কেন চটলেন ইন্দিরা গান্ধী! কেন ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিশোরের গান?

Kishore Kumar : ইন্দিরা গান্ধির প্রস্তাবে ‘না’ করার সাহস দেখিয়েছিলেন কিশোর কুমার, জবাবে যে চরম আঘাত নেমে এল শিল্পীর কেরিয়ারে...

রাজনীতিতে মুখ খোঁজার তাগিদ কেবল আজকের নয়। ভারতে এ ঘটনা অনেক আগে থেকেই ঘটিয়ে এসেছে রাজনৈতিক দলগুলি। তাছাড়া এই রাজনীতির যুদ্ধে ‘কৌশল’ নামক বস্তুটিই তো মোড় ঘোরাতে ওস্তাদ, সে কথা অবশ্য কম বেশি সকলেই জানে। জেনে শুনেও সেই কৌশলের জালে কখন যে জড়িয়ে পড়তে হয়, তা ঠাহর করা যায় না। আর মানুষের আবেগ নিয়ে খেলতে নামলে আগে থেকেই খেলাটা খানিক সহজ হয়ে যায় আরকি। তাই পরিচিত মুখকে ভোটের প্রচারে সামনে রাখতে পারলেই তো কেলাফতে!

সময়টা ১৯৭৬ সাল। কংগ্রেস তখন দিল্লির মসনদে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। দেশজুড়ে চলছে ‘এমার্জেন্সি’। আজকের দিনে যেমন সিনেমা অথবা গানের জগতের পরিচিত কোনও মুখকে রাজনীতিতে এনে ফাটকা ফায়দা তোলা হয়, তেমনটা সে যুগেও করতে চেয়েছিল কংগ্রেস। খোদ ইন্দিরা গান্ধির যে তাতে সিংহভাগ সায় ছিল তাও আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কংগ্রেস চেয়েছিল তাদের সরকারি প্রকল্পের প্রচারে এমন এক কন্ঠ, যা সহজেই ছুঁয়ে যাবে সাধারণ মানুষের মন। মানুষের আবেগকেই প্রধান অস্ত্র বানাতে চেয়েছিল শাসক দল। আর সেই সূত্রেই মাথায় আসে সঞ্জয় গান্ধির খুব ভাল বন্ধু কিশোর কুমারের নাম।

দেশের মানুষের আবেগ নিয়ে এমন ছেলেখেলা কি সত্যিই মেনে নেওয়ার পাত্র কিশোর কুমারের মতো স্বাধীনচেতা এক শিল্পী? কিশোর নিজে সেটা কিছুতেই চাননি। মুখের ওপর সরাসরি ‘না’ করে দেন। তিনি কি সত্যিই জানতেন না এতে তাঁর কেরিয়ারে ক্ষতি হতে পারে? সব জেনেও ইন্দিরা গান্ধি নেই নজরে থাকার জন্য এই পথ বেছে নেননি তিনি। তিনি চেয়েছেন কেবল বাংলার মানুষের আবেগটুকুতেই মিশে থাকতে, রাজনীতির ঘোলা জলে মিশে গেলে যে আদতে তাতেই দাগ পড়বে এমনটা হয়তো তিনি ভালোই বুঝেছিলেন।

আরও পড়ুন - “মুঝে জিন্দা রেহনা হ্যায়,” অসুস্থ মধুবালাকে যেভাবে একা ফেলে গিয়েছিলেন কিশোর কুমার

কিশোর কুমার, নামটাই কাফি। আদ্যোপান্ত ছটফটে দস্যি ছেলে, মাথা ভর্তি কুঁচকানো চুল আর গলায় খেলা করে উদাত্ত সুর, স্বর্ণযুগের ইতিহাসে কিশোর মানেই ছিল বাঙালির অন্যরকম উন্মাদনা। শুধু সেখল বলে নয় আজও কিশোর প্রেমে মজে আছে গোটা বাংলা। শুধু বাংলা গান নয়, হিন্দি গানের জগতে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। যদিও কেরিয়ারের শুরুটা মোটেই গায়ক হিসেবে হয়নি তাঁর। দাদার দেখানো পথে নায়ক হতেই চেয়েছিলেন দামাল কিশোর। তবে নায়ক হওয়ার চেষ্টা কি আর গায়ক সত্বাকে চাপা দিয়ে রাখতে পারে? তেমনটা তো সম্ভবও ছিল না। তাই নায়ক হওয়ার আগেই গায়ক হিসেবে নিজের পরিচিতি তৈরি করলেন সহজেই।

‘কিশোর কুমার’ নামটা অবশ্য তাঁর পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। কাজের দৌলতেই এই নাম। আসল নাম ছিল আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯২৯ সালের ৪ অগাস্ট মধ্যপ্রদেশের এক বাঙালি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন কিশোর কুমার। চার ভাই বোনের মধ্যেই তিনিই ছিলেন কনিষ্ঠ। সেই সময়ের চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাস ঘনটলে ভাগলপুরের এই বাঙালি গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের নাম বারবার উঠে আসে।

পরিবারেরই বড় ছেলে কুমুদলাল। সকলের প্রিয় দাদামণি সিনেমা জগতে এসে কুমুদলাল নাম পাল্টে হয়ে যান অশোক কুমার। তাঁর অভিনয় মানেই পর্দায় এক পিতৃসম উপস্থিতি। দাদামনিই ছিল কিশোরের আইডল। শুধু কিশোর কুমার নিয়ে, মেজদা অনুপ কুমারেরও অভিনয় জীবনের শুরুটা হয়েছিল এই অশোক কুমারের দেখানো পথেই। ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয়ও করেছিলেন তিন ভাই, যে ছবি গানে-অভিনয়ে আজও আইকনিক। পরবর্তীতে বম্বে টকিজ ছবিতে দাদা অশোক কুমেরের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন। সেই সময়ে নিজের কিশোর নামটাই ব্যবহার করেছিলেন তিনি। পরে সেই নামটাই থেকে যায়। বাংলা, হিন্দি, ভোজপুরি, অসমিয়া-সহ মোট ২০০০-এরও বেশি গান গেয়েছেন কিশোর কুমার। পেয়েছেন মোট ৮ বার ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। তাঁর গানে লিপ দিয়েছেন অমিতাভ বচ্চন, উত্তম কুমার, রাজেশ খান্না, সঞ্জীব কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-সহ প্রভূত বিশিষ্ট শিল্পীরা। শচীন দেববর্মন, রাহুল দেববর্মন, গুলজার, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ আরও বহু সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।

তখন একের পর এক হিট গান কিশোরের কণ্ঠে, মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে কিশোর কুমার। “এক পলকের একটু দেখা”, “এ আমার গুরুদক্ষিণা”, “একদিন পাখী উড়ে যাবে যে আকাশে”, “হাওয়া মেঘ সরায়ে”, “কি আশায় বাঁধি খেলাঘর”, “সেই রাতে রাত ছিলো পূর্ণিমা” ইত্যাদি কত কত দূর আজও মোহ তৈরি করে বাঙালির মনে। আর সে যুগে ঠিক এই মোহটাকেই হাতিয়ার করতে চেয়েছিল তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বরা। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধি বারবার কিশোরের কাছে প্রস্তাব পাঠালেও কিশোরের সাফ উত্তর “না”।

আরও পড়ুন - ডুবন্ত সুরাইয়াকে বাঁচিয়েছিলেন তিনিই, তবু দেব আনন্দকে খুন করতে চেয়েছিল পরিবার…

যুব কংগ্রেসের পদযাত্রায় তো হাঁটলেনই না এমনকী এরপর যখন তাঁর কাছে ফের তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বিদ্যা চরণ শুক্লা কংগ্রেসের পক্ষে ২০ দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রচারের প্রস্তাব নিয়ে এলেন তখনও তিনি নিজের জায়গায় অনড় রইলেন। আসলে বলিউড থেকে টলিউড সাধারণ জনতার হৃদয়ের মণিকোঠায় তখন রাজ করছে কিশোর কুমার। তাই তিনি দলের মুখ হলে ভোটের সংখ্যাটাও যে বাড়বে নিশ্চিত। সে সময়ের শীর্ষ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাই এই কর্মসূচি উপলক্ষে নির্মিতব্য বিজ্ঞাপনচিত্রের গানটি গাইবার প্রস্তাব পান কিশোর। কিন্তু কিশোর ফের নাকচ করে দিলেন।

এদিকে এই খবর কংগ্রেস নেতৃত্বের কানে পৌঁছতেই কিশোর কুমারের উপর বড় কোপ নেমে এল। অবশ্য এ বিষয়ে আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন কিশোর কুমার নিজেই। অল ইন্ডিয়া রেডিও ও দূরদর্শনে তাঁর সব গান ‘ব্যান’ করে দেওয়া হল তড়িঘড়ি। এমনকী আগে থেকে রেকর্ড করে রাখা গান প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। ১৯৭৬ সালের ৪ মে থেকে ‘এমার্জেন্সি’র শেষ দিন পর্যন্ত বহাল ছিল এই ‘শাস্তি’। কিন্তু কিশোর কুমার তো একজন প্রকৃত শিল্পী তিনি তাই হল উঁচিয়ে বলতে পেরেছিলেন তিনি অন্যের তাবেদারি করবেন না কিছুতেই, তিনি নিজের ইচ্ছে গান গান, তাই গাইবেন আজীবন। আর তাছাড়া এতকিছুর পরও কিশোরের ভরসা ছিল বাংলার মানুষের ওপর। তিনি জানতেন কিছু সময়ের ব্যবধান কিছুতেই তাঁকে মুছে দিতে পারবে না বাংলার হৃদয় থেকে। হলও ঠিক তাই। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে এই নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর যখন পুনরায় দূরদর্শনে দেখা যায় দুরন্ত পারফরমার কিশোরকে, আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হয় তার গান, তখনও একই রকম উন্মাদনা ছিল দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে। বরং বলা ভালো মাঝের এই অপেক্ষাটাই কিংবদন্তি শিল্পীর দর ছিনিয়ে দিয়েছিল প্রকৃত অর্থে। 

More Articles