জোশীমঠ নিয়ে মিডিয়াকে কোনও তথ্য না! কোন রহস্য ধামাচাপা দিতে চাইছে সরকার?

Joshimath Disaster: ইসরো থেকে প্রাপ্ত একটি জোশীমঠ সংক্রান্ত উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে গত ৭ মাসে প্রায় চার ইঞ্চি বা ৯০ মিলিমিটার বসে গেছে জোশীমঠ।

জোশীমঠে ধ্বস! জটায়ুর কোনও রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের উপন্যাস নয়। অত্যন্ত কঠোর বাস্তব। হাড় হিম করা এই খবরে যদি আমাদের সম্বিৎ না ফেরে এখনও, তাহলে আর কোনও কিছুতেই কি ফিরবে, সেই প্রশ্ন এখন বেশ কিছু মানুষের মুখে ঘুরছে। সাম্প্রতিক সময়ে, হিমালয়ের এই শৈল শহর জোশীমঠ যে প্রতিদিন তিল তিল করে ডুবছে, সেই খবর পাওয়া যাচ্ছিলই কিন্তু উত্তরাখণ্ডের, চামোলি জেলার ২৫ হাজার মানুষের আবাস যে শহরে তা যে ভয়ানক বিপদের মধ্যে আছে প্রশাসনও কি বুঝতে পারেনি? সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২৫০০ বাড়ির মধ্যে ৬৭০টি বাড়িতে ফাটল দেখা গেছে। সেখানকার সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সমস্ত বিপজ্জনক বাড়িকে ভেঙে ফেলা হবে এবং প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে দেড় লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। বাসিন্দারা স্বাভাবিকভাবেই সরকারের এই সিদ্ধান্তে অখুশি। বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ প্রদর্শনও হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি বলেছেন, উত্তরাখণ্ডের সমস্ত শহর এবং আধা শহরগুলোর মাটির ‘ধারণ ক্ষমতা’র পরীক্ষা করানো হবে। যদি দেখা যায়, কোনও উন্নয়নমূলক কাজ, সেই ‘ধারণ ক্ষমতা’র সীমা অতিক্রম করছে, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে তা বন্ধ করিয়ে দেওয়া হবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই সংক্রান্ত মামলাও হয়েছে। সেই মামলায় জোশীমঠের এই ধ্বস, বাড়ির ফাটল এবং শহর বসে যাওয়ার বিষয়টিকে যাতে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় এবং পুরো বিষয়টিকে যাতে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ ঘোষণা করা হয় সেই আবেদনও করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- নিরাপদ নয় দার্জিলিংও! কীভাবে জোশীমঠের মতোই তলিয়ে যাওয়ার পথে পাহাড়ের রানি?

জোশীমঠের ঘটনা এবং তার পরবর্তীতে যা যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত চেনা ছবি এবং তা শুধুমাত্র হিমালয়ের এই শৈল শহরে সীমাবদ্ধ থাকবে এমনটা ভাবা ভুল। খুব বেশিদিন নেই, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় দার্জিলিং থেকেও এই ধরনের খবর আসতে পারে। বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ভূতত্ত্ববিদ
এবং সচেতন মানুষজন জোশীমঠ নিয়ে সাবধান করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, এইরকম ঘটনা ঘটতেই পারে। তারপর একদিন সকালে উঠে সেখানকার বাসিন্দারা দেখতে পান, তাঁদের আস্ত শহরটা বসে গেছে। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, তাদেরকে দ্রুত তাঁদের বাসস্থান থেকে সরে যেতে বলা হয়। জোশীমঠে যা ঘটছে, ১৯৭০ সালের একটি সরকারি রিপোর্টেই এই সংক্রান্ত সাবধানবাণী করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই অঞ্চলে কোনও ভারী নির্মাণকাজ করা যাবে না কিন্তু সমস্ত রাজনৈতিক দলই বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে তথাকথিত উন্নয়নের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। তাই আবারও সেই পুরনো উন্নয়ন বনাম পরিবেশের বিতর্ক উঠে আসছে। কোনও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই কি উন্নয়নের বিরোধিতা করবে? আবার উন্নয়ন মানেই পরিবেশের ক্ষতি, মাটির ক্ষতি। তাহলে সেই উন্নয়নকে কি প্রশ্ন করা উচিৎ নয়?

সমস্যাটা শুধুমাত্র এই উন্নয়ন বনাম পরিবেশের বিতর্কে আটকে নেই। জোশীমঠের এই ঘটনার পরবর্তীতে, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জোশীমঠ সংক্রান্ত যে কোনও সংবাদ পরিবেশন করার আগে কোনও সংবাদ মাধ্যম যেন কেন্দ্রীয় বা উত্তরাখণ্ডের রাজ্য সরকারের অনুমতি নেয়। এই অনুমতি সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। এমনকী সামাজিক মাধ্যমেও কোনও ছবি বা খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমস্ত সরকারি সংস্থাকে বলা হয়েছে, তাঁরা যেন সংবাদমাধ্যমের কাছে এই বিষয়ে কোনও তথ্য না দেন। উত্তরাখণ্ডের অন্তত ১২ টি সরকারি সংস্থা এবং বিজ্ঞান সংগঠনগুলোকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে এই মুহূর্তে যেহেতু জোশীমঠের অবস্থা ভালো নয়, তাই এই সংক্রান্ত যে কোনও খবরই শুধুমাত্র সেখানকার আঞ্চলিক বাসিন্দাদেরই বিভ্রান্ত করবে না, সারা দেশের সমস্ত মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।

ইসরো থেকে প্রাপ্ত একটি জোশীমঠ সংক্রান্ত উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে গত ৭ মাসে প্রায় চার ইঞ্চি বা ৯০ মিলিমিটার বসে গেছে জোশীমঠ। ২৭ ডিসেম্বর থেকে সাম্প্রতিক কাল অবধি এই বসে যাওয়ার পরিমাণ প্রায় ২ ইঞ্চি বা ৫০ মিলিমিটার। সামাজিক মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুত এই তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। তা দেখেই সরকারের মনে হয় এইরকম আরও কিছু রিপোর্ট বা ছবি যদি আসতে থাকে তাহলে এটাও প্রকাশ্যে আসবে যে স্থানীয় সরকার আগে এই বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। অর্থাৎ, সরকারের বিপদ হতে পারে।

আরও পড়ুন- একা জোশীমঠ নয়, তলিয়ে যেতে চলেছে হিমালয়ের এই বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্রগুলিও!

এই ধরনের বিপর্যয় এবং জনসুরক্ষা সংক্রান্ত বিপদকে কি এইভাবে মোকাবিলা করতে হয়? আধুনিক বিপর্যয় মোকাবিলা সংক্রান্ত নিয়ম বলে, এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটলে মানুষের কাছে আরও বেশি করে তথ্য পৌঁছতে হয়। দেখা গেছে, যত বেশি সঠিক তথ্য পরিবেশন করা হবে সরকারের তরফে, ভুল তথ্যের আদানপ্রদান যত কম হবে, তত মানুষ কম আতঙ্কিত হবেন, তত বেশি সরকারের প্রতি ভরসা বাড়বে এবং বিপর্যয় মোকাবিলা সহজ হবে। প্রথম দিনের পরে, আরও বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা গেছে। কিন্তু যেহেতু খবর আদানপ্রদানে বিধিনিষেধ আরোপিত, তাই শুধু জোশীমঠ নয়, আশেপাশের অঞ্চলেও গুজব ছড়িয়েছে। যদিও উত্তরাখণ্ড সরকারের যুক্তি, মানুষ যাতে আতঙ্কিত না হন, তাই তাঁরা এই পদ্ধতি নিয়েছেন। এই হোয়াটসঅ্যাপের বিশ্বে যে কোনও গুজবেই মানুষ আতঙ্কিত হন! তাহলে? সরকারের তরফে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করা হচ্ছে, ততদিন এই নিয়ম বলবৎ থাকবে। কিন্তু ভুল তথ্য তো আর পুর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ হওয়া অবধি অপেক্ষা করবে না, সে তো আকাশে বাতাসে মোবাইল মারফৎ ঘুরে বেড়াবেই। এমনকী কখনও কখনও ভুল তথ্যগুলোকেই সত্যি মনে হতে পারে। তখন সরকারি পুর্ণাঙ্গ রিপোর্টই হয়তো প্রশ্নের মুখে পড়বে। সরকারই মিথ্যে তথ্য ছড়াচ্ছে এই প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক!

বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ সংবাদ মাধ্যমের এই কণ্ঠরোধকে অবিলম্বে তুলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, ইসরোর এই উপগ্রহ চিত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশে বিদেশেও ছড়িয়েছে, তাহলে শুধু দেশের সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? কোভিডের সময়েও এই ধরনের আইন বলবৎ ছিল এবং তখনও দেখা গিয়েছিল চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক কিছু ধ্যানধারণা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়েছে, তাতে সমস্যা বেড়েছে। এই ধরনের কাজে হয়তো সরকার আত্মতুষ্ট থাকতে পারে এই ভেবে যে তারা এই বিপর্যয় খুব ভালো ভাবে মোকাবিলা করেছে। কিন্তু শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায়? উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে হয়তো ভাবা যেতে পারে সব কিছু ঠিক আছে, সরকারের ভাষায়, ‘সব চাঙ্গা সি’! জোশীমঠে বা হিমালয়ের এই ধরনের শৈল শহরগুলোতে আজ যা চার ইঞ্চির ধ্বস কাল তা দ্বিগুণ হয়ে যেতেই পারে। নরেন্দ্র মোদি সব সামলে নেবেন বলে যে প্রচার করা হয় বাস্তবে কি তাই হবে? অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকবে?

 

More Articles