লাখে লাখে মানুষ কেঁদে মুক্তি পান! কেন বাংলাদেশে বিতর্কের নাম দেলোয়ার হোসেন সাঈদী?

Delwar Hossain Sayeedi Death: যত মানুষ ঢাকায় সাঈদীর জানাজার দাবি করেছেন তার সিকিভাগও তাঁর মুক্তির দাবিতে কোনও দিন জমায়েত হননি।

AP

আমাদের জীবন ও মৃত্যু কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। সেটা আবারও প্রমাণিত হলো বাংলাদেশে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুর পর। ‘সাধারণ’দের মৃত্যুতে রাষ্ট্র ও রাজনীতি হয়তো মৃদু ভূমিকা রাখে; টের পাওয়া যায় কম। 'পাবলিক ফিগার’দের বেলায় সেরকম ছাড় মেলে না। পিরোজপুরের সাউদখালির ‘সাঈদী সাহেব’ নিঃসন্দেহে পাবলিক ফিগার ছিলেন। বাংলাদেশে আদালতে তিনি যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী সাব্যস্ত হন। আদালতের সেই চৌহদ্দির বাইরের দেলোয়ার হোসেন সাঈদী আসলে কে?

রাষ্ট্র, দণ্ড ও লোকসমাজ

সকলেই জানেন, রাষ্ট্র-আইন-আদালত-কারাগার হলো একালের বাস্তব দুনিয়ার সর্বক্ষমতাময় কাঠামো। কিন্তু মহাক্ষমতাধর এসব কাঠামোরও সীমাবদ্ধতা আছে। এগুলো মানুষের শরীরী সত্তার অতিরিক্ত অংশটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কখনও সখনও মুশকিলে পড়ে। জনমানসের লাগাম টেনে রাখা দুরূহই বটে। হয়তো সেই সূত্রে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী আদালতে দণ্ডিত হয়েও বিপুল ভক্ত হারাননি। তাঁকে ঘিরে এখনও সামাজিক বিভিন্ন পরিসরে বিতর্ক, বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কার জারি আছে। প্রশ্ন হলো, সাঈদীর লোকপ্রিয়তার ব্যাখ্যা কী? যাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য আছে তাঁদের কাউকে এ বিষয়ে সামাজিক কারণ জানাতে দেখিনি। তবে এখনও সেরকম আলোচনার সুযোগ আছে।

মিথ, বিজ্ঞান ও সামাজিক ‘ঠাট্টা’

দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে কিংবা তাঁর মৃত্যুতে ভূমিকম্প হলো— এসব নিয়ে হাসি-ঠাট্টা আছে চারিদিকে। এসব ঠাট্টাকে বৈজ্ঞানিক কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করারও চেষ্টা হয়েছে। সেসব ব্যাখ্যাকেও আবার ঠাট্টা করা হয়েছে। লোকজ বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যাঁরা খোঁজেন তাঁরা লোকসমাজ ও বিজ্ঞানের ফারাকটুকু বুঝতে ভুল করেন কি না সেরকম প্রশ্নও আছে।

সুন্দরবনে মৌয়ালরা বনে ঢোকার আগে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বনবিবিকে সম্মান জানান। বনবিবি তাদের বাঘের রাজা দক্ষিণা রায়ের হাত থেকে বাঁচাবে এটাই সেখানে লোকজ বিশ্বাস। একে মানসিক ভরসা বা ‘আশ্রয়হীনের আশ্রয়’ও বলা যায়। ওই মৌয়ালরা শত শত বছর ধরে এরকম ভরসার উপর বেঁচে আছেন। কেউ কেউ যে সেখানে বাঘের খোরাক হয়নি তা নয়, কিন্তু বিশ্বাস হারায়নি।

আরও পড়ুন- কোন ‘ভুলের’ শাস্তি? বাংলাদেশে মাঝরাতে কেন সাংবাদিককে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ?

এ প্রসঙ্গে মুন্ডাদের গল্প মনে পড়ছে। ১৮৯৯-এ যে মুন্ডারা বীরসা মুন্ডার উপর ভরসা করে ‘উলগুলানে’ শামিল হলেন তারা কেউ কি জানতেন না, উন্নত অস্ত্রপাতিতে বলিয়ান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পেরে উঠবেন না তারা? কেউ কেউ অন্তত জানতেনই। তারপরও কিছু লোকজ বিশ্বাস আর শোষণের বাস্তবতা তাদের বিদ্রোহ করিয়েছে। একালে হিসাব মিলাতে বসলে তির-ধনুক নিয়ে বন্দুকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে আহাম্মকি মনে হতে পারে। কিন্তু ঝাড়খণ্ডে বীরসা এখনও ‘ভগবান’। এখনও তারা বলেন ‘উলগুলানের শেষ নাই; ভগবানের মরণ নাই।’ বীরসাকে নিয়ে মুন্ডাসমাজের এই ভরসার আদি আছে, কোনও বিজ্ঞান নেই। যদিও সমকালীন বিজ্ঞানেই চলছে আধুনিক ঝাড়খণ্ড।

নজির হিসেবে ১৮৫৭-র দিল্লির ঘটনাও যুক্ত করা যায়। ইংরেজ বাহিনীর ভারতীয় জওয়ানরা লালকেল্লায় ঢুকে ৮২ বছরের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরকে যখন ‘দিওয়ান-ই-খাস’ বানায় তার বহু আগে মোগল বংশ চূড়ান্তভাবে হেরে বসেছিল। কারণ ততদিনে নতুন বিজ্ঞানের কাল শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু তাও ‘বাদশাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক ‘মিথ’ ভারতীয় সৈনিকদের বাহাদুর শাহকে সামনে রেখে বিদ্রোহে প্ররোচিত করে।

মিথ এভাবেই কালে-কালে সমাজে আধা-পরাজিত ঘামে ভেজাদের বেঁচে থাকার অর্থ দেয়, বাস্তবে দাঁড়িয়ে থেকেও যারা মূলত কল্পনায় বাঁচে। মিথ গড়ে ওঠে ওই নিম্নবর্গের সম্মিলিত স্বপ্নের আদলে। সেখানে থাকে তাদের যাবতীয় হতাশা, জয়, বীরত্ব, কল্পনাবিলাস এবং পরাজয়ও।

মানুষ যতটুকু জেনেছে ততটুকুই বিজ্ঞান। আর যতটুকু আজও জানেনি সেটাই মিথ। মিথকে মরীচিকাও বলা যায়। কিন্তু তার বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। বিজ্ঞান দিয়ে তাই মিথকে বোঝায় গোলমালে পড়তে হয়। সাঈদীর চাঁদ ও ভূমিকম্পনামাকে বিজ্ঞান দিয়ে ধরতে চাওয়া তাই সমাজবিদ্যার কোনও কাজে লাগে না। তবে প্রশ্ন ঠিকই থেকে যায়, সাঈদী মিথের আদল পেলেন কীভাবে এবং কেন? এর মাঝে কোনও সামাজিক বার্তা আছে কি?

যেভাবে ‘দুটি সমাজে’র টানাপোড়েন শুরু হয়

সাঈদীর মধ্যে ভক্তরা দেখেছেন জোরের সঙ্গে কথা বলার এক ভঙ্গি। দেখেছেন প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক এক কণ্ঠস্বর। সেক্যুলার উচ্চশিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ। উল্টোদিকে এক বিশাল উম্মাহর সাহসও ছড়ান তিনি ‘মাহফিলে’, মুসলমানদের অতীত গৌরবগাঁথার স্মৃতিতর্পণ থাকত যার বড় অংশজুড়ে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশিকতা অতিক্রম করে যেতে বলতেন তিনি। কিন্তু অলৌকিকতার মহিমায় মোহাবিষ্ট করেই সমাবেশ শেষ করতেন।

এরকম ফিউশনের জন্যই তাঁর কদর। গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকা অবিকশিত সমাজে তাঁর অধিকাংশ আলাপের আবেদন ছিল। বিশ্বজুড়ে তখন সবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঠিক তখনই সাঈদীকে সেক্যুলারিজমের বিপক্ষে দাঁড়াতে দেখা গেল। এই বিরোধিতা আবার আধুনিকতাকে পুরোপুরি খারিজ করতে রাজি নয়। তবে তাতে দীর্ঘমেয়াদে সমাজে দ্বিধাবিভক্তি বেশ বেড়েছে। সেই বিভক্তির একদিকে তিনি নায়কের আসন পেয়েছেন। বাংলাদেশ এখন এই ‘দুটি সমাজে’র টানাপোড়েনে পড়েছে। সাঈদী ভক্তরা এই টানাপোড়েনে লাভ দেখেন।

তাঁর বয়ানে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নিন্দা থাকত। শহুরে সমাজের অভিযোগ ছিল--বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নিয়ে তিনি যা যা বলতেন তার অনেক কিছু তথ্য হিসেবে সঠিক ছিল না। কিন্তু এও মিথ্যা নয়— এ অঞ্চল বিগত দশকের পর দশক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা শাসন করেছে। সেই শাসনে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সুখী নয়। এ অঞ্চলের যাবতীয় ব্যর্থতার নথিপত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের এভাবেই বড় হিসসা তৈরি হয়ে আছে। তারাই এখানে যুগের পর যুগ ‘নীতি’ নির্ধারণ করেছে। সেই নীতির বাস্তবায়ন করেছে। আজকের বাংলাদেশ সকল অর্থে তার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সৃষ্টি। এই সৃষ্টির ভুক্তভোগী জনসমাজের অন্তরে তাই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে রয়েছে বেদনার গভীরতর এক ক্ষত। সাঈদীর ভাষায় সেই বেদনা উস্কে উঠে শ্রোতার নীরব সমর্থন পায়। বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ‘বেলেল্লাপনা’ চলছে কিনা তার সত্যা-সত্য এই শ্রোতার কাছে গুরুত্বহীন। তাদের হতাশার দিকে কেউ যে উচ্চকণ্ঠে আঙুল দেখালো তাতেই শ্রোতা তৃপ্ত।

সাঈদীর শ্রোতারা বড় অংশ পুরুষ। নারীপ্রশ্নে তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও এই শ্রোতার মনোজগতে আঁচড় কেটেছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম হতাশা ও বঞ্চনায় ভোগা কোটি কোটি পুরুষ সচরাচর সামাজিক প্রতিযোগী হিসেবে আরেকদল কোটি কোটি মানুষকে (নারী) স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নন। নারীর অধস্তনতার সমর্থন তাই সাঈদীর আবিষ্কার নয়। এই কায়েমি স্বার্থের গোড়া প্রাচ্যের সমাজে আগে থেকে ছিল। সাঈদী কেবল সেই সমাজকেই হাজির করেন তাঁর মোড়কে, ঐশী দাবিতে।

সম্পদের স্বল্পতা ও অসাম্য নিয়ে তাঁর বয়ান র‌্যাডিকেল নয়। তবে ওয়াজে বরাবরই তিনি ‘রাজনৈতিক’। বাংলার ওয়াজ সংস্কৃতিকে তিনি বিশুদ্ধ ধর্মতত্ত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তবে সেটা ‘মুক্তির ধর্মতত্ত্ব’ হয়ে ওঠে না। শ্রোতাকে তিনি বিদ্রোহ করতে বলেন না। বিদ্রোহের কলাকৌশল তাঁর সূচিপত্র নয়। তবে তিনি মুসলমানদের বীরত্বের গল্প শোনান। প্যালেস্টাইন থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত তাঁর আলাপে থাকে। তিনি বিজয়ের মিথের কথা বলতেন। তবে মোনাজাতে লাখ লাখ মানুষকে কাঁদিয়ে বিদায় দিতেন। এই কান্নায় শরিক হয়ে ‘মজলুম’রা ভারমুক্ত হতো। স্রষ্টার কাছে সমর্পিত বোধ করত। জাগতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সমর্পিত হওয়ার মতো নেতা-নেত্রী না পাওয়া নিঃসহায়দের সাঈদী নতুন এক আশ্রয় দেন। তবে এই ‘আশ্রিত’রা সবাই আবার ‘আধুনিক অর্থনীতি’র মজলুমও নন। কিন্তু তারপরও তাদের কেন এরকম আশ্রয় লাগে সেটা চলতি আধুনিকতারই আরেক সংকট।

আরও পড়ুন- প্রতিষ্ঠানকে সওয়াল করা ‘জোকার’! ভোটকেন্দ্রে তাই কি মার হিরো আলমকে?

তবে সাঈদী সাহেব বিশাল বিশাল মাহফিলের যেরকম উপসংহার টানেন সেটা রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক কিছু নয়। কমিউনিস্ট বা সাম্যবাদীদের পুনঃপুন নাস্তিক প্রমাণ করেও সাঈদী দেশ-বিদেশের অনেক শক্তির ‘উপকার’ করে গেছেন নিয়মিত। সঙ্গত কারণেই জামায়াতে যোগ দেয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ওয়াজ মাহফিলে বাধা পেয়েছেন এমন শোনা যায় না। ফলে তাঁর ইমেজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘অপ্রতিরোধ্য’।

তবে এও লক্ষ্য করার মতো, যত মানুষ ঢাকায় সাঈদীর জানাজার দাবি করেছেন তার সিকিভাগও তাঁর মুক্তির দাবিতে কোনও দিন জমায়েত হননি। কেন এমন ঘটে এও আরেক সামাজিক ধাঁধাঁ।

শুধুই অরাজনৈতিক বোবাশক্তি?

ইতোমধ্যে অনেক জেলাতে সাঈদীর জানাজা হয়েছে। বিদেশেও হয়েছে বলে দাবি আছে। এসব জানাজায় বিপুল মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। ঢাকায় তাঁর জানাজা হলেও অনেক লোক হতো। কিন্তু রাষ্ট্রের এরকম জমায়েত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু ছিল না। বাংলার ইতিহাসে এরকম বড় জমায়েত বহু হয়েছে। অতীত বাংলায় কৃষক আন্দোলন কর্মীদের বিপুল জমায়েত শক্তি ছিল। তারও আগে অটোমান খলিফার সমর্থনে বাংলার মুসলমানরা খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে শহর-গ্রাম কাঁপিয়েছেন। তাতে ‘রাষ্ট্রশক্তি’র সমস্যা হয়নি। ব্রিটিশদের থেকে স্থানীয় কুলীনদের ক্ষমতার হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। জামায়াতও সাঈদী ভক্তদের রাজনৈতিক কাজে লাগাতে পারেনি কখনও। কারণ সমাবেশশক্তি যতটা মানবিক বিষয়— ক্ষমতার পালাবদল ঘটানো ততটাই ভিন্ন এক প্রকৌশলবিদ্যা। অন্তত একালে। ভক্তির সুনামিতে কতটা পীরবাদ, কতটা ব্যাকুলতা এবং কতটুকু রাজনৈতিক প্রত্যাশা থাকে সে ফারাক শনাক্ত করা সহজ নয়। তবে সাঈদীর লোকপ্রিয়তা আদৌ অরাজনৈতিক বোবাশক্তির অতিরিক্ত কিছু কিনা সেটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশে সমাজ ভাবুকদের জন্য গভীর এক মনযোগের বিষয়।

More Articles