নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর দল মিশে যেতে পেরেছিল। সে সময় মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের একটি সুবিধা ছিল, যে সুবিধা না তো বিজেপির রয়েছে না রয়েছে বামেদের।

এটা ঠিকই যে জনক্ষোভের ফায়দা তুলতে খুব স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাস্তায়। নিজেরা দলগতভাবে মিছিল, অবস্থান করে চলেছে। তাতে বিশেষ ভরসা না পেয়ে রাত দখলের আন্দোলনের সাড়া দেখে, 'ছাত্রসমাজ'-এর ব্যানারে একটি অদলীয় গণ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশ ও শাসকদলের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ছাত্রসমাজের মুখোশ খুলে রাজনৈতিক মুখটা বেরিয়ে পড়েছে। তারপর আর রাখঢাক না করে দলীয় ব্যানারেই বিজেপি বাংলা বনধ ডেকেছে। সংঘ পরিবারের এই ধরনের অদলীয় আন্দোলন সংগঠিত করার অভিজ্ঞতা থাকলেও, তারা পশ্চিমবঙ্গে এই গণ আন্দোলন তৈরিতে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ।

এখনও পর্যন্ত এই জন আন্দোলনের কারণে তৃণমূল কোণঠাসা হলেও, তার ফায়দা যে বিজেপি তুলতে পারছে তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং প্রাক্তন বিচারপতি ও বর্তমান বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে এক জন আন্দোলন থেকে 'গো ব্যাক' ধ্বনি শুনে ফিরে যেতে হয়েছে।

এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বিজেপি একটি পরীক্ষিত রাজনৈতিক দল। নারী-শিশু সুরক্ষা নিয়ে বিজেপি পরিচালিত সরকারের অবস্থান ও ভূমিকা বহু আলোচিত। উত্তরপ্রদেশ হোক বা গুজরাত বা মণিপুর — বিজেপি পরিচালিত সরকার কীভাবে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনাকে সামলেছে, তা সকলের জানা। এই রাজ্যের শাসক তৃণমূলও সেই সব ঘটনাবলী বারবার করে মনে করিয়ে দিচ্ছে।

সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ইস্যুতে বিজেপি নেতাদের দীর্ঘ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থাকলেও সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে আন্দোলনে তাঁরা অনভিজ্ঞ। একা শুভেন্দু অধিকারীর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই জন আন্দোলনের রাজনৈতিক ফায়দা তোলা একটি কঠিন ব্যাপার।

এছাড়াও একটি বড় অংশের বাঙালিদের মধ্যে বিজেপিকে নিয়ে ভয় এবং ছুৎমার্গ রয়েছে। তারা শাসক বিরোধী আন্দোলন করলেও মনে মনে চাইছে না যে, এর ফলে বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসুক। তারাই বেশি করে 'অরাজনৈতিক অরাজনৈতিক' আন্দোলন করে লাফাচ্ছে।

অন্যদিকে বামেরা কিন্তু আরজি করের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা মিডিয়ার আলোতে নিয়ে আসার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। তাদের যুবনেত্রী মীনাক্ষিই প্রথম আরজি করে দলবল নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। দাবি করেছিলেন যথাযথ ময়নাতদন্তের। কিন্তু তারপর থেকে খানিকটা নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতায়, খানিকটা কৌশলগতভাবেই জন আন্দোলন থেকে দলীয় দূরত্ব বজায় রেখেছেন বাম নেতা-কর্মীরা। যদিও তাঁরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছেন, ঝাণ্ডা হাতেও বিশাল মিছিল করেছেন কিন্তু তাঁরাও যে এই আন্দোলনের নির্বাচনী ফায়দা তুলতে পারবেন এটা এখনও স্পষ্ট নয়।

এরও বড় কারণ, বামেরাও পরীক্ষিত রাজনৈতিক দল। তাদেরকে ৩৪ বছর ধরে দেখেছে এই রাজ্যের মানুষ এবং তাদের প্রতি এতটাই বিতৃষ্ণা জন্মেছে তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি রাজ্যের জনগণ। এমনকী নিজের দলের সমর্থকদের ভরসাও জোগাড় করতে পারেনি বামেরা। বরং নির্বাচনী অঙ্কের আলোয় দেখা যাবে যে, এই সমর্থকেরা বিজেপির দিকেই ঝুঁকে পড়েছে।

আরও পড়ুন- অনুদান ফেরানো নিয়ে স্পষ্ট বার্তা! পুজোর হাওয়ায় মাতিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা মমতার?

আরজি কর সংক্রান্ত আন্দোলনের অনেকটা অংশ জুড়েই কিন্তু বামপন্থী বা বাম-মনস্ক মানুষ রয়েছেন। সেটা তাঁদের রাজনৈতিক পরিচিতি বা পূর্ব-পরিচিতি বা সাধারণভাবে মিছিলের স্লোগান শুনলেই বা পোস্টার দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আসলে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনেও অনেক বিক্ষুব্ধ ও প্রাক্তন বাম নেতাদের মাথা কাজ করেছিল। কারণ তাঁরা এই আন্দোলন সংগঠনের কাজে দক্ষ ছিলেন। তবুও এবারের আন্দোলন বামপন্থীদের আন্দোলন হয়ে উঠছে না।

তবে এ কথা এখনই বলা যাবে না যে, দেড়-দু'বছরের মধ্যে যেখানে বিধানসভা নির্বাচন, তখন কোথাকার জল কোথায় গড়াবে। তিনটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে।

বিজেপির শক্তি মূলত উত্তরবঙ্গে। এই আন্দোলনের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তারা দক্ষিণবঙ্গেও নিজেদের শক্তি বাড়াতে পারে কিনা সেটা দেখতে হবে। অন্যদিকে মনে রাখতে হবে, লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল করলেও, পুর এলাকায় তৃণমূলের ফল কিন্তু আশানুরূপ হয়নি। অর্থাৎ শহরাঞ্চলে তৃণমূল-বিরোধী একটি হাওয়া কাজ করেছে তৃণমূলের সুদিনেও। আরজি কর আন্দোলন সেই হাওয়াতে বেগ আনবে নিশ্চয়ই।

অনেকেই ভাবছেন, এই আন্দোলন মূলত শহরকেন্দ্রিক। গ্রামাঞ্চলের মানুষ আরজি কর নিয়ে ততটা আন্দোলিত নন। আপাত দৃষ্টিতে তা হয়তো ঠিক। মনে রাখতে হবে, ২০০১ বা ২০০৬ সালে যখন বিধানসভায় তৃণমূল '৩০' তখনও কিন্তু সেই আসনগুলির বেশিরভাগই এসেছিল কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চল থেকে। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া শহরাঞ্চল থেকেই উঠতে থাকে। তারপরে গ্রাম জুড়ে যায়। কারণ প্রত্যেকটি স্তরেই কমবেশি ক্ষোভ একরমই। কাউকে পথ দেখাতে হয়। এই মুহূর্তে কিন্তু খাতায় কলমে বিজেপি ৭০-এর উপরে আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল রাজ্য বিধানসভায়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ধরলে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য প্রায় ৬ শতাংশ। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ধরলে এই ভোটের ফারাক প্রায় ৪ শতাংশ কমিয়েছে বিজেপি। বাম ও কংগ্রেসের হাতে এখনও ১০ শতাংশের মতো ভোট রয়েছে।

এই বিক্ষোভে কার ভোট বাক্স থেকে ভোট কমবে বা বাড়বে তা নিয়ে চিন্তায় থাকতে হবে তৃণমূল নেত্রীকে। সুতরাং এখনই বাম বা রাম আরজি কর আন্দোলনের সুফল ঘরে তুলতে না পারলেও, ভবিষ্যতের মাঠ তৈরি হয়ে থাকবে।

More Articles