হাসপাতালে হাসপাতালে সিন্ডিকেট রাজ, কাকে কেন আড়াল করছে প্রশাসন?

RG Kar Hospital Incident: এই অপরাধ প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসছে উত্তরবঙ্গ লবির নাম। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে, এমনকী স্বাস্থ্যদফতর, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রায় প্রতিটা স্তরেই এই লবির কথা কান পাতলেই শোনা যাবে।

আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় নষ্ট করা হয়েছে ক্রাইম সিন। সে কথা বারবার বলছে সিবিআই, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্টও। তবে এটা বাস্তব কথা। যেদিন এই ঘটনাটি ঘটেছিল, সবার আগে এই ঘটনা মিডিয়ার সামনে যিনি নিয়ে এসেছিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর নাম মানস গুমটা। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সেদিন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নশ্বর দেহ নিয়ে শেষযাত্রা যাচ্ছিল এনআরএসের পথে। তার মাঝখানেই আরজি কর থেকে এই ভয়ঙ্কর ঘটনার খবর আসে। প্রথম থেকেই সেসব খবরের মধ্যে থেকে মনে হচ্ছিল, কী যেন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। চেষ্টা চলছে প্রমাণ লোপাটের। সেই ক্ষোভ, রাগের জায়গা থেকেই প্রতিবাদ হিসেবে একটি ভিডিও করেছিলাম, যা পরে মিডিয়াকে দিই। পরবর্তীতে সামনে এসেছে সেই ভিডিও, যা থেকে এটুকু জলের মতোই পরিষ্কার যে এই ঘটনায় রহস্য রয়েছে। ঘটনার পরের দিনই দেখা গেল ক্রাইম স্পটের উল্টোদিকের ঘর ভাঙা হল। সেই ঘটনায় কোথাও না কোথাও পিডব্লিউডি যুক্ত ছিল ঠিকই। কিন্তু তাঁদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল প্রিন্সিপ্যাল ঘনিষ্ঠ স্বাস্থ্য দফতরের কয়েক জন আধিকারিক।

আমরা বারবার প্রত্যাশা করেছিলাম, প্লেস অব অকারেন্স সিল করে দেওয়া হবে। এমন একটা অপরাধ যেখানে হয়েছে, সেই জায়গাটা তো সিল হয়ে দেওয়াটাই দস্তুর। আমাদের কাছে খবর আসে, ঘটনাস্থলে সে সময়ে বহু মানুষ গিয়েছেন। তবে তাঁদের পরিচয় কী? কেন তাঁরা সেখানে গিয়েছেন? তা তখনও মানুষের কাছে পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু সত্য শেষমেশ চাপা থাকে না, দুর্বৃত্তরা কখনওই ছাড়া পাবে না। সেদিনকার ভিডিও শেষপর্যন্ত মানুষের সামনে এসেছে। ফলে প্রথম দিন থেকে আমরা যা বলছিলাম, তা যে মিথ নয়, তা প্রমাণিত। প্রথম থেকেই যে সরকার, স্বাস্থ্য প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন যাঁরা এই ঘটনায় যুক্ত, তাঁদের আড়াল করার চেষ্টা করে এসেছে কোনও না কোনও ভাবে। এই অপরাধ আদৌ একা করা সম্ভব কি সম্ভব নয়, তা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু পরোক্ষভাবে যারা এই ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করল, তারা কবে এই বিচারের গণ্ডির মধ্যে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে অবশ্যই।

আরও পড়ুন: আরজি কর ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডে কি পিতৃতন্ত্রকেই বাঁচাতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট?

তথাকথিত ওই প্রাক্তন প্রিন্সিপাল, সত্যি কথা বলতে যাঁকে আজকাল ডাক্তার বলতেও অস্বস্তি হয় আমাদের, তিনি দিন দুয়েক পরে নাটক করে পদত্য়াগ করলেন। তাঁর রেজিগনেশনের অর্ডার কোথায় আছে কেউ বলতে পারবেন? কার কাছে, কোথায় তিনি সেটা জমা দিয়েছেন? তার হদিশ নেই। সার্ভিস রুল অনুযায়ী, তাঁর পে-বিল কি তবে আরজি করেই তৈরি হবে? কারণ তিনি তো ন্যাশনাল মেডিক্যালে যোগদান করতে পারেননি। তাহলে এই মুহূর্তে তাঁর চাকরির স্ট্য়াটাস কোথায় রয়েছে? তাঁর সার্ভিস বুক-ই বা কোথায় রয়েছে? পে-বিল কোথায় তৈরি হচ্ছে সন্দীপ ঘোষের? আরজি করে নাকি ন্যাশনাল মেডিক্যালে নাকি স্বাস্থ্য দফতরেই তৈরি হচ্ছে তা? আর তা যদি হয়ে থাকে, স্বাস্থ্যদফতরের উচিত সার্ভিস রুল মেনে তাঁর সেই স্ট্যাটাস প্রকাশ্যে আনা। রেজিগনেশন যেমন এক মাসের নোটিস ছাড়া দেওয়া যায় না, তেমনই একটা লোক কোর্টের অর্ডারে ছুটি নিয়ে বসে আছে, তাঁর এই মুহূর্তে কী স্ট্য়াটাস, তা তো স্বাস্থ্য়দফতরেরই উচিত সকলকে জানানো।

কার্যত সমস্ত জায়গাতে এটা পরিষ্কার, অপরাধকে ঢাকা দেওয়ার জন্য যারা এগিয়ে এসেছে, সেখানে অবধারিত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে নর্থ বেঙ্গল লবির নাম। কেন সেই নর্থ বেঙ্গল লবির মাথারা ক্রাইমের এপিসেন্টারে চলে গিয়েছিলেন? সেই জবাব তাঁদের দিতেই হবে। সিবিআই তদন্ত করছে, আশা রাখব, তাঁরা তাঁদের কাজ করবেন। মানুষের ক্ষোভ প্রশমন করতে হলে, এই অপরাধের কিনারা করতে হলে এই লোকগুলিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন রয়েছে তদন্তকারীদের, তেমনটাই মনে হয়। এই প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করছে যাঁরা, অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যারা, তারা যেন কোনও ভাবে এই বিচারের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এই অপরাধ প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসছে উত্তরবঙ্গ লবির নাম। আমাদের চিকিৎসক মহলে, শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও, এমনকী স্বাস্থ্যদফতর, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রায় প্রতিটা স্তরেই এই লবির কথা কান পাতলেই শুনতে পাবেন। সাম্প্রতিক কালে সেই লবির মাধ্যমে চূড়ান্ত ক্ষমতাপ্রদর্শন বা ক্ষমতার অপব্যবহার হতে দেখেছি। এই লবির হস্তক্ষেপ বিপজ্জনক জারি রয়েছে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পদোন্নতি, নিয়োগ বা বদলি থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ক্ষমতাতে যাঁরা ছিলেন, যাঁরা আদতে শাসকদল ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত, তাঁরা পর্যন্ত লালবাজারকে অভিযোগ জানিয়েছিল এই উত্তরবঙ্গ লবির সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। উত্তরবঙ্গ লবির যে চার-পাঁচ জন সদস্যের নাম বারবার উঠে আসছে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি, আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ এনে এফআইআর দায়ের করেছিল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই এফআইআর সত্ত্বেও তাঁদের টিকিটিও বাঁকা করা যায়নি, বরং তারা বহাল তবিয়তেই কাজ করে যাচ্ছে। সন্দীপ ঘোষকে অনেকেই এই লবির বোড়ে বলে মনে করছেন। আদতে তা সত্য নয়, বরং ওই লবিরই একজন সদস্য বলা যায় তাঁকে। প্রশাসনিক পদে ছিলেন বলে তেমন ভাবে প্রকাশ্যে আসতেন না শুধু। বরং আরজি করের মধ্যে একটি সিন্ডিকেট রাজ কীভাবে তৈরি করা যায়, সেই কাজে সদাসক্রিয় ছিলেন তিনি। ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, টেন্ডার দুর্নীতি থেকে শুরু করে ভয় দেখানো, ফেল করিয়ে দেওয়া, ইন্টার্নশিপ বন্ধ করে দেওয়ার মতো একাধিক দুর্নীতিতে নাম জড়িয়েছে তার। একই ভাবে যথেষ্ট জালিয়াতি করে মেডিক্যাল কাউন্সিলের পদে এসেছিলেন এই লবির লোকেরা। মেডিক্যাল কাউন্সিলের কাজ চিকিৎসকদের স্বার্থ দেখা, সুবিচারের ব্যবস্থা করা। সেই আদর্শ থেকে সরে এসে চিকিৎসকদের ভয় দেখিতে তাঁদের মাথার উপর চেপে বসা, এই ধরনের কাজগুলো চালিয়ে গিয়েছে লবি মেডিক্যাল কাউন্সিলকে ব্যবহার করে। সেই প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে মামলা চলছে আদালতে। তার ফয়সলা হয়নি এখনও। তবে এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই এই তথাকথিত উত্তরবঙ্গ লবির হস্তক্ষেপ স্বাস্থ্যক্ষেত্রের প্রায় সর্বত্রই। এখন যে ডিএমই রয়েছে, সেখানে একটি অ্যান্টি চেম্বার রয়েছে। যেখানে তিনি বিশ্রাম করেন। সেই জায়গাটাও হয়ে গিয়েছে তথাকথিত নর্থ বেঙ্গল লবির নিরাপদ স্থল।

মনে পড়বে সেই প্রাক্তন প্রিন্সিপালের কথা, যার ট্রান্সফার অর্ডার জারি হয়েছিল সকালে, বিকেলে চাপের মুখে বাতিল হয় সেই নির্দেশ। সেখানেও ছিল নর্থ বেঙ্গল লবির কাজ। তবে এ কথা বলতে পারি, এই স্বৈরাচার, এই দুর্নীতি বা এই ঔদ্ধত্য সারাজীবন চলতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দীর্ঘদিন তা মেনে নেবেন না। স্বাস্থ্য দফতরকে রসাতলে পাঠানোর জন্য দায়ী এই নর্থবেঙ্গল লবি। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, কেন এত তারা শক্তিশালী? কেন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার? আমাদের হাতে সব তথ্য় নেই। সমস্তই এখন সিবিআইয়ের হাতে। আরজি করে তথাকথিত যে সব দুর্নীতির অভিযোগ, যা ওখানকার ডেপুটি সুপার করেছিলেন, সেই সব ফাইল আপাতত সিবিআইকে হস্তান্তরিত করা হয়েছে। তবে মনে হয়, যবে থেকে এই অভিযোগগুলি হয়েছে, তখন থেকেই এগুলির সুয়োমোটো তদন্ত করা উচিত ছিল স্বাস্থ্য়ভবনের। বিশেষত এক জন আধিকারিক যখন এই অভিযোগগুলি আনছেন। সেই অভিযোগের ভিজিল্যান্স স্বাস্থ্যভবনে হয়েছিল বলে শোনা যায়, তবে তার রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসেনি। কোথাও না কোথাও যে আর্থিক সম্পর্ক একটা রয়েছে লবির সঙ্গে সরকারের, তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। আমরা চাইব, তদন্তের মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়ে উঠুক।

আরও পড়ুন: সেই রাতে যৌনহেনস্থা আর এক মহিলাকেও? যে ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এল আরজি কর-অভিযুক্তের পলিগ্রাফ টেস্টে

আর সত্যি কথা বলতে এই রহস্যের উন্মোচন হওয়া দরকার। আমার রাজ্যের সরকারের যিনি সুপ্রিমো, তিনি যে এই বিষয়গুলো জানেন না এরকমটা মনে হয় না। বকলমে স্বাস্থ্যদফতর যে এই তিন-চার জন চালাচ্ছেন, তিনিও তা জানেন। তাঁর প্রশাসনের যে এত বদনাম হচ্ছে, জনমানস এই মাত্রায় ক্ষুব্ধ, তা সত্ত্বেও কেন সরকার আশ্রয় দিচ্ছেন প্রভাবশালী এই তিন-চারজনকে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছচ্ছে ক্রমে, যে সরকার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়েও কেন এই চক্রকে নিরাপত্তা দিয়ে চলছে সরকার? কেন এদের এই দুর্নীতি, দৌরাত্ম্য বা ঔদ্ধত্য মেনে নেওয়া হচ্ছে? রহস্যটা ঠিক কী? সেই রহস্য ভেদ হওয়া প্রয়োজন বলেই মনে হয় আমার। কেউ কেউ মেঘের আড়াল থেকে কাজ করেন, কেউ কেউ বোড়ে মাত্র, যারা এগিয়ে আসেন। এখন যে নামগুলো প্রকাশ্যে আসছে, তারা ওই এগিয়ে যাওয়া নাম মাত্র। তবে এদের মাথার উপরে যে বড় কোনও শক্তিশালী হাত রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এরা কেউ যেন এই ভয়ঙ্কর অপরাধ করে ছাড়া না পায়,সেটুকুই চাওয়া।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত) 

More Articles