যে লেখে সে কেন লেখে?

যে লেখে সে কেন যে লেখে, এ কথা সে যদি একবার ভাবত!

বাংলা ভাষায় এই মুহূর্তে যাঁরা লেখেন তাঁদের বেশির ভাগের লেখাই দীর্ঘক্ষণ পড়তে পারি না। এই লাইনটি যদি এই সময়ের লেখাজীবীদের কেউ পড়েন, হাতে দুটো পথ খোলা থাকবে। লেখাটি না পড়া অথবা আমার লেখালেখির বিষয়েও একই মত পোষণ করা। তাঁদের এই অধিকারপ্রয়োগকে সম্মান জানিয়েই আবার বলছি, বেশির ভাগের লেখাই দীর্ঘক্ষণ পড়তে পারি না। এখন এই দীর্ঘক্ষণ কথাটির প্রয়োগ যেহেতু তুলনামূলক তাই প্রশ্ন আসবে, কাদের কোন লেখার সাপেক্ষে এই অনুযোগ, সেই লেখাগুলি কতক্ষণ পড়া যায়?

কৈশোরে মানুষের কৌতূহল বেশি থাকে, অন্তরে একটা সর্বগ্রাসী খিদে থাকে। তখন একদিন ইস্পাত, তো পরের দিন ইতি তোমার মা পড়া যায়। গদ্যে গতি থাকলে তো কথাই নেই, দিনে ৩০০ পাতা পড়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু পাঠক মন আসলে বৃদ্ধ হয় শরীর বৃদ্ধ হওয়ার অনেক আগে। ক্রমেই তার বাছবিচার বাড়ে, শ্লথতা বাড়ে। শুধু গতিতে তখন আর কাজ হয় না। মন বুঝে নিতে চায় অন্তঃসার। রাজনীতি। লিখনভঙ্গিমা। চিন্তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ। কল্পনার পরিধি। পরিশ্রম, পরিশ্রমের দাগ মুছে ফেলার পরিশ্রম। এগুলি সবই পাঠক মনের অতিজটিল বহুস্তরীয় গড়নের লক্ষণ। এই মন নিয়ে যখন বিষাদসিন্ধু পড়তে বসি, দেখি ১০০ পাতা পড়া যাচ্ছে, শহিদুল জহিরের একটি উপন্যাস পুনর্পাঠের সময়েও এক পাঠে শেষ করা যাচ্ছে। কিন্তু শেষ দুই দশকে যাঁরা লিখছেন বেশির ভাগের লেখাই, দু'একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে কুড়ি পাতা পড়তে পারি না একটানা। এমন একটা পরিস্থিতি, সম্পাদকীয় নিবন্ধ, প্রতিদিনের লেখা, হঠাৎ একটি বিদ্যুৎচমক— এ বাদে কিছুই আর পড়ে থাকছে না হাতে। শ্লথ, সাবধানী এই পাঠকমনকে জিজ্ঞেস করি, কেন পড়া যাচ্ছে না? বারবার, দীর্ঘদিন প্রশ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হয়, কারণ একটাই, বেশির ভাগ লেখাই খেয়ালখুশির লেখা।

এ কথা ঠিক, ভদ্রবিত্তের সিংহভাগের দ্বারা বর্জিত, নতুন প্রজন্মের হাতে কোনঠাসা একটি ভাষায় লেখার অভিপ্রায় থাকলেই লেখা যায় না। দিনের সিংহভাগ ক্ষুণ্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করে তবে লেখার দিকে যেতে হয়। এটা লেখকের সমস্যা নয়, সমস্যা পরিকাঠামোর, আমার ভাষা লেখককে উৎপাদন পরিকাঠামো দিতে অপারগ। আবার এ কথাও ঠিক, লেখা একজন লেখকের থেকে যে মগ্নতা দাবি করে, যে বক্ষলগ্নতা দাবি করে, যে ত্যাগ দাবি করে— তা আমাদের নেই, অথচ ক্লেম টু ফেম রয়েছে ষোলো-আনা। কেন লিখি, এই প্রশ্নের উত্তর আমার সময়ের প্রায় কোনো লেখকের কাছেই স্পষ্ট নয়। খুঁজতে ইচ্ছে করে, যাঁরা লিখে দিকদিগন্তে পরিব্যপ্ত হয়েছেন তাঁরা কেন লিখেছেন, কী ছিল তাঁর মনে, তাহাদের মনে?

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি নিবন্ধের দিকে মন যায় শুরুতেই। 'কেন লিখি' শীর্ষক লেখায় মানিক বলছেন,

জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি। আমি যা জেনেছি এ জগতে কেউ তা জানে না (জল পড়ে পাতা নড়ে জানা নয়)। কিন্তু সকলের সঙ্গে আমার জানার এক শব্দার্থক ব্যাপক সমভিত্তি আছে। তাকে আশ্রয় করে আমার খানিকটা উপলব্ধি অন্যকে দান করি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন লেখক যার একটি শব্দও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। উদ্ধৃতাংশে মানিক জীবন-অভিজ্ঞতার কথা আনছেন। জীবন-অভিজ্ঞতা না থাকলে লেখক লিখবেন কী, বলবার মতো নতুন কথাটি কোথায় পাবেন তিনি। এখনও প্রতিদিন সকালে দেখি আমার স্কুল শিক্ষক, গল্পকার সাধন চট্টোপাধ্যায় চারপাশ নিবিড় ভাবে দেখতে দেখতে পায়ে হেঁটে বাজারে যাচ্ছেন। আবার ফিরছেন। কখনও কখনও দিনে দু'বারও যান। দীর্ঘদিন আগে  চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। মোটের উপর স্বচ্ছল সাধন চট্টোপাধ্যায়। এই বয়সে তিন কিলোমিটার যাতায়াতটা তিনি অনায়াসে অটো বা রিক্সায় করতেই পারেন। আমি বুঝি জীবন দেখার লোভটা তিনি সামলাতে পারছেন না। তাই ঝাঁপতালে হেঁটে চলা রোজ। জীবন না দেখলে লেখা আর উইকিপিডিয়ার এন্ট্রির মধ্যে ফারাক থাকবে বলে মনে হয় না। ক্রমশ তাই-ই হয়েছে।

কেন লিখি শীর্ষক একটি স্মরণীয় বক্তৃতা আছে আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক ওরহান পামুকের। পামুক সেখানে বলেন,

"আমি লিখি কারণ আমার অন্তরে লেখার একটা সহজাত প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। লিখি কারণ আমি আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো সাধারণ কাজগুলি তেমন পারি না।...আমি লিখি কারণ, আমি আপনাদের উপরে, আপনাদের সবার উপরে রেগে আছি। আমি লিখি কারণ সারাদিন লেখার ঘরটায় বসে লিখতে ভালো লাগে। আমি লিখি কারণ আমি সবাইকে, গোটা বিশ্বকে জানাতে চাই, তুরস্কে, এই ইস্তানবুলে আমরা কেমন ভাবে বেঁচে আছি। আমি লিখি কারণ আমি কাগজের গন্ধ, কলম আর কালি ভালবাসি। আমি লিখি কারণ আমার সাহিত্যে, উপন্যাসে অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি বিশ্বাস আছে।"

লিখনে পামুক উদ্ধৃত ক্রোধের সবচেয়ে অনিবার্যতম বিস্তার অন্তর্ঘাত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে-উপন্যাসে ভাবুন, কী নিষ্ঠাবান নির্লিপ্ত অন্তর্ঘাতের ছড়াছড়ি সেখানে। সরীসৃপ গল্পটির কথা যদি মনে করি। একটি পুরুষকে ঘিরে দুই বোনের মধ্যে টানাপোড়েন। বড় বোন ছোটবোনকে খুন করতে তারকেশ্বর থেকে কলেরা রোগীর ভেদবমি বাটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। কিন্তু মরণ এমনই নিষ্ঠুর, ছোট বোনটি দিব্যি বেঁচে যায়, মরে যায় সেই বড়বোনই।

মানিক অনেক দূরের নক্ষত্র। ভীড় থেকে দূরে মানববোমার মতো বিস্ফোরণ সম্ভাবনাময় গদ্য তো এই শহরে বসেই প্রসব করেছেন নবারুণ ভট্টাচার্য। কিন্তু একজন উত্তরাধিকারীও তিনি সম্ভবত তৈরি করে যেতে পারেননি। সম্ভবত লেখার জন্যে যে আন্তরিক আধ্যাত্মিক নির্জনতা লাগে, আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই নির্জনে লেখার জন্যেই আপিস নিয়েছিলেন পটলডাঙা স্ট্রিটে। পয়ষট্টি বছর বয়সেও রোজগারের তাড়নায় শনিবারের চিঠিতে চাকরি করতে হয়েছে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ফিরে নিশুত রাতে লিখতে বসেছেন ঘরের এক কোণে। পড়েছি, লেখাজীবনের প্রথম দিকে একটি ছোট ফ্ল্যাটে থাকতেন মুরাকামি। লিখতেন স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লে, তাঁর রান্নাঘরে। তাই নিজের উপন্যাসকে কিচেন নভেল বলতেন তিনি।

মুরাকামি বিশ্বাস করেন রোজ লিখতে হবে। জাপানি কাইজেন পদ্ধতি আরকি। প্রতিদিন একটি বিষয়কে একটু একটু করে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। উপন্যাস লেখার সময়ে মুরাকামি প্রতিদিন সকাল চারটেয় ওঠেন, ছয় ঘণ্টা টানা লেখেন। শরীর-মগজ চাঙ্গা রাখার জন্যে দশ কিলোমিটার ছোটেন প্রতিদিন। নিয়ম করে রাত ন'টায় শুতে যান। নিয়মে ছেদ পড়ে না কখনও। মনে করে দেখুন যে রবীন্দ্রনাথের লিখন অবয়ব এমন পর্বতপ্রমাণ তিনিও কখনও বেরুটিন হননি, ব্রক্ষ্মমুহূর্তে উঠেছেন। কইতে কথা বাধে নামক একটি সরেস পেপারব্যাকে সমরেশ মজুমদার সমরেশ বসু সম্পর্কে লিখেছিলেন, গভীর রাত পর্যন্ত মদ্যপানের পরেও তিনি দেখেছেন, সকাল হতেই সমরেশ বসু তাঁর লেখার টেবিলে। শুনেছি উদয়ন ঘোষও এমন কাকভোরে উঠে নিজের লেখা লিখতেন। দিনের অন্য সময়ে তাঁকে কলেজ, ছাত্রছাত্রী, স্ত্রী-কন্যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। শুধু লেখাই নয়, থাকতে হবে বারংবার সম্পাদনার ধৈর্য্য। রোদে যেমন আচার শুকোয়, তেমন লেখাকে ফেলে রাখা। সেই কারণেই তো আজও জীবনানন্দের উপন্যাসের নবকলেবর প্রকাশিত হয়। 

আসলে লেখার দাবি অনেক। মার খেয়ে পড়ে থাকতে হবে। কনসিস্টেন্সি চাই। সুখের যাবতীয় হাতছানি ত্যাগ করে জীবনকে রুটিনে বাঁধতে হবে। যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাভিচারকে বাঙালি মিথ বানায়, লেখার ক্ষেত্রে অনিয়ম, অনিয়ন্ত্রণ কি তাঁর কখনও ছিল! প্রশ্ন করতে হবে নিজেকেই। না লিখে কি আমার চলবে না? লেখার জন্যে আমি অনিঃশেষ অপমান সহ্য করতে প্রস্তুত তো? ডাবলিনার্স ছাপতে চেয়ে ২২ বার শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল জেমস জয়েসকে। জে কে রাউলিং-এর হ্যারি পটার-এর পাণ্ডুলিপি ১২ বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই প্রত্যাখ্যান সহ্য করার, লেখার টেবিলে পড়ে থাকার, সমস্ত হাতছানি ত্যাগ করার ইচ্ছেশক্তি কি আমাদের আছে? নিজের লেখা সম্পর্কে নির্মোহ হতে পেরেছি আমরা, নাকি সুযোগ পেলে বন্ধুর সামনে নিজেই নিজের লেখার পিঠ চাপড়ে দিই, নিজেকে দশ বারো দিই, আর তা বিশ্বাসও করি?

আজ হঠাৎ এত প্রশ্ন কেন? আসলে এই কিস্তি লিখতে বসার আগে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। দু'জনেই একমত হলাম, সামনেই বইমেলা। এমন একটিও বই চোখে পড়েনি যাকে ঘিরে উৎসাহ তৈরি হবে মনে। অথচ অনেক বই তৈরি হবে এবারেও। তেমনটাই তো কাম্য। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এটুকুই বলার, যে লেখে সে কেন যে লেখে, যদি একবার ভাবত!

More Articles