লোকসভা ভোট ও ফর্ম ১৭সি, যেভাবে কৌশলে তথ্য গোপন করছে নির্বাচন কমিশন
Election Commission Of India: আদালতে মামলা চলাকালীন ১৭সি না প্রকাশের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যে যুক্তি দিয়েছিল তা শুধু অসঙ্গতই নয়, একই সঙ্গে অযৌক্তিক।
লোকসভা নির্বাচন প্রায় শেষের পথে। এই কদিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পারস্পরিক কুৎসা, মিডিয়ার ভূমিকার মত বিষয়গুলো যেমন বিতর্ক তৈরি করেছে, তাকে সমানতালে পাল্লা দিয়েছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ ও তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন। প্রথম দিকে এই বিতর্কের মধ্যে ছিল ইভিএম- ভিভিপ্যাটের গণনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অসহযোগিতা,অযৌক্তিক এবং যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘ নির্বাচন সিডিউল, শাসক দলের প্রধান নেতৃত্বের (আরও নির্দিষ্ট করে বললে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের) লাগাতার ঘৃণা ভাষণের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের অপরিসীম ব্যর্থতা ইত্যাদি। শেষ পর্বে গোটা বিষয়টা এসে দাঁড়াল একটি নির্বাচনী ফর্ম নিয়ে যার নাম ১৭সি। এই অলীক কুনাট্য রঙ্গের শেষ পরিণতি অবশ্য মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে মঙ্গলজনকই হয়েছে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে গোটা পর্বে নির্বাচন কমিশনের অদূরদর্শী আচরণ এবং সিদ্ধান্তহীনতা যেমন নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে তেমনই একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের এ হেন পরিণতি ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সবার কাছে হাস্যকর করে তুলেছে।
মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে ১৭সি ফর্ম নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা জরুরি। ভোটাররা না জানলেও নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক কর্মী একথা জানেন, দু'টো নিদর্শ ভোট প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য সবচেয়ে জরুরি তার মধ্যে প্রথমটি হল ফর্ম ১৭সি, দ্বিতীয়টি অবশ্যই প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরি। ১৭সি হল একটি বহুমুখী তথ্য সমৃদ্ধ নথি যা একটি বুথের ভোট সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যের আধার। একটি বুথে কতজন ভোটারের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে কতজন ভোট দিলেন (রেজিস্টারে নথিভুক্ত ভোটার ও মেশিনে নথিবদ্ধ ভোট), টেন্ডার ভোটের সংখ্যা,ইভিএম ও ভিভিপ্যাটের নাম্বার, যে কাগজ দিয়ে মেশিনগুলো সিল করা হয়েছে তার ক্রমিক নাম্বার— এক কথায় ভোট সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এই ফর্মে সংকলিত করেন প্রিসাইডিং অফিসার। এই ফর্মের কপি অন্তত ১২-১৫টি করা হয়। ভোট পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর প্রিসাইডিং অফিসার ফর্ম ১৭সি-এর কপি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বুথ এজেন্ট, সেক্টর অফিসারদের হাতে যেমন তুলে দেন, তেমনই ইভিএমে, রিসিভিং সেন্টারে এর কপি জমা করতে হয়। একটা বুথে কত ভোট পড়েছে সেই তথ্য, নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন স্তরে জমা হয়, একই সঙ্গে বুথ এজেন্টদের মাধ্যমে প্রার্থীরাও নির্দিষ্ট বুথের তথ্য জানতে পারে। ভোট গণনার দিন ইভিএম খোলার সময় কাউন্টিং এজেন্টরা নিজেদের হাতে থাকা ১৭সি এর তথ্যের সঙ্গে মেশিনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা মিলিয়ে নেন। তাই এই ১৭সি ছাড়া ভোট পর্ব অচল।
আরও পড়ুন: রক্ষকই কি ভক্ষক? লোকসভা ভোটের ময়দানে কতটা স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা?
১৭সি সংক্রান্ত বিতর্কের প্রেক্ষাপট হিসাবে দু'টি বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার। প্রথমটি হল ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার সংক্রান্ত একটি মামলা, যা ২০১৯ সালে দায়ের করা হয়েছিল। জনস্বার্থ মামলাটি করেছিল অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস নামক একটি এনজিও এবং সহ-পিটিশনার হিসাবে ছিল আরেকটি এনজিও কমন কজ। সম্প্রতি ইলেক্টোরাল বন্ডের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির পর্দাফাঁসের ঘটনা এদেরই জনস্বার্থ মামলার ফসল। নির্বাচনী সংস্কার সংক্রান্ত আরেকটি মামলা করেছিলেন তৃনমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা তার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে কুখ্যাত। লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণার মধ্যেও এই মামলাগুলির শুনানি চলছিল। দ্বিতীয় বিষয়টি হলে এবার প্রথম দুই পর্বের ভোট শেষ হওয়ার পর ভোটদানের যে শতকরা হার ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন, তার দশদিন পর আবার যে চূড়ান্ত ভোটদানের হার ঘোষণা করে,তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ফারাক। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক হিসাব ও চূড়ান্ত হিসাবের মধ্যে ৫%-৬% বৃদ্ধি দেখা দিচ্ছে। অঙ্কের বিচারে সেই ভোটের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ, যে সমস্ত জায়গায় বিজেপির ফল খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,সেখানেই রাতারাতি ভোটের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এই নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হওয়ার ফলে অবিলম্বে ১৭সি-তে নথিবদ্ধ ভোটের তথ্য জনসমক্ষে আনার দাবি আরও গতি পায়।
আদালতে মামলা চলাকালীন ১৭সি না প্রকাশের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যে যুক্তি দিয়েছিল তা শুধু অসঙ্গতই নয়, একই সঙ্গে অযৌক্তিক। কমিশন জানিয়েছিল, ১৭সি-এর তথ্য প্রকাশ করা জটিল নয় কিন্তু সময়সাপেক্ষ। এই বক্তব্য রিটার্নিং অফিসারের হ্যান্ডবুকে যে কথা লেখা আছে,তার সম্পূর্ণ বিপরীত। হ্যান্ডবুকে লেখা আছে, ভোটপর্ব শেষ হওয়া মাত্র বুথের প্রিসাইডিং অফিসার 'ক্লোজ বাটন' টিপবেন এবং মোট ভোট যা দেখাবে তা নথিভুক্ত হয়ে রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা হবে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এস.ওয়াই.কুরেশি বলছেন: "There is no reason for delays in getting voter data. This data is in the system in real time.. within five minutes of the polling ending, all information is available. Now in this situation, the Election Commission is accountable for why so much time is being taken to finalize the data"। সোজা কথায়, কত ভোট পড়ল সে সম্পর্কিত চূড়ান্ত তথ্য প্রকাশ করতে এত সময় লাগার কথাই না।
সর্বোচ্চ আদালতে নির্বাচন কমিশন তাদের হলফনামায় আরও জানায়, ১৭সি-এর তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও আইনি বিধান নেই এবং এই ফর্ম নাগরিকদের হাতে গেলে তারা নানান ধরণের 'দুষ্টুমি' করতে পারে। কিন্তু যে কথাটা বলা হল না, তা হল এই তথ্য প্রকাশ করতে কোনও আইনি বাঁধা নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এমন কিছু নথি আছে যা জনসমক্ষে প্রকাশ করা যায় না (Section 93 of conduct of election rules, 1961)। এই তালিকায় আছে ব্যবহৃত ও অব্যবহৃত ব্যালট পেপার (টেন্ডার ভোটে কাজে লাগে), বিভিন্ন রঙিন পেপার স্লিপ, ভোটার তালিকার মার্কড কপি ইত্যাদি। কিন্তু সেই তালিকার মধ্যে ১৭সি আদতেই পড়ে না। আর দুষ্টুমির প্রশ্নটি অবান্তর কেননা রাজনৈতিক দলের বুথ লেভেল এজেন্টদের হাতে এই নথি থাকার কারণে ১৭সি-এর কপি সহজেই জোগার করা যেতে পারে। এই অস্বীকৃতি আসলে ভোট প্রক্রিয়ার ভরকেন্দ্রে যারা আছে অর্থাৎ ভোটারদের তথ্য জানার অধিকারকেই লঙ্ঘন করে। এক্ষেত্রে প্রাক্তন আইএএস অফিসার কান্নন গোপিনাথনের পর্যবেক্ষণ উল্লেখযোগ্য: "Secrecy sows the seeds of suspicion"।
এই বিতর্কে আদালতের কার্যকলাপও নানা ধরণের বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কাজ সংক্রান্ত এরকম একটা সাংবিধানিক মামলার কেন পাঁচ বছরের মধ্যে ফয়সালা হল না,সেই প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল মামলার গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় মন্তব্য করেছিলেন, প্রয়োজনে রাত জেগেও মামলা শোনা হবে। বাস্তবে তা তো হলই না, বরং প্রধান বিচারপতি নিজেই গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে চলে গেলেন। অবসরকালীন বেঞ্চের বিচারপতি দীপঙ্কর চক্রবর্তী ও সতীশচন্দ্র শর্মা কোনও অন্তর্বর্তীকালীন রায় দিতে অস্বীকার করলেন কারণ তাঁদের মতে ভোট প্রক্রিয়ার মাঝপথে কোনও ধরনের আদালতের হস্তক্ষেপ নির্বাচনের মত বিশাল কর্মযজ্ঞকে ব্যাহত করতে পারে। অবশ্য গল্পটা এখানেই শেষ হল না। আদালতের আদেশ না থাকা সত্বেও ২৫ মে প্রথম পাঁচদফার ভোটদান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ( আসন পিছু) নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করে দিল। কমিশনের বক্তব্য, যে ভাবে ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সংগঠিত ভাবে কলুষিত করার চেষ্টা হচ্ছে, তা আটকাতেই এই তথ্য প্রকাশ। কমিশনের এই যুক্তি হালে পানি পাচ্ছে না কারণ এই তথ্য প্রকাশ কমিশন আগেই করতে পারত।
আরও পড়ুন:কত ভোট পড়ল জানাতে এত দেরি! কারচুপি লুকোতে চাইছে নির্বাচন কমিশন?
১৭সি নিয়ে বিতর্কটার কারণ লুকিয়ে আছে বিগত নির্বাচনের ইতিহাসে। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে শতাংশ হিসাবে ভোটদানের হার কোন কাজেই আসে না। দরকার আসন পিছু ঠিক কত ভোট পড়েছে তার হিসাবটা। অ্যাসোসিয়েশন অন ডেমোক্রেটিক রিফর্মসের মামলায় দেখা যায় ২০১৯ সালের ভোটের ফলাফলে ভোটার টার্ন আউট রিপোর্ট ও ইভিএম মেশিনে গোনা ভোটের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য থাকছে। নির্বাচন কমিশন আসনের ফলাফল ঘোষণার প্রায় ছয়মাস পর চূড়ান্ত হিসেব নিকেশ তৈরি করছে। এক্ষেত্রে কারণ হিসাবে রিটার্নিং অফিসারদের কাছ থেকে তথ্য আসার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির এই উন্নতির যুগে এই যুক্তি ধোঁপে টেকে না। এবারেই আমরা দেখলাম এত বিতর্কের পর প্রকৃত অর্থে তিন দিনের মধ্যে সমস্ত আসনের চূড়ান্ত ভোটদানের হিসেব কমিশন প্রকাশ করে দিল। এক্ষেত্রে আমাদের দাবি তোলা উচিত, আগামী দিনে বুথে ভোট প্রক্রিয়া সাঙ্গ হওয়ার পরে প্রিসাইডিং অফিসার ১৭সি-এর কপি বুথের দরজায় লাগিয়ে আসবেন যাতে সেই বুথের সমস্ত ভোটার প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। ১৭সি বিতর্ক শেষ বিচারে নাগরিকদের অধিকারের প্রশ্নে ইতিবাচক হলেও, কমিশনের অযোগ্যতার কারণে এক কুনাট্য রঙ্গের উদাহরণ হয়ে থাকল।