নিজে হাতে খাওয়াচ্ছেন পথকুকুরকে? কুকুরকে আগ্রাসী করে তুলছেন নিজের অজান্তেই

Stray Dog Bite Cases: যদি একটি জনাকীর্ণ এলাকায় প্রচুর সংখ্যক পথকুকুর থাকে, তবে তাদের পক্ষে আবর্জনা থেকেও খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন।

কুকুর এবং মানুষের সম্পর্ক নিয়ে বলার মতো শব্দভাণ্ডই কম। যুগের পর যুগ ধরে নানা সিনেমা, মহাকাব্য, গল্পে মানুষ আর পশুর এই সম্পর্ককে নিয়ে কত কথাই তো কতভাবে বলা হলো, তবু মুড়লো না নটে গাছ। আদিমকাল থেকে সেই যে কুকুর পোষ মানল, এখনও সে আদরের, যত্নের, নির্বাক ভালোবাসার সম্পর্কের কাছে মানুষকে নতজানু করে রেখেছে। চারপেয়ের সঙ্গে দু'পেয়ের এই বন্ধনই কুকুরকে মানুষের সেরা বন্ধু করে তোলে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, কুকুর এবং হোমো সেপিয়েন্স একসঙ্গেই বিবর্তিত হয়েছে। কুকুর আর মানুষ, শিকার, ঘোরাঘুরি এবং এমনকী যুদ্ধও করেছিল একইসঙ্গে। ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি জানাচ্ছেন, ১৫ হাজার বছর আগে পোষ মেনেছিল কুকুর। তবে তারও কয়েক হাজার হাজার বছর আগে হয়তো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল।

কুকুর অন্য যে কোনও প্রাণীর চেয়ে মানুষের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ করতে পারে। সভ্যতার বিকাশেও তাদের অবদান অতুলনীয়। তবে মানুষ আর কুকুরের এই বন্ধুত্ব এখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। ভারতের অনেক শহরেই পথ কুকুরদের কামড় বা আক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। সারা দেশেই পথকুকুরদের কামড় এবং পথচারী শিশুদের উপর আক্রমণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরাও অবাক। এমনকী বেশ কিছু পোষা কুকুরও এমনই কিছু ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কেন হঠাৎ এমন বেড়ে উঠল কুকুরদের কামড়ের ঘটনা?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কুকুরদের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রতিটি কুকুরের জন্যই খাদ্যাভাব তৈরি করে। কুকুরের আক্রমণাত্মক আচরণ এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর আক্রমণের ঘটনাগুলির নেপথ্যে এটি একটি মূল কারণ।

আরও পড়ুন- ভাতঘুম না হলে তার একেবারেই চলে না! বিশ্বের সর্বকালের বয়স্ক কুকুরের বয়স কত, জানেন?

যদি একটি পরিবার প্রতিদিন পাঁচ বা ছ'টি রুটি কুকুরকে খাওয়ায় তবে তা একদিনে একটি কুকুরের জন্য যথেষ্ট হতে পারে। এমন একাধিক পরিবার মিলে যদি একটি করে কুকুরের যত্ন নিতে পারে তাহলে কুকুরদের রোজের খাবার জোগানের কিছুটা সুবিধা ঘটে। কিন্তু সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পথকুকুরদের মধ্যে খাবারের পরিমাণ ভাগ হয়ে যাচ্ছে এবং তা খিদে মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। যদি একটি জনাকীর্ণ এলাকায় প্রচুর সংখ্যক পথকুকুর থাকে, তবে তাদের পক্ষে আবর্জনা থেকেও খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন। এটিই পথকুকুরদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার পিছনে মূল কারণ।

দ্বিতীয়ত, কুকুরের অত্যধিক জনসংখ্যার ফলে প্রতি বছর অনেক কুকুরছানা জন্ম নিচ্ছে। একটি স্ত্রী কুকুর এক বছরে ২০টি কুকুরছানার জন্ম দিতে পারে। প্রতিটি কুকুরছানাকে কুকুরের একটি দল চরম আগলে রাখে। যদি কোনও একটি কুকুরছানা গাড়ি বা বাইক দুর্ঘটনায় মারা যায়, কুকুরের ওই দলটি গাড়িটিকে তার শত্রু হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাকে তাড়া করে। এটি কুকুরের আগ্রাসন বাড়ায়, ফলে মানুষের উপর আক্রমণের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

তৃতীয়ত, সব পথকুকুরই যে আক্রমণাত্মক, তা নয়। বেশিরভাগই তাদের আশেপাশের কোনও মানুষকে বিরক্ত করে না। আক্রমণাত্মক কুকুররা দু'জন, তিনজন বা তারও বেশি সংখ্যায় মিলে একটি দল তৈরি করতে পারে কারণ এই কুকুরেরা ইতিমধ্যেই নিজেদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই দলের কুকুরগুলি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে থাকে এবং পোষা কুকুর ও গবাদি পশু সহ মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। যদি কোনও কুকুরের আচরণ ক্রমেই আগ্রাসী হয়ে ওঠে তবে অবিলম্বে কুকুরদের জন্য তৈরি আশ্রয়ে পাঠানো উচিত।

আরও পড়ুন- পথকুকুরের দায়িত্ব নিলেই বাড়তি চাপ! সুপ্রিম মন্তব্যে তীব্র আলোড়ন শহরের পশুপ্রেমীদের মধ্যে

আইন বলছে, এই ধরনের কুকুরদের শুধুমাত্র তখনই তাদের এলাকায় ফেরত পাঠানো যেতে পারে যদি তাদের আচরণে পরিবর্তন দেখা যায়। আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে থাকা কোনও কুকুরকে প্রথমেই গুরুত্ব না দিলে চারপাশের পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।

চতুর্থত, ২০০১ সালের সুপ্রিম কোর্টের আদেশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে পথকুকুরের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব নাগরিক সংস্থার। ইচ্ছা ও পরিকাঠামোর অভাবে বেশিরভাগ নাগরিক সংস্থাই টিকাকরণ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণে কোনও পদক্ষেপই করে না। কর্পোরেশনগুলিতে পশুচিকিৎসক এবং প্যারামেডিকসের অভাব রয়েছে। অনেক এনজিও এবং কুকুরপ্রেমী মানুষ পথকুকুরদের জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং টিকাকরণে এগিয়ে আসেন কিন্তু নাগরিক সংস্থাগুলির প্রচেষ্টার অভাবে সবটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

পঞ্চমত, বাড়ি থেকে দূরে কোনও জায়গায় কুকুরকে খাওয়ানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কুকুরের একটি আঞ্চলিক প্রবণতা রয়েছে। কুকুরদের প্রকৃতি হচ্ছে, যে মানুষ তাকে খাবার দিচ্ছে তাকে রক্ষা করতে হবে। যদি কেউ নিজের বাড়ির সামনে পথকুকুরদের খাওয়ায়, তবে সে কুকুরটির সঙ্গে নিজের পোষা প্রাণীর মতোই আচরণ করছে এবং রাস্তায় থাকা সত্ত্বেও সেই কুকুর তখন পোষ্যের মতোই প্রতিক্রিয়া জানাবে। তারা যে কোনও মূল্যে 'মালিক'-এর বাড়ি রক্ষা করবে এবং দরকারে কুকুরের অন্যান্য দল বা অন্য মানুষের প্রতিও আগ্রাসী হয়ে উঠবে।

More Articles