'ভোটে লড়ার টাকা নেই'! কতটা সত্যি বলছেন নির্মলা?
Nirmala Sitharaman: শোনা গিয়েছে, দলের তরফে নাকি লোকসভা ভোটে লড়ার জন্য ডাক পাঠানো হয়েছিল নির্মলাকে। প্রাথমিক ভাবে তিনি ভেবে দেখার কথা বললেও পরবর্তীতে ভোটে লড়ার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। বৃহস্পতিবার তিনি জানান, অর্থাভাবে...
লোকসভা ভোট সামনেই। ইতিমধ্যেই প্রায় সব দলেরই প্রার্থীতালিকা ঘোষণা প্রায় শেষের পথে। বিজেপির তিন দফা তালিকা প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। তবে সেই তালিকায় নাম নেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের। কেন নেই? তবে কি তাঁকে লোকসভা ভোটে দাঁড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি দল? বৃহস্পতিবার নির্মলা জানিয়েছেন, তিনি ভোটে লড়তে পারবেন না। কারণ নাকি তাঁর কাছে টাকা পয়সা নেই ভোটে লড়ার মতো। কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সীতারমনের ২০২২ সালে জমা করা হলফনামা বলছে, সে সময় তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২,৬৩,৭৭,৮৬১ টাকা। সর্বশেষ সম্পত্তির হিসাবে স্বয়ং মোদীর চেয়ে একটু হলেও এগিয়েই আছেন নির্মলা। অথচ তিনি বলছেন, ভোটে লড়ার মতো অর্থই নাকি তাঁর নেই।
তবে কেন এমন বলছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। শোনা গিয়েছে, দলের তরফে নাকি লোকসভা ভোটে লড়ার জন্য ডাক পাঠানো হয়েছিল নির্মলাকে। প্রাথমিক ভাবে তিনি ভেবে দেখার কথা বললেও পরবর্তীতে ভোটে লড়ার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, অর্থাভাবেই ভোটে লড়তে পারছেন না তিনি। রাজনীতির ব্যাপারে যাদের সামান্যতম জ্ঞানটুকুও রয়েছে, তাঁরা সকলেই জানেন, কোনও প্রার্থীই সাধারণত নিজের সঞ্চিত অর্থের ভরসায় ভোটে লড়েন না কোনও কালেই। সেই অর্থ তাঁকে জোগায় দল। এদিকে বিজেপি দেশের অন্যতম ধনী দল। ইলেক্টোরাল বন্ড মারফৎ কোটি কোটি টাকা ঢুকেছে দলের কোষাগারে। এদিকে নির্মলার মতো জরুরি মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীর ভোটে দাঁড়ানোর সামান্য অর্থটুকু জোগাতে পারল না দল? স্বাভাবিক ভাবেই নির্মলার এই তত্ত্ব হজম হচ্ছে না ওয়াকিবহাল মহলের।
যতদূর জানা যাচ্ছে, ২০২৪ লোকসভা ভোটে তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রপ্রদেশের আসন থেকেই লড়তে বলা হয়েছিল নির্মলাকে। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। নির্মলা তামিলনাড়ুর ভূমিকন্যা। সেখানেই তাঁর জন্ম। বেড়ে ওঠাও। এদিকে অন্ধ্রপ্রদেশ নির্মলার শ্বশুরবাড়ি। তাঁর স্বামী পারকলা প্রভাকর অন্ধ্রের মানুষ। এমনকী নির্মলা ও প্রভাকরের বিয়েতে বিশেষ ভূমিকা ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর। এক জায়গার তিনি মেয়ে, অন্য জায়গায় পুত্রবধূ। অথচ দুটি জায়গাই ভোটে লড়ার জন্য প্রত্যাখ্যান করলেন নির্মলা। যদিও তিনি বলেছেন, “অন্ধ্রপ্রদেশ কিংবা তামিলনাড়ু, যেখানেই ভোটে দাঁড়াই, সেখানে জেতার একাধিক মাপকাঠি রয়েছে।" অথচ সেই জেতাম্যাচে তিনি অংশই নিলেন না শুধুমাত্র অর্থাভাবে।
আরও পড়ুন: নির্বাচনে লড়ার টাকা নেই খোদ অর্থমন্ত্রী নির্মলার! সম্পত্তির খতিয়ান বলছে যে কথা
ইলেক্টোরাল বন্ড মারফত সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছে বিজেপি, এ কথা প্রমাণিত। লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগে এই ঘটনা যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছে দলকে। ইলেক্টোরাল বন্ড মারফত অন্যান্য ছোট-বড় দলরাও টাকা পেয়েছে বটে। তবে বিজেপির মতো এত বড় অঙ্ক আর কারওর ফান্ডে ঢোকেনি। সম্প্রতি নির্মলার স্বামী তথা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মুখ খুলেছিলেন এই ইলেক্টোরাল বন্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে। এই প্রকল্পকে শুধু দেশের নয়, গোটা বিশ্বের সব থেকে বড় দুর্নীতি বলে জানান তিনি। নির্বাচনেও ভোটাররা এই দুর্নীতির জন্য এই সরকারকে যথাযথ শাস্তিও দেবে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। প্রভাকরের এই মন্তব্য নিয়ে মুখে কিছু না বললেও বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিল দল। বলাই বাহুল্য, অস্বস্তিতে পড়েন নির্মলা নিজেও। তিনি বর্তমানে দেশের অর্থমন্ত্রী। আর তার জমানাতেই সামনে এসেছে বিজেপির এত বড় অস্বস্তির কথা। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের মত, সেই অস্বস্তি চারিয়ে গিয়েছে নির্মলার মধ্যেও। আর সেখান থেকেই কি দলের টাকা নিতে চাইছেন না নির্মলা! তাই এবার প্রকাশ্যে ঘোষণা করে সেই বিরোধিতার জায়গাটা সামনে এনে দিলেন তিনি। উঠেছে প্রশ্ন।
তবে কেউ কেউ আবার উস্কে তুলেছে অন্য একটি প্রশ্নও। অতীতে বারবার রাজ্যসভায় জিতে সংসদে এসেছেন নির্মলা। সেখান থেকেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রক হয়ে অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব। সেই নির্মলা কি তবে লোকসভা ভোটে লড়তে আদতে ভয় পাচ্ছেন? সে জন্যই অর্থাভাবের কথা বলে ভোটের লড়াই থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন নির্মলা? দক্ষিণ ভারতে বিজেপির অবস্থা যে খুব একটা ভালো, তেমনটা বলা যায় না। অনেকদিন ধরেই দক্ষিণ ভারতের মন জয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে বিজেপি। দলের তাবড় নেতারা বারবার যাচ্ছেন দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে। কিছুদিন আগেই মহাধূমধাম করে উদ্বোধন হয়েছে রামমন্দিরের। সেই রামমন্দিরে অভিষিক্ত রামমূর্তির আদলেও আমরা দেখেছে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পের ঢং। সেসময় থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল, কেন উত্তর ভারতে অবস্থিত রামমন্দিরে দক্ষিণী মূর্তির আদল গ্রহণ করল মোদি সরকার। রামমন্দিরের প্রতিটা ইঁটের গাঁথনি থেকে শুরু করে প্রতিটি নকশা কিন্তু রীতিমতো বিবেচনা করে ভেবেচিন্তেই নিয়েছে মোদি-সরকার। আর তার নেপথ্যে অবশ্যই ছিল ২০২৪ লোকসভা ভোটের ভাবনা। ফলে দক্ষিণের মন জয়ে মোদির দল যে ঠিক কতটা মরিয়া, তা নতুন করে বলে দিতে হয় না।
অর্থমন্ত্রীর সিংহাসনে বসা নির্মলা কি সত্যিই পারতেন সেই দক্ষিণে দাঁত ফোটাতে? অবশ্য ভূমিকন্যা হওয়ার সামান্য সুবিধা তার কাছে ছিলই। এখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ওঠে, অর্থাভাবে ভোট লড়তে পারছেন না বলার পরেও কি দলের তরফে অর্থসহায়তার আশ্বাস পাননি নির্মলা? তবে কি ভোটে লড়বেন না বলে ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতি থেকে নিজের ব্যবধানটাই স্পষ্ট করে দিতে চাইলেন অর্থমন্ত্রী? সিপিআইএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অবশ্য তেমনটাই মনে করছেন। ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতির টাকা নিতে চাননি বলেই নির্মলা অর্থাভাবের কথা বলেছেন বলে মনে করছেন সেলিম। তাঁর কথায়, "বিজেপির মতো দলগুলি টাকাপয়সা দিয়েই ভোট করে। বামেদের প্রার্থীতালিকায় তো কোনও প্রার্থীর অর্থবল দেখা হয়নি। বিজেপি যে টাকায় ভোট করে অর্থাৎ ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা, সেই পাপের টাকার আসলে অংশীদার হতে চান না নির্মলা। ভোট লড়তে চান না সেই ঘুষের টাকায়। সেজন্য তাঁকে বাহবা জানাই। ওঁর স্বামী অর্থনীতিবিদ পারকলা প্রভাকর নিজেই জানিয়েছেন, যে অর্থনীতি দিয়ে বিজেপি চলছে, তা আসলে দেশটাকে চৌপাট করে দিচ্ছে। স্ত্রী হিসেবে সেই দুর্নীতিকে যদি নির্মলা অনুভব করে থাকেন, তার জন্য ফের স্বাগত জানাই নির্মলাকে।" প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির জমানায় এই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পের শুরু। সে সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন না নির্মলা। ফলে নির্মলা নিজেকে সেই দুর্নীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টাই সম্ভবত করলেন অর্থাভাবের কথা বলে, এমনটাই মনে করছে বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
আরও পড়ুন:চৌকিদারই চোর? বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি নির্বাচনী বন্ডই?
তাছাড়া সাধারণত যে কোনও দলের ভোটের খরচ বহন করে সেই দলই। ইলেক্টোরাল বন্ড মারফৎ সব দল কমবেশি লাভবান হলেও এক পয়সাও বন্ড থেকে নেয়নি সিপিএম। কেরলের মতো জায়গায় সরকারে থাকা সত্ত্বেও সেই দুর্নীতির অংশ হয়নি বাম। এমনকী প্রকল্প প্রণয়ণের সময় জেটলি জমানাতেই এই বন্ডের বিরোধিতা করেছিল বামেরা। সেলিম জানিয়েছেন, বামেদের দল চলে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের টাকা থেকেই। জনতার টাকাতেই ভোট করে তাঁদের দল। কর্পোরেট পুঁজি কোনও কালেই ব্যবহার করেনি বাম। বরাবরই ছাত্রযুব, শ্রমিক, কৃষক থেকে নিজস্ব বাহিনী তৈরি করে এসেছে কমিউনিস্ট পার্টি। তাঁদের ৩৬৫ দিনের আয়ের থেকে দু'দিনের আয় নেয় সিপিএম। এই টাকা বামেদের প্রথম সম্বল। এ ছাড়া গণসংগ্রহ তো রয়েইছে। সেখান থেকেই দল চলে। ভোট হয়। অর্থাৎ বোঝাই যায়, নির্মলা যা বলেছেন, তা সর্বাঙ্গীন ভাবে সত্যি নয়। তবে এই ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতি সামনে আসার পর তাঁর এই বক্তব্য বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তো বটেই।