আবার বাংলাকে ভাগ করার দাবি! বিজেপির কৌশল ভেস্তে দিতে পারবে রবীন্দ্রনাথের বাংলা?
West Bengal Bifurcation: হঠাৎ মালদা, মুর্শিদাবাদের মানুষদের কেন উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্তিকরণ ঘটানোর দাবি উঠছে?
বাংলা ভেঙেছে একবার। আবার বাংলাভাগের চক্রান্ত শুরু হয়েছে। এবার নতুন করে অশান্তি শুরুর নেপথ্যে রয়েছে বিজেপি। বঙ্গ বিজেপির বর্তমান রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রস্তাব পেশ করেছেন যে, উত্তরবঙ্গের কিছু জেলাকে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে একটা নতুন অঞ্চল তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি, বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজ, আলাদা কোচ রাজ্য চেয়েছেন। গোর্খাল্যান্ডের দাবি তো বহুকাল ধরে আছেই। উত্তরবঙ্গে গেরুয়া দাপট রয়েছে এখনও। উত্তরপূর্বের রাজ্যেও তা আছে। ফলে বাংলার উত্তর অংশে এই বিচ্ছিন্নতার হাওয়া তোলা কি বাংলাকে ভাগ করে নিজেদের দখলে এনে শাসন করার চেষ্টা নয় বিজেপির?
ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার বিজেপির সাংসদ নিশিকান্ত দুবে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে মুসলমান মানুষজন নাকি দলে দলে বিহারে চলে গিয়ে সেখানকার হিন্দুদের উপর অত্যাচার করছে। ফলে অবিলম্বে, কিষানগঞ্জ, কাটিহার, পুর্ণিয়া, মালদা এবং মুর্শিদাবাদকে নিয়ে একটা নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল স্থাপন করার দাবি করেছেন তিনি। গোড্ডার সাংসদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বাংলা ও বাঙালিকে স্পষ্ট ভাগ করার চক্রান্ত চলছে যার নেপথ্যে আবার রয়েছে এবারের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপির খারাপ ফলাফল।
আরও পড়ুন- এবার অস্ত্র কাঁওয়ার যাত্রা! দোকানের মালিকের ধর্ম জেনে কী করবেন যোগী?
বিজেপির রাজ্য সভাপতি উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোর সঙ্গে কোথায় উত্তরবঙ্গের মানুষের মিল পেয়েছেন যে তাঁর মনে হলো, সমস্ত অঞ্চলগুলো মিলিয়ে দিলেই হবে! এই প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। উত্তর পূর্বের মানুষদের ভাষা বাংলা নয়, তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গেও বাংলার মিল নেই। বরং এই প্রতিটি অঞ্চল স্বতন্ত্র সংস্কৃতিতেই ভাস্বর। তাহলে হঠাৎ মালদা, মুর্শিদাবাদের মানুষদের কেন উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্তিকরণ ঘটানোর দাবি উঠছে? ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার সাংসদ যে দাবি তুলেছেন সংসদে তার ভিত্তি কী? শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, লোকসভার স্পিকার এই বিষয়ে আলোচনায় মত দেননি। অর্থাৎ বিজেপি সাংসদের বক্তব্য লোকসভার কার্যবিবরণীতে স্থান পেলেও, তার উত্তরে বিরোধীদের বক্তব্য স্থান পেল না। সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এই তথ্য কোথায় পেলেন যে, মুসলমান জনসংখ্যা মালদা এবং মুর্শিদাবাদে এমন হারে বাড়ছে যে তার ফলে অঞ্চলের জনবিন্যাসে প্রভাব পড়ছে? ২০১১ সালের পরে এই দেশে জনগণনা হয়নি। তাহলে কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের সম্পর্কে এমন দাবি করছেন? ২০২১ সালে কোভিড মহামারীর কারণে জনগণনা নাও হতে পারে, তারপরেও, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তা কেন করা গেল না এই নিয়েও অবশ্য প্রশ্ন থেকে যায়।
জনগণনার তথ্য সামনে এলে যদি প্রকাশ হয়ে যায় যে বিজেপির দাবি, অর্থাৎ মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের ছাপিয়ে যাচ্ছে, তাই 'হিন্দু খঁতরে মে হ্যায়' আসলে বিশুদ্ধ ঢপবাজি, তাহলে মুহূর্তে ভেঙে পড়বে বিজেপির মেরুকরণের কৌশল। খুব সাম্প্রতিক ন্যাশন্যাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের একটি রিপোর্ট পাওয়া গেছে। হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র কিছুটা হলেও বোঝা সম্ভব। ঘটনাচক্রে, এই জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্যের সমীক্ষা কিন্তু নিয়মিতই হয়েছে। এই রিপোর্ট থেকেই বিশেষজ্ঞেরা জনসংখ্যার বৃদ্ধি, বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের বৃদ্ধির হার ইত্যাদি জানতে পারেন। সেই রিপোর্ট বলছে, ১৯৯৩ সালে জনসংখ্যার ৪৪% মানুষ কোনও না কোনও জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। ২০১৬ সালে সেই হার ৫৩.৫% আর ২০২১-এ ৬৬.৭%। অর্থাৎ এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারের হার ১৯৯৩ থেকে ২০১৬-তে বেড়েছে ১০ পার্সেন্টেজ পয়েন্টের মতো কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০২১-এর মধ্যে বেড়েছে ১৩.২%। কাজেই ২০১১ সালে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধি, মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং তাদের ফারাক একরকম হবে না, ভীষণই আলাদা হবে। সুতরাং ১৯৫১ সালের পর, ২০১১-তেও যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। আগামীতে জনগণনা রিপোর্ট পেলেই বোঝা যাবে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কতটা কমেছে।
২০০১-২০১১-র মধ্যে হিন্দুদের ১৬.৭% মুসলমানদের ২৪.৭% হারে জনসংখ্যা বেড়েছে। ২০০০ সাল থেকে, সারা দেশে মুসলিম জনসংখ্যা
বৃদ্ধির হার কমছে ৫%, তুলনায় হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমছে ১.৫%। এই বাংলায় ফার্টিলিটি রেট দুই সম্প্রদায়েরই প্রায় সমান। জনসংখ্যার বৃদ্ধি মাপা হয় ফার্টিলিটি রেট দিয়ে। একজন নারীর সারা জীবনে ক'টা সন্তান হচ্ছে, তার পরিসংখ্যান দিয়েই এই হার মাপা হয়। উত্তরপ্রদেশের ফার্টিলিটি রেট ৩.১, মানে উত্তরপ্রদেশের তিনজন মহিলা প্রায় ৯টি সন্তানের জন্ম দেন। আর বাংলায় ফার্টিলিটি রেট ১.৬, মানে উত্তরপ্রদেশের অর্ধেকরও কম। সারা দেশের গড় ফার্টিলিটি রেট ২.২, অর্থাৎ বাংলা সারা দেশের চেয়ে অনেক ভালো জায়গাতেই আছে। তথ্য বলছে এই রাজ্যে ফার্টিলিটি রেট যেভাবে কমছে তাতে আগামী ১০/১৫ বছরে এই ফার্টিলিটি রেট ১.১-এ পৌঁছে যাবে।
উত্তরপ্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যা ১৩ বা ১৪ %, বাকিটা হিন্দু। সেখানে ফার্টিলিটি রেট ৩.১। আর বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যা ৩৩%-র বেশি, ফার্টিলিটি রেট ১.৬। ভারতবর্ষে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল ইত্যাদি বহু রাজ্যের থেকে কম হার কোথায়? সবচেয়ে বেশিই বা কোথায়? ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, উত্তরপ্রদেশের হার ৩.১, বিহার ৩.৩, মধ্যপ্রদেশ ২.৮, ঝাড়খণ্ড ২.৬, গুজরাত ২.২, অসম ২.৩ আর বাংলা ১.৬। হিন্দি গোবলয়েই দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের অন্যতম ইঙ্গিত লুকিয়ে। তুলনায় যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি, সেই রাজ্যগুলিতে ফার্টিলিটি রেট কম, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, এমনকী অধুনা বিজেপি শাসিত অসমেও অপেক্ষাকৃত কম। তাই নিশিকান্তের বাংলাভাগের নেপথ্যের দাবি খাটে না।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশ|| রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র এখন নষ্টদের অধিকারে
এর আগেও বহুবার বাংলাভাগের চক্রান্ত হয়েছে। কখনও ব্রিটিশ শাসকেরা এই ভাগ করার চেষ্টা করেছেন, কখনও ভিতর থেকেই দাবি উঠেছে বঙ্গভঙ্গের। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধেও আওয়াজ উঠেছে ঐক্যবদ্ধভাবেই। ব্রিটিশরা দেখেছিল বাংলা থেকেই নানা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হচ্ছিল এবং বাংলাই ছিল এই আন্দোলনগুলোর কেন্দ্রীয় স্থল। তাই অঙ্কুরে বিনাশ করার উদ্দেশ্যে সেই সময়ে লর্ড কার্জন প্রথম বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন। সরকারিভাবে বলা হয়েছিল, বাংলার ৭৮ লক্ষ জনসংখ্যাকে প্রশাসনিকভাবে শাসন করা সম্ভব হচ্ছে না তাই এই ভাগ। আসলে ব্রিটিশ শাসকেরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই বাংলার শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যে থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। সেই সময়ে লর্ড কার্জন ঢাকা শহরে মুসলমান জনগণের জন্য একটা
আলাদা অঞ্চল ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানতেন, এর মধ্যে দিয়ে যে বিভাজন সৃষ্টি করা যাবে, তাতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে নষ্ট করে দেওয়া সম্ভব হবে। ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে, যখন সরকারিভাবে এই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়, তখন হিন্দু-
মুসলিম দুই পক্ষ থেকেই তার বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠে। ১৯০৫ সালে, লর্ড কার্জন যখন বাংলাকে পূর্ব এবং পশ্চিম এই দু'ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার বিরুদ্ধে হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালিরাই রুখে দাঁড়ান যারা একটা সময় ব্রিটিশ আশ্রয়েই নিরাপদে থাকবেন ভেবেছিলেন। শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই ছড়িয়ে পড়েছিল। সমস্ত স্তর, সমস্ত শ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সামনের সারির মুখ হয়ে ওঠেন।
যারা বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারা বাঙালিদের অন্তর্নিহিত ঐক্যকে বুঝতে পারেননি। ১৮৯০ সাল নাগাদ, বাংলা তখন দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীতে জর্জরিত। অর্থনৈতিকভাবে বাংলার মানুষজনের মধ্যে একটা ক্ষোভ ছিলই। পাশাপাশি, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু উচ্চবিত্ত মেধাজীবী মানুষজনেরও নিজস্ব স্বার্থে যে আঘাত লাগতে পারে, তা সম্ভবত ব্রিটিশ শাসকেরা আন্দাজ করতে পারেনি। ধর্ম আলাদা হলেও, এই অঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষই বাংলায় কথা বলতেন এবং তাদের সংস্কৃতির মধ্যে মিল ছিল, তাই প্রাথমিক বিরোধিতা সেখান থেকেই উঠে এসেছিল। এই ঐতিহ্যই রবীন্দ্রনাথকে নিজের দেশের ধারণা তৈরিতে সহায়তা করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “বাবা, দেশভাগের পরবর্তীতে যে আন্দোলন হচ্ছিল, সেখানে যথেষ্ট সদর্থক ভূমিকা রেখেছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, এতদিন তিনি যে ছাড়াছাড়া ভাবে ছিলেন, তা থেকে বেরিয়ে এসে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। গানে, কবিতায় এবং যেখানে যেখানে তিনি মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখেছেন, সেখানেই তিনি তীব্রভাবে লর্ড কার্জনের এই বিভাজনের নীতিকে আক্রমণ করেছিলেন’’।
আজ, নতুন করে আবার বাংলা ভাগ করার চক্রান্ত হচ্ছে। এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের চেতনাই বাঁধতে পারে বাঙালিকে। নানা রাজনৈতিক দলে বিভক্ত বাঙালি সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে আবার একজোট হয়ে, আবারও বাংলাকে আবার ভাগ করার বিজেপির চক্রান্তকে নিশ্চিত রুখবে। বাংলা এমনই, চিরকাল।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)