ইউরোপকে বিদায়! কেন সৌদিতে মজেছেন রোনাল্ডো-রা?
ফুটবলকে সামনে রেখে সৌদি রাজতন্ত্র এক ঢিলে দু-পাখি মারতে চায়। বিদেশি পুঁজিও আসবে, আবার যুবসম্প্রদায়কে ফুটবলে টেনে আনলে বিক্ষোভের আঁচও কমবে।
শুরু হয়েছিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে দিয়ে। ২০২২-র ডিসেম্বরে ৩৭ বছর বয়সী রোনাল্ডো যখন ভারতীয় মুদ্রায় ১৮৩৮ কোটি টাকার চুক্তিতে সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরে সই করে, তখন সারা বিশ্ব হতবাক হয়ে গেছিল। তখন বোঝা যাইনি রোনাল্ডোর সৌদি-যাত্রা আসলে ট্রেলার ছিল মাত্র। এ বছরের ফুটবল দলবদলের বাজার (ট্রান্সফার উইন্ডো) চালু হতেই পুরো সিনেমা শুরু হল। রিয়াল মাদ্রিদের করিম বেঞ্জেমা, চেলসির এনগোলো কন্তে, লিভারপুলের রবার্তো ফিরমিনো, জর্ডান হেন্ডারসন, ম্যানচেস্টার সিটির রিয়াদ মাহরেজ, বায়ার্ন মিউনিখের সাদিও মানে সহ অসংখ্য প্লেয়ার ইউরোপের ফুটবল ছেড়ে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে সৌদি আরবের ফুটবল লিগে। যে পরিমাণ টাকায় এঁরা সই করছেন, তাতে এঁদের আগামী তিনপুরুষ নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। যেমন বেঞ্জেমা ও কন্তে দুজনেই পাবেন বার্ষিক প্রায় ১৫০০-১৬০০ কোটি টাকা করে। এমনকি লিওনেল মেসি আর কিলিয়েন এমবাপের জন্যও বিরাট অংকের প্রস্তাব রেখেছিল সৌদির ফুটবল ক্লাবগুলো।
আরও পড়ুন: পূর্বপুরুষকে ক্রীতদাস করে রেখেছিল যারা, তাদের হয়েই ফুটবল খেলত কৃষ্ণাঙ্গরা…
এমনিতেও ফুটবলাররা বয়স হয়ে গেলে ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকা, জাপান, কাতারের বিভিন্ন ক্লাবে নাম লেখায়। যাতে শেষ বয়সে তুলনায় দুর্বল লিগে চাপহীন ফুটবল খেলে প্রচুর টাকা উপার্জন করা যায়। জাভি, ইনিয়েস্তা, ওয়েন রুনি, আন্দ্রে পিরলো, ল্যাম্পার্ড, স্টিভেন জেরার্ডরা অতীতে সেই পথেই হেঁটেছেন। মেসি চলে গেছেন আমেরিকার ইন্টার মায়ামিতে। রবার্তো কার্লোসের মতো ফুটবলারকে ‘ইন্ডিয়ান সুপার লিগ’-এও খেলতে দেখা গেছে। এর ফলে এই দেশের কম জনপ্রিয় লিগগুলো সারা বিশ্বে পরিচিতি পায়, আরও বেশি প্লেয়ারকে আকৃষ্ট করে এবং সে দেশের ফুটবলে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা টাকা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। এটাই সহজ হিসেব; এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু সৌদি আরব যে ফুটবলারদের কিনছে, তাঁদের বয়স তিরিশের কাছাকাছি হলেও কারোরই ফুটবল জীবন শেষের পথে নয়। লুকা মদরিচের মতো প্লেয়ার তো ৩৭ বছর বয়সে পুরো ১২০ মিনিট জুড়ে মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর সেখানে পতুর্গালের ২৭ বছর বয়সী রুবেন নেভেস বার্সেলোনার প্রস্তাব ফিরিয়ে সৌদির আল হিলালে সই করছে। সৌদির আগ্রাসী মনোভাব আর কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ দেখে ইউরোপের ফুটবল বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এভাবে চললে তো ইউরোপের ফুটবলের বাজার পড়ে যাবে। ফলে গোটা ইউরোপের মতো ভারতেও এই প্রশ্নটা ঘুরছে যে সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষ তাঁদের ‘কৌলিন্যহীন’ ফুটবল লিগের জন্য এতো টাকা বিনিয়োগ করছে কেন? তাহলে কি ইউরোপের ফুটবলের বাজারকে নষ্ট করে সৌদি আরব বিশ্ব ফুটবলে রাজত্ব করতে চাইছে? নাকি এর পিছনে আছে অন্য কোনো বড়ো পরিকল্পনা?
২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ ম্যাচে সৌদি আরব শক্তিশালী আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। পরে জানা যায় যেখানে অন্য দেশগুলি বিশ্বকাপের জন্য মাত্র ২০-২৫ দিনের ক্যাম্প করেছিল, সেখানে সৌদি আরব তিন মাসে আগে নিজেদের লিগ বন্ধ করে দিয়ে প্লেয়ারদের জাতীয় দলে ডেকে নেয়। তারও আগে থেকে ইতালিয়ান বা স্প্যানিশ সুপার কাপের মতো ঐতিহ্যশালী ম্যাচগুলোকে তাঁরা নিজেদের দেশে আয়োজন করা শুরু করেছিল। ২০২১-এ সৌদির সৌদি আরবের রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থা পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পি.আই.এফ) ইংল্যান্ডের নামকরা ক্লাব নিউকাসল ইউনাইটেডকে কিনে নেয়। কেউ ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি ভিতরে ভিতরে কী পরিকল্পনা চলছে। সম্প্রতি ওই একই সংস্থা তাঁদের দেশের চারটে বড়ো ক্লাব আল নাসর, আল হিলাল, আল ইত্তিফাক ও আল আহলিকে কিনে নিয়েছে। বলা হচ্ছে এর ফলে ‘সৌদি প্রো লিগ’-এ (এস.পি.এল) পুঁজির বিনিয়োগ শুরু হল। অঘোষিতভাবে ঠিক হল এই চারটে ক্লাবের প্রত্যেকে ইউরোপ থেকে তিনজন জনপ্রিয় মুখ সই করাবে। আর অন্য ক্লাবগুলোতে ইউরোপের তুলনায় কম জনপ্রিয় প্লেয়ারদের একজন করে সই করাতে সাহায্য করবে সৌদি সরকার। এই পুরো পরিকল্পনায় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উৎসাহ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি।
এবার আসা যাক কারণে। পি.আই.এফ-এর বিরাট পুঁজির প্রবেশ আপাতত চারটে ক্লাবে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা অন্য সংস্থাগুলিকে পুঁজি বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে। কিন্তু লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা না থাকলে কোনো সংস্থা পুঁজি বিনিয়োগ করবে না। আর সেখানেই রাজকীয় আগমন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর। তাঁকে সন্তুষ্ট রাখতে শুধু প্রভূত অর্থ নয়, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপনের জন্য সৌদির কিছু নিয়মও শিখিল করা হয়েছে। সম্প্রতি রোনাল্ডো একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে ‘সৌদি প্রো লিগ’ বিশ্বের প্রথম পাঁচটি ফুটবল লিগের সমকক্ষ হওয়ার শক্তি রাখে। বাস্তব ছবি অবশ্যই অন্য কথা বলে। কিন্তু ‘সৌদি প্রো লিগ’ বিশ্ব ক্লাব ফুটবলের র্যাঙ্কিং-এ ৬৮ নাম্বারে থাকলেও এর জনপ্রিয়তা অনেক ইউরোপীয় লিগের থেকে বেশি। এবং যাঁর সামান্য কথায় কোকাকোলার শেয়ার পড়ে যেতে পারে, সেই রোনাল্ডোর বক্তব্যের প্রভাব যে ভবিষ্যতে পড়বে না কে বলতে পারে? গত ছ’মাসে সৌদি ফুটবলের বাণিজ্যিক স্বত্ব আকাশ ছুঁতে শুরু করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘সৌদি প্রো লিগ’ সম্প্রচারের স্বত্ব বিরাট অঙ্কে বিক্রি হয়েছে। জার্সি বা মার্চেন্ডাইজ বিক্রির সংখ্যাও বাড়ছে। অনুমান করা হচ্ছে ২০৩০-এর মধ্যে ‘সৌদি প্রো লিগ’-এর আয় বাড়বে চারগুণ এবং মোট অর্থমূল্য দাঁড়াবে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার। এই মূল্য ইউরোপের লিগগুলোর কাছে অবশ্য ধোপেও টিকবে না। কিন্তু এই সমস্ত অঙ্ক একটা উত্তরের দিকে টেনে নিয়ে যাবে—তা হল ২০৩০-এর ফুটবল বিশ্বকাপ।
ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই সম্মান আর কৌলিন্য, পিছু পিছু আসবে পর্যটন, বাণিজ্য, বিভিন্ন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ। ফুটবলের উন্মাদনায় দেশের জনপ্রিয়তা বাড়ে; কত কলঙ্ক মুছে যায়। এই যেমন কাতার বিশ্বকাপের আগে ওই দেশের মানবাধিকার নিয়ে কত প্রশ্ন। এখন সেসব গায়েব হয়ে গেছে। কাতারকে লোকে মনে রাখবে বিশ্বকাপ ফুটবলের শ্রেষ্ঠ ফাইনালের জন্য। সৌদি আরবও সেই পথেই হাঁটছে, তবে ধীরেসুস্থে। ২০২৬-এর বিশ্বকাপ হবে আমেরিকা-কানাডা-মেক্সিকোতে। সৌদি আরব ২০৩০-এর ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের অন্যতম দাবিদার হয়ে উঠতে চায়। সৌদি আরব ততদিনে বিশ্ব ফুটবলের বাজারে নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করে নিতে চায়। ইতিমধ্যেই স্টেডিয়াম তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। রোনাল্ডো, বেঞ্জেমা, কন্তে এবং ভবিষ্যতে আরো যেসব বিখ্যাত ফুটবলাররা সেখানে নাম লেখাবে, তাঁরা হয়ে উঠবেন সৌদির ফুটবল দূত। ফিফার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোকেও প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সৌদি আরবে দেখা যাচ্ছে। প্রাক্তন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারের বিরুদ্ধে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সৌদি আরব সেই ভুল করতে চায় না। বরং নিজেদের ‘কুলীন’ প্রমাণ করে যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে উঠতে চায়।
কিন্তু এই সমস্ত পরিকল্পনা শুধু কি ফুটবলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে? মনে তো হয় না। সৌদি আরবের সম্পদের মূল উৎস খনিজ তেল। তাও একদিন ফুরিয়ে যাবে। পশ্চিমী বিশ্ব এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ‘গ্রিন এনার্জি’-র উপরে। সৌদি আরবও চেষ্টা করছে পর্যটন শিল্প, খেলা বা স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলি বেসরকারি করে বিদেশি পুঁজিকে ঘরে ডেকে আনতে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বাধা সৌদি-রাজতন্ত্রের নারীস্বাধীনতা, লিঙ্গস্বাধীনতা বিরোধী একনায়ক ভাবমূর্তি। দেশের মধ্যেও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ফুটবলকে সামনে রেখে সৌদি রাজতন্ত্র এক ঢিলে দু-পাখি মারতে চায়। বিদেশি পুঁজিও আসবে, আবার যুবসম্প্রদায়কে ফুটবলে টেনে আনলে বিক্ষোভের আঁচও কমবে।
আরও পড়ুন: ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?
তবে এসব নেহাত রাজনীতির কথা। আসল কথাটা হলো ফুটবল কোন জায়গায় পৌঁছোবে? এর আগে চিনে, আমেরিকাতে, এমনকি ভারতেও বিখ্যাত খেলোয়াড়দের নিয়ে এসে ফুটবলকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা হয়েছে। চিনে এই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে, আমেরিকার কিছু যায়ে-আসেনি, এখন ভারতও নিজের ফুটবলারদের উপরেই বেশি জোর দিচ্ছে। ফলে এই মডেলের সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপও নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না। পালটা আঘাত তারাও দেবে। সব মিলিয়ে সৌদি আরবের ফুটবল ও ইউরোপীয় ফুটবলের গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যায়, তার দিকে সবার তীক্ষ্ণ নজর থাকবে।