মুর্শিদাবাদে লাল ঝড় তুলতে পারবেন দলের সেনাপতি সেলিম?
Mohammed Selim Lok Sabha 2024: গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনকে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে কোনও রকম সংকীর্ণতাকে সেলিম নিজের মনে ঠাঁই দেননি।
কমিউনিস্টরা 'প্রথা'-র জগদ্দল পাথরে যদি নিজেদের চাপা দিয়ে রাখে, তবে সমাজ বদলের ভাবনার শরিক তো তারা হতে পারে না। কমিউনিস্টরা প্রথার জঙ্গমতাকে ঠেলে সরিয়ে সব সময়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ করবে, এটাই তাদের দস্তুর। ইতিহাসের দিকে তাকালে সব সময়েই দেখা যাবে, কমিউনিস্টরাই অতীতের স্থবিরতা ভাঙে, আবার সময়ের নিরিখে নতুন দৃষ্টান্ত তারাই তৈরি করে।
২০২৪ সালের আসন্ন লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিমকে প্রার্থী করে বামপন্থী শিবির বুঝিয়ে দিয়েছে, সেনাপতিকে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের ময়দানে রেখে তাঁরা কেবলমাত্র তাঁদের ভূমিস্তরের কর্মী-সমর্থকদেরই মনোবল বৃদ্ধি করতে চান না, এই নির্বাচনী সংগ্রাম যে নিছক কিছু আসন জিতে সংসদে যাওয়ার বিষয় না, এই লড়াই যে আগামী দিনে ভারতের বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামো থাকবে কিনা, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অক্ষুণ্ণ থাকবে কিনা, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো বজায় থাকবে কিনা- এইসব প্রশ্নগুলিকেও সামনে আনতে চান। তাই রাজপথ-মাঠে-ময়দানের লড়াইকে সংসদের কক্ষেও প্রসারিত করবার লক্ষ্যেই একদিকে নবীন প্রজন্মের মানুষদেরও যেমন প্রার্থী করা হচ্ছে, তেমনই সংসদীয় রাজনীতিতে পোড় খাওয়া ব্যক্তিত্ব সেলিমকে তারা প্রার্থী করলেন।
দলের রাজ্য সম্পাদককে প্রার্থী করার মধ্যে দিয়ে সিপিআই(এম) ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বুঝিয়ে দিয়েছিল রাজনীতি কোনও এঁদোপুকুর নয়। রাজনীতি বহতা নদী। তাই স্রোতের টানে গা ভাসালেও হবে না, আবার স্রোত না রাখলে দলে, কর্মী-নেতৃত্ব-সমর্থকদের মধ্যে জঙ্গমতাও আসতে পারে। অতীতে জ্যোতি বসুই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি স্বল্প কিছু সময় একইসঙ্গে দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব এবং সংসদীয় রাজনীতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জ্যোতি বসু তখন ছিলেন বিরোধী দলনেতা। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন সাংগঠনিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা নেতারা ভোট রাজনীতিতে কখনও প্রার্থী হননি। প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন দাশগুপ্ত ,অনিল বিশ্বাস, বিমান বসুরা কেউই দলীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে সংসদীয় রাজনীতিতে আসেননি। দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের অনেক আগে, অধুনা বিলুপ্ত কাটোয়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে সরোজ মুখোপাধ্যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং জিতেছিলেন।
দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে সংসদীয় রাজনীতির আসরে লড়াইয়ের প্রশ্নে মহম্মদ সেলিমকে প্রার্থী করে যে সিদ্ধান্ত সিপিআই(এম) নিয়েছে, সেটি নতুন বিষয় নয়। অতীতে জ্যোতি বসু এবং সূর্যকান্ত মিশ্রের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছিল। এক সময়ে দলের রাজস্থান প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদকও একইসঙ্গে দলে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।
একটা সময় পর্যন্ত অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি বা বিভাগ উত্তরকালে সিপিআই(এম) তাদের সাংগঠনিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তিত্বকে সাংগঠনিক স্তরে কর্মরত রেখেছিল। আর কিছুজনকে কর্মরত রেখেছিল সংসদীয় রাজনীতির স্তরে। তাই বলে যিনি সংসদীয় রাজনীতিতে সেই সময় যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তিনি যে দলের সাংগঠনিক স্তরের কোনও না কোনও ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না, এমনটা মনে করবার কারণ নেই।
আরও পড়ুন- বাংলাকে তথ্য প্রযুক্তির দুয়ারে এনেছিলেন তিনিই! মানব মুখোপাধ্যায়কে কেন ভুলবে না রাজ্য
অতীতের সংসদ কাঁপানো কয়েকজন সিপিআই(এম) নেতা যেমন, জ্যোতির্ময় বসু, ডাক্তার শরদীশ রায়, হারাধন রায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের নাম এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সেলিমের রাজনৈতিক জীবনের একদম শুরুটা ছাত্র রাজনীতি দিয়ে হলেও পরবর্তীকালে যুব আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর যে সম্পৃক্ততা তা তাঁকে আটের দশক থেকেই সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বড় রকমের পরিচিতি এনে দেয়। অনেকেই সিপিআই(এম) দলটির বৃদ্ধতন্ত্র ঘিরে নানা স্ব-উদ্ভাবিত তত্ত্ব খাড়া করেন। কিন্তু এই দলটিই এককালে সদ্য যুবক সেলিমকে রাজ্যসভার সদস্য করে নতুনের জয়গান গেয়েছিল।
পরবর্তীকালে কেবল সেলিমই নন, সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, অলকেশ দাশ- এমন অনেক ব্যক্তিত্বকেই লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভার নির্বাচনে প্রার্থী করে প্রবীণ নেতাদের অভিজ্ঞতা ,আর নবীন প্রজন্মের নেতাদের পরিশ্রম করবার শক্তি এবং রাজনীতির দিক বদলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইনসভার ভেতরে বা বাইরে, রাজপথে লড়াইয়ের প্রশ্নটিকে অসামান্য সমন্বয়ের মধ্যে আনতে পেরেছিল। এমন চেষ্টা কিন্তু কখনই দক্ষিণপন্থী দলগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়নি। দক্ষিণপন্থী দলগুলি বহুক্ষেত্রেই সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মকে জায়গা করে দেওয়ার প্রশ্নে অনেকদিন পর্যন্ত দ্বিধান্বিত ছিল।
জাতীয় স্তরে যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সেলিম তাঁর সংসদীয় রাজনীতিতে দক্ষতা কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা বোঝার জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। রাজ্যসভায় চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে কারা সভা পরিচালনা করবেন তার একটি প্যানেল করা হয়। সেই প্যানেলকে বলা হয় ভাইস চেয়ারম্যান প্যানেল। সেলিমই হলেন তাঁর সময়কালে প্রথম কনিষ্ঠতম রাজ্যসভার সদস্য (তাঁর বয়স তখন ৩৪) যিনি ভাইস চেয়ারম্যান প্যানেলের সদস্য হয়েছিলেন।সেলিমের প্রথম দফায় রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার মাত্র দু'বছরের ভিতরে এই নিয়োগ হয়েছিল। সেই সময়ে সেলিমের রাজ্যসভা পরিচালনা ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক। সেলিমের সেই সময়ে সভা পরিচালনার ভিডিও দেখে এককালের প্রখ্যাত সাংসদ হীরেন মুখোপাধ্যায় সেলিমের মধ্যে মবলঙ্কারের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে সেলিমের এই প্যানেল সদস্য হওয়ার সময় কাল পর্যন্ত তাঁর মতো বয়সে আর কোনও ব্যক্তি ওই প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত হননি। আজও কেউ পারেননি সেই দৃষ্টান্ত ভাঙতে।
দলের রাজ্য সম্পাদক প্রার্থী হওয়ায় ,কোনও কোনও মহল থেকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে যে, সাংগঠনিকভাবে সিপিআই(এম) দলটি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে রাজ্য সম্পাদককে প্রার্থী করা ছাড়া তাদের আর উপায় ছিল না। ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সিপিআই(এম) সাংগঠনিকভাবে যে দুর্বল হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই কিন্তু সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিগত প্রায় দু'বছর ধরে সেলিম দলের হাল ধরবার পর থেকে যে অদল বদল ঘটছে, সেই বিষয়টি আলোচনায় আসছে না।
হ্যাঁ, একথা ঠিক যে সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে সিপিআই(এম)-এর এখন লোকসভা বা বিধানসভায় কোনও প্রতিনিধি নেই। কিন্তু ভোট শতাংশের নিরিখে, বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে, বহু প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে, সিপিআই(এম)-এর যে ভোট বৃদ্ধি তাকে অস্বীকার করা যায় না। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, সিপিআই(এম) নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় বেশ খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করেছিল। বিশেষ করে বিপক্ষ রাজনৈতিক শিবিরগুলি থেকে যে ধরনের আক্রমণ আসছিল, সেইসব আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে যে সংগঠিত প্রয়াস দরকার, তাতে কিছুটা ভাঁটা পড়েছিল। পাশাপাশি বিপদগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে সংগঠিতভাবে নেতৃত্বের দাঁড়ানোর প্রশ্নটিতেও শৈথিল্য দেখা দিয়েছিল। বিগত দু'বছর ধরে প্রায় দিনরাত এক করে যে পরিশ্রম রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর সেলিম করেছেন, তার নিরিখে প্রথমেই বলতে হয়; নানা কারণে তাদের দলের কর্মী সমর্থকদের যে একটা বড় অংশ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁরা আবার পুরোদমে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন।
সেলিম যেভাবে গোটা পশ্চিমবঙ্গ গত দু'বছর ধরে চষে বেরিয়েছেন তার ফলে কেবলমাত্র সিপিআই(এম)-এর কর্মী সমর্থকেরাই নয়, যারা বিজেপি বা তৃণমূলের সমর্থক নন, সেই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের মধ্যে নতুন ধরনের আত্মপ্রত্যয় জেগেছে। সাহস তৈরি হয়েছে।
গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনকে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে কোনও রকম সংকীর্ণতাকে সেলিম নিজের মনে ঠাঁই দেননি। নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও আনেননি। তাই নকশাল রাজনীতি করা মানুষজন, যাঁদের মধ্যে সিপিআই(এম)-কে ঘিরে অনেক সময়, অনেক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে , অপরপক্ষে সিপিআই(এম)-এর কর্মী সমর্থক, তাঁদেরও নকশাল রাজনীতির লোকজন সম্পর্কে বিবিধ চিন্তাভাবনা কাজ করেছে, এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন, বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রয়োজনে, দেশকে বাঁচানোর স্বার্থে, দেশের মানুষকে বাঁচানোর স্বার্থে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা, লড়াইয়ের ময়দানে একত্রিত হওয়ার জায়গা সেলিম তৈরি করতে পেরেছেন। এমনটা কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে কেবল পশ্চিমবঙ্গ কেন, ভারতের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও কখনও ঘটেনি।
জর্জি দিমিত্রভ যে যুক্তফ্রন্টের তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যে তত্ত্বের সার্থক প্রয়োগ প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুরা করেছিলেন বামফ্রন্টের ভেতর দিয়ে, আবার যেন নতুনভাবে সেই তত্ত্বকে একটা ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপিত করলেন সেলিম।
বামপন্থী দলগুলির মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনই কেবল নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর রাজনৈতিক অবস্থানে বিরাজ করা কংগ্রেস, যে দলের সঙ্গে বামপন্থীদের লড়াই স্বাধীনতার আগের থেকে চলছে ,পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ,সেই দলের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার যে ভিত্তি সেলিম নির্মাণ করেছেন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, সেটি ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তি, দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণকে প্রতিহত করবার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ভূমিকা।
কংগ্রেস দলটিকে ঘিরে বামপন্থীদের মধ্যে এখনও বহু নেতিবাচক মানসিকতা আছে। কিন্তু একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস আর আজকের কংগ্রেস দলের মধ্যে যে চিন্তাজনিত ফারাক, বিশেষ করে গোটা ভারত জুড়ে যখন গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোই একেবারে অন্তিম পর্যায়ে চলে এসেছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকদের দ্বারা, এই প্রশ্নটাই যখন প্রবল হয়ে উঠতে শুরু করেছে যে, লোকসভা নির্বাচনে যদি একক গরিষ্ঠতা অর্জন করে বিজেপি, তাহলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ-যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পন্ন সংবিধান আদৌ থাকবে কিনা- এইরকম সময়ে একটিও সাম্প্রদায়িকতা বা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না হয়, তার জন্য সেলিমের যে উদ্যোগ, তা ইতিহাসে স্থান পাবে অবশ্যই। সেলিমের এই উদ্যোগের পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয়, সাম্প্রদায়িকতাকে রোখবার প্রশ্নে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর ইতিবাচক মানসিকতার কথাও।
সেলিমের রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতির একটা নিজস্ব ভঙ্গিমা আছে। বামপন্থীদের রাজনৈতিক ধারার যে বৈশিষ্ট্য, সেটা মানুষের সঙ্গে বড় রকমের নৈকট্য রচনা করেছিল। সেই ধারাটিকেই সেলিম সময়ের উপযোগী করে, নতুন করে প্রয়োগ করেন সব সময়ে।
তেভাগা আন্দোলনের কালে কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা নিত্যানন্দ চৌধুরী পায়ে ঘুঙুর পরে হাটের মধ্যে গিয়ে গান করে করে তেভাগা লড়াইয়ের কথা মানুষদের জানাতেন, সাধারণ মানুষদের কমিউনিস্টদের লড়াইয়ের সঙ্গে একাত্ম করে তুলতেন। নিত্যানন্দ চৌধুরীর মতোই আরও বহু বামপন্থী নেতা, কর্মী, সমর্থক ছিলেন যাঁরা মানুষের নাড়ি বুঝে, তাঁদের মতো করে রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং শাসকের অভিপ্রায় ঘিরে মানুষকে সচেতন করতেন।
সমরেশ বসুর 'যুগ যুগ জীয়ে' উপন্যাসে বিগত শতকের তিনের, চারের দশকে কলকাতা এবং মফসসল কেন্দ্রিক এলাকা, এমনকী ইছামতীর তীরের বসিরহাট সংলগ্ন এলাকাতেও কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের মানুষের মধ্যে মিশে গিয়ে লড়াই করবার বিষয় উঠে এসেছে। সেলিম ঠিক সেই ভাবেই রাজনীতির ধারাকে যুগোপযোগী পর্যায়ে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন।
জনসংযোগের ক্ষেত্রে সেলিমের মধ্যে বিশেষ রকমের এক আটপৌরে ভাব আছে। এই প্রবন্ধ লেখক, তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে সেলিমের সেই আটপৌরেআনার সঙ্গে একমাত্র তুলনা করতে পারেন প্রয়াত কমিউনিস্ট নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ের।
আরও পড়ুন- লেনিনের তত্ত্বে দ্বিমত, স্ট্যালিনের চক্ষুশূল! কমিউনিস্ট আন্দোলনের আশ্চর্য বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়
মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষিত হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যখন শিয়ালদহ স্টেশনে ভাগীরথী এক্সপ্রেস ধরবার জন্য সেলিম এসে পৌঁছলেন, তখনও আমজনতা জানে না সেলিম প্রার্থী হতে চলেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ, পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে; কেউ চাকরিজীবী, কেউ বা ছাত্র, কেউ কৃষিজীবী- তারই মধ্যে রয়েছেন এক বিরোধীদলের জনপ্রতিনিধির বিদূষী স্ত্রীও। প্রত্যেকের সঙ্গে সম-মর্যাদায় সেলিম কথা বলে গেলেন আন্তরিক হাসি দিয়ে, রঙ্গ রসিকতার মধ্যে দিয়ে তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলেন। এমনটা বাংলার সাধারণ মানুষ সাম্প্রতিক অতীতে খুব একটা পাননি। সেলিম যখন মন্ত্রী ছিলেন তখনও কলকাতা শহরের মধ্যে কখনও তিনি পুলিশের পাইলটকার ব্যবহার করতেন না। যখন জেলায় যেতেন, স্থানীয় পুলিশ তাঁদের নিয়ম অনুযায়ী পাইলটকারের ব্যবস্থা করত। সেলিম একবারও পুলিশের কাছে অতিরিক্ত নিরাপত্তার লটবহরের জন্য অনুরোধ করতেন না। মাত্র একজন সরকারি নিরাপত্তা রক্ষী ছিল তাঁর।
রাজ্যসভা, লোকসভা দু'টি মিলিয়ে যে চারবার তিনি সাংসদ হয়েছেন সেই বাইশ বছর, কখনই সরকারি নিরাপত্তা নিয়ে তিনি চলতেন না। দলের রাজ্য সম্পাদক হয়েও তাঁর কোনও সরকারি নিরাপত্তারক্ষী নেই। শিয়ালদহ স্টেশনে এক ভিন্ন রাজনৈতিক পরিসরের দম্পতি অকপটে সেলিমকে বলেন; "আমরা আপনার রাজনীতির ভাবনার সমর্থক না হলেও, আমাদের ছেলে কিন্তু আপনাদের রাজনীতিকে সমর্থন করে"। ওই দম্পতির ছেলে বিদেশে উচ্চপদে কর্মরত। দম্পতিকে সেলিম জানান, তাঁর শ্বশুরকূলও কিন্তু বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক ছিল না। সেই কারণে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হতে ছয় বছর সময় লেগেছে। এই অকপট মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়াই প্রমাণ করে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক ভাবনা ব্যতিরেকে, ব্যক্তি সেলিমের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য এটিই।
তাঁর সেদিনের যাত্রাপথে একটি অতিরিক্ত আসন সংরক্ষণ করা ছিল। অতি সাধারণ এক মানুষ, তাঁর ছেলের সঙ্গে কলকাতা এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। ফিরে যাচ্ছেন নিজের বাড়িতে। মানুষটি প্রৌঢ়, ছেলেটি যুবক। ছেলেটির সঙ্গে আলাপ জমাতে জমাতে সেলিম জানান, তাঁর একটা আসন অতিরিক্ত আছে। তাঁদের কারও রিজার্ভেশন না থাকলে তারা সেলিমের আসনে বসতেই পারেন। মাত্র দশ মিনিটের আলাপে এভাবেই মিশে যেতে শিখিয়ে দেন সেলিম।
আখলাক খুন হওয়ার পর কইরানাতে পৌঁছে যাওয়া থেকে শুরু করে ট্রেনের মধ্যে গণধোলাইয়ের শিকার হওয়া সেই অসহায় যুবকের জন্য দিল্লির হাসপাতালে ছুটে যাওয়া সেলিম, আর রায়গঞ্জে বন্যার কালে নিজে হাতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া সেলিম, সংসদে দাঁড়িয়ে, সারদা-নারদার চোরদের দিকে চোখে চোখ রেখে, আঙুল তুলে 'চোর-চোর' বলা সেলিম একই মানুষ। তাঁর কোনও দ্বৈত সত্ত্বা নেই। তাই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সেলিমের মতো মানুষ মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে লোকসভায় প্রার্থী হয়েছেন, এটা দেখে দলমত নির্বিশেষে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা- লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন, পদ্মার ভাঙ, গঙ্গার ভাঙন থেকে শুরু করে, রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের এই কেন্দ্রটির মানুষদের প্রতিদিন যা কিছুর সঙ্গে লড়াই করতে হয়, সেগুলি যথাযথভাবে সেলিমই পারবেন লোকসভায় তুলে ধরতে।