‘তেহরানের কসাই’! কেন রইসির মৃত্যুতে আতসবাজি ফাটছে ইরানে?
Ebrahim Raisi: তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া ইরানে, কিন্তু এ ছবি ইরানের একটা অংশের। অন্য যে অংশ কম আলোকিত, সেখানে ইব্রাহিম রইসির বিমান ভেঙে পড়তেই জ্বলেছে আতসবাজি।
হঠাৎ করেই বিমান দুর্ঘটনায় প্রয়াত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি। এমন একটা সময় তাঁকে ময়দান ছাড়তে হল, যে সময় ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধের জেরে গোটা বিশ্বের প্রচারের আলো ছিল তাঁর মুখে। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া ইরানে, জারি অস্থিরতাও। কিন্তু এ ছবি ইরানের একটা অংশের। অন্য যে অংশ কম আলোকিত, সেখানে ইব্রাহিম রইসির বিমান ভেঙে পড়তেই জ্বলেছে আতসবাজি। পর্দার আড়ালে উল্লাস-উদযাপনে মেতে উঠেছেন তাঁরা। তাঁদের কাছে রইসি একজন স্বৈরাচারী অত্যাচারী শাসক মাত্র। তাঁদের কাছে রইসি 'তেহরানের কসাই'।
যে কোনও রাজা বা শাসকের কাজ প্রজাপালন। এ কথা শুধু রাজতন্ত্রেই নয়, গণতন্ত্রেও সত্য। গণতান্ত্রিক ভাবে শাসক নির্বাচিত করার পরেও সে কীভাবে গণতন্ত্রেরই শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, সে সত্য বারবার দেখেছে ইতিহাস। ইব্রাহিম রইসি প্রবল ক্ষমতাবান। ইজরায়েলের মতো শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে ভয় পান না একরত্তি। আমেরিকার সঙ্গেও তেমন সদ্ভাব ছিল না ইরানের। এই সমস্ত কূটনৈতিক সমস্যাকে সামনে রেখেই নিজের দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল বানাতে একাধিক পদক্ষেপ করেছেন তিনি। তার পরেও তাঁর প্রতি কেন এত ক্ষোভ দেশবাসীর একাংশের। কেন রইসির নিজের দেশে পরিচয় 'তেহরানের কসাই' নামে।
আরও পড়ুন: নিছকই দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র! ইরানের প্রেসিডেন্ট রইসির মৃত্যুতে কার লাভ, কার ক্ষতি?
তাঁদের মহান নেতাকে হারিয়ে ইরানের মানুষ তাবরিজ, মাশহাদ, তেহরান-সহ একাধিক শহরে কালো পোশাকে 'মাতম' করছেন— রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইরানের সংবাদমাধ্যম বাইরের দুনিয়ার কাছে ইরানের সেই ছবিটাই তুলে ধরছে মুহুর্মুহু। তার আড়ালের আসল ছবিটা কার্যত আড়ালেই থেকে যাচ্ছে, যা তুলে আনে একজন রক্ষণশীল, কট্টরপন্থী নেতাকে, যাঁর হাতে লেগে রয়েছে গণহত্যার রক্তও। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেইয়ের উত্তরসূরী হতে চলেছেন ভবিষ্যতে তিনিই, এমন একটা গুঞ্জন ছিল দেশ জুড়ে। খামেনেইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার দৌলতেই একদিন রইসি ইরানের সিংহাসনের দখল পেয়েছিলেন। ২০২১ সালে হাসান রুহানিকে সরিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে বসেন রইসি। রুহানি তুলনামূলক ভাবে কম কট্টরপন্থী নেতা ছিলেন। আমেরিকা, জার্মানির সঙ্গে সমঝোতাকারীদের মধ্যেও অন্যতম ছিলেন রুহানি। কিন্তু রইসি ছিলেন তাঁর তুলনায় অনেক বেশি কঠিন, কঠোর। তাঁর আমলেই ইরানে চরমে উঠেছিল হিজাব-বিরোধী আন্দোলন। আমেরিকাদের পিছনে ফেলে রাশিয়ার সঙ্গে সুসসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারেও রইসিকে অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে।
ইব্রাহিম রইসির জন্ম ইরানের উত্তরপূর্বাঞ্চলের শহর মাশহাদে, ১৯৬০ সালে। জায়গাটি ইরানের শিয়া মুসলিমদের পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। তাঁর বাবা ছিলেন ধর্মীয় নেতা। বাবার মৃত্যুর পর ৫ বছর বয়সে শহর ছেড়ে চলে যান কুমে। ততদিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনেই সেসময় ফ্রান্সের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ফিরে এসেছেন ইরানে। দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে ইসলামি বিপ্লব। কুমে শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় ইসলামি বিপ্লবে অংশ নিলেন রইসি। ১৯৭৯ সালে ইরানে শাহ রাজশাসনের শেষ হল সেই বিপ্লবের মাধ্যমেই। খামেনেইয়ের হাতেই পতন ঘটল ইরানের এই একচ্ছত্র শাসক রাজবংশের। ততদিনে খামেনেইয়ের চোখে পড়ে গিয়েছেন রইসি। ১৯৮১ সাল নাগাদ রইসি যোগ দিলেন বিচারবিভাগে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে নিযুক্ত হলেন তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর হিসেবে। এর পর তাঁর ইতিহাস জুড়ে শুধুই উত্থান। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উপপ্রধান বিচারপতি, ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন রইসি।
২০২১ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন রইসি। এর আগে অবশ্য ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি। তবে সেবার তিনি হেরে যান প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কাছে। এরই মধ্যে ১৯৮৮ সালে রইসির হাত ভেজে হাজার হাজার যুদ্ধবন্দির রক্তে। ইরানের ইতিহাসে সে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ইরানে সেই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। সরকার বিরোধী পিপলস মুজাহিদিন অফ ইরানের সমর্থক রাজনৈতিক বন্দি যাঁরা, তাঁদের নির্বিচারে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে। বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন ফিদায়েঁ এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইরানের সমর্থকদেরও নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় বলে সামনে আসে। রাজতন্ত্র হঠিয়ে ইরানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পিপলস মুজাহিদিন অফ ইরানের। পরবর্তীকালের শাসনব্যবস্থায় মৌলানা, আলেমদের প্রভাবের বিরুদ্ধে সরব হয় তারাই। ধর্মীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে দেশে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, নারীবাদ এবং শ্রেণিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করে। তাতেই একদা বন্ধু খামেইনি, মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে চটে যান এবং তার ফলস্বরূপই গণহত্যা চালানো হয় বলে অভিযোগ। সে সময় ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের পর খামেইনির নির্দেশে যে চার সদস্যের বিশেষ কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার সদস্য ছিলেন ইব্রাহিম। বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকদের হত্যা এবং দেশজুড়ে ব্যাপক গণহত্যায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলেই অভিযোগ ওঠে। সেই সময় ওই কমিশনকে ‘মৃত্যুর দূত’ বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৯ সালে আমেরিকার ট্রেজারি বিভাগের তরফে ইরানের যে সরকারি আধিকারিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তাতে শামিল ছিল রইসির নাম।
২০২১ সালে রুহানিকে পরাজিত করে রইসি যখন ইরানের তখত দখল করেন, তখন গোটা বিশ্বের কূটনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়, রইসির আমলে আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও তলানিতে ঠেকবে। সার্বিক ভাবে তাঁর সময়ে আমেরিকার সময়ে কূটনৈতিক বন্ধুত্ব বেড়েছে এমন নজির দেখা যায়নি। তবে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ আরও ভালোর দিকে গিয়েছে রইসির তৎপরতায়। গোড়া থেকেই নিজেকে ইসলামের প্রবর্তম মহম্মদের বংশধর বলে দাবি করে এসেছেন রইসি, যে কারণে মাথায় কালো পাগড়িও পরতেন তিনি। খামেনেইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী যে রইসিই, এ কথা একরকম নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনায় জল ঢালল কপ্টার দুর্ঘটনা। বরং খামেনেই-পুত্র মুজতবার সামনে খুলে গেল ভাগ্যের দরজা। তাঁর পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার পথে একমাত্র বাধা ছিলেন রইসিই।
গণহত্যায় অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে বারবার নারী স্বাধীনতা হরণ, একাধিক অভিযোগের তির বারবার উঠেছে খামেনেইয়ের বিরুদ্ধে। কখনও সমকামিতাকে বর্বরতা বলে আখ্যা দিয়েছেন, তো কখনও তার শাসনে ইরান ফেটে পড়েছে গণবিক্ষোভে। ২০২২ সালে পুলিশী হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ক্ষেপে উঠেছিল ইরান। জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভ হয়। সে সময় ইরানের বিক্ষোভ কমাতে বহু কট্টরপন্থী সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গিয়েছিল রইসিকে। সেই ইরানের সঙ্গে যখন ইজরায়েলের সংঘাত গড়াল, সে সময় ইজরায়েলে হামলার মাধ্যমে আরও বেশি করে প্রচারের আলোয় যেন উঠে এলেন রইসি। গাজা শহরকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া ইজরায়েলের প্রতিস্পর্ধার জবাব দেওয়ার সাহস রাখা রইসির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়ার মতো একাধিক দেশ। এমনকী আমেরিকাও ইজরায়েলকে ইরানে বড় হামলা চালাতে বাধা দিয়েছিল।
সেই যুদ্ধই কি কাল হল রইসির? গত ১৯ মে আজারবাইজানের পার্বত্য এলাকায় ধাক্কা লেগে ভেঙে পড়ে রইসির কপ্তার। অনেকেই মনে করছেন, রইসির কপ্টার দুর্ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। তবে এ-ও শোনা যাচ্ছে, মোসাদ সাধারণত সাড়া জাগানো উপায়ে শত্রুদেশের উপর আঘাত হানতে অভ্যস্ত নয়। তাদের হামলা চলে অনেক বেশি গোপন, অনেক বেশি সন্তর্পণে। তবে রইসির যে শত্রু তাঁর দেশেও কম এ কথা বলা যায় না। রইসির পর প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন তাঁর আমাত্যদেরই অনেকে। রয়েছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মোখবর। যিনি রইসির অবর্তমানে ইরানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ইরানীয় সংবিধান অনুযায়ী, দেশের প্রেসিডেন্টের হঠাৎ মৃত্যু হলে আগামী পঞ্চাশ দিনের মধ্যে ফের ভোট করিয়ে প্রেসিডেন্ট স্থির করতে হবে। আর সেই ভোট করানোর দায়িত্ব বর্তায় ইরানের তিন সদস্যের কাউন্সিলের। যেখানে মোখবর তো রয়েইছেন, সঙ্গে রয়েছেন দেশের পার্লামেন্টের স্পিকার মহম্মদ বকর কালিবাফ ও দেশের বিচারব্য়বস্থার প্রধান গোলাম হোসেন মোগসেনি এঝেই।
আরও পড়ুন: নাকে আসছে পচা মাছের গন্ধ! ইরানে শ’য়ে শ’য়ে স্কুলছাত্রীকে বিষপ্রয়োগ করছে সরকার?
মোখবর দীর্ঘদিন ধরেই প্রেসিডেন্ট হতে চান। ২০২১ সালে রইসি প্রেসিডেন্ট হলে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদে বসেছিলেন মোখবর। খামেনেই ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত রয়েছে তাঁরও।ইরানের রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ফলে তাঁর সিংহাসনে বসার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রেসিডেন্ট হতে চান স্পিকার মহম্মদ বকর কালিবাফও। তবে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ রয়েছে বলেই কানাঘুষো শোনা যায়। রইসির মৃত্যুতে ইরানে একযোগে লাভবান হয়েছেন অনেকেই। ফলে তাঁর মৃত্যুর নেপথ্যে ইরানের অন্দরের রাজনীতির হাত থাকতে পারে না, এমন আশঙ্কা বোধহয় উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ইরানের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশও যে রইসির মতো নেতাকে দেশের শীর্ষপদে চাইত না, তা পরিষ্কার ওই আতসবাজির রশনাই আর উল্লাসেই। মনে মনে তাঁরা এই দিনটার অপেক্ষা করেছেন, কবে 'তেহরানের কসাই'-এর হাত থেকে মুক্ত হবে ইরান। সে ঘটনাও ঘটল। যা ইরানকে ঠেলে দিল রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে। আর সেই সুযোগটা নিয়েই শত্রু দেশরা ঢুকে পড়বে না তো ইরানের টালমাটাল রাজনীতিতে? কারণ এই বছর দু'য়েকের শাসনকালে কম শত্রু তো আর তৈরি করেননি ইব্রাহিম রইসি!