কেন নির্বিচারে ফিলিস্তিনি শিশুদের জেল? কত বন্দি রয়েছে ইজরায়েলের কারাগারে?

Palestinian prisoners in Israeli jails : ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হওয়ার পর থেকে ১২,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি শিশুকে ইজরায়েলি সেনা বাহিনী আটক করে রেখেছে।

৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা চালানোর পরে গলফ কার্ট, ভ্যান এবং মোটরবাইকে করে হামাসের জঙ্গিরা বহু ইজরায়েলি নাগরিক ও সৈন্যকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি হামাস ও ইজরায়েলের যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তির চুক্তি হয়েছে তাতে এই অপহৃত মানুষদেরই দেশে ফেরানোর কথা বলা হয়েছে। হামাস যেমন ইজরায়েলি অপহৃতদের ফেরত দেবে তেমনই ইজরায়েলও আটকে রাখা ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেবে। হামাসের ওই হামলার বদলা নিতেই ইজরায়েল দেড় মাস ধরে গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, গাজাকে এখন শিশুদের কবরস্থান বললেও ভুল বলা হয় না। ইজরায়েলের যুদ্ধবিমান গাজা উপত্যকায় বোমা বর্ষণ করে প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে ওই এলাকা। ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস অবশ্য আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, ইজরায়েলের কারাগারে বন্দি থাকা ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য চুক্তি করবে হামাস, সেই চুক্তিতেই এই বন্দি ইজরায়েলিদের ব্যবহার করবে তারা। এই মুহূর্তে কতজন ফিলিস্তিনি ইজরায়েলের জেলে বন্দি, তাদের মধ্যে কত শিশু রয়েছে? কেনই বা এত ফিলিস্তিনিকে আটকে রেখেছে ইজরায়েল?

অনেকেই বলেন, গাজা আসলে নিজেই একটা জেল। উন্মুক্ত এই কারাগারে ২.৩ মিলিয়ন মানুষের বাস। অথচ এই মানুষরা চারদিক থেকে আবদ্ধ, ইজরায়েল সব রকমভাবে পঙ্গু করে রেখেছে গাজাকে। তথ্য বলছে, ইজরায়েলের কারাগারে দিন কাটিয়েছেন এমন ফিলিস্তিনিদের সংখ্যাও খানিক একই। ১৯৬৭ সাল থেকে, যখন ইজরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, গাজা উপত্যকা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক দখল করে, তখন থেকে প্রায় ১০ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করেছে ইজরায়েল।

প্রতি পাঁচজন ফিলিস্তিনির মধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের ১,৬০০টি সামরিক আইনের অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। জেলে ফিলিস্তিনি পুরুষদের সংখ্যা অভাবনীয় - প্রতি পাঁচজনের মধ্যে দুইজন পুরুষকেই গ্রেফতার করেছে ইজরায়েল। যদি তুলনা করতে হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা আসে। আমেরিকার জেলেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বন্দি রয়েছে। প্রতি ২০০ জনের মধ্যে একজনই সেখানে কারাবন্দি। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে কারাবাসের হার সামগ্রিক হারের তিনগুণেরও বেশি — এত কিছু সত্ত্বেও কিন্তু গড়পড়তা ফিলিস্তিনিদের জেলে সময় কাটানোর সঙ্গে আমেরিকারও তুলনা হয় না। ফিলিস্তিনি বন্দি অধিকার গোষ্ঠী অ্যাডামির জানাচ্ছে, ইজরায়েলি জেল ব্যবস্থা আইন, পদ্ধতি এবং নীতিতে অত্যন্ত জটিলতা। আসলে একজন জেলবন্দিকে শেষ করে দেওয়ার জন্যই তা তৈরি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- কেন এত বিখ্যাত প্যালেস্তাইনের সাদা-কালো স্কার্ফ! কেফিয়াহর বিশেষ প্রতীকের অর্থ অবাক করবে

বর্তমানে, ইজরায়েলি জেলে বন্দি থাকা ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ৫,২০০। এর মধ্যে ৩৩ জন মহিলা এবং ১৭০ জন শিশু রয়েছে। বিচার হলে ফিলিস্তিনি বন্দিদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। কেন এত মানুষ বন্দি?

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইজরায়েল প্যালেস্তাইন ও আরব ভূখণ্ড দখল করে। এর দুই মাস পর ইজরায়েলের সরকার সামরিক আদেশ ১০১ জারি করে। এই আইনে মূলত 'বিদ্বেষমূলক প্রচার এবং উস্কানি নিষিদ্ধ করার' লক্ষ্যে নাগরিকদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়। এই ধারা এখনও অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ব্যবহার করা হয়। কোনও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করা, বিক্ষোভের আয়োজন করা, রাজনৈতিক পুস্তিকা ছাপানো এবং বিতরণ, পতাকা ও অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতীক নিয়ে রাস্তায় নামা এবং সামরিক আদেশের অধীনে অবৈধ বলে বিবেচিত কোনও সংস্থার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা সব কিছুই এই আইনে নিষিদ্ধ।

তিন বছর পর ইজরায়েলি সরকার আরেকটি সামরিক আদেশ (৩৭৮) জারি করে। এই আইনে মূলত ইজরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সকল প্রকার প্রতিরোধকেই 'সন্ত্রাস' হিসাবে বেআইনি ঘোষণা করার কথা বলা হয়। ফিলিস্তিনি নাগরিক ও রাজনৈতিক অভিমতকে রোখার জন্য সেই সময় থেকেই শ'য়ে শ'য়ে সামরিক আদেশ জারি ও প্রয়োগ করা হয়েছে।

ইজরায়েলে মোট ১৯টি জেল আছে। একটি রয়েছে অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেই। সব জেলেই ফিলিস্তিনি বন্দিদের রাখা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর আগে বলেছিল, এভাবে নাগরিকদের বন্দি রাখা বেআইনি এবং নিষ্ঠুর। বন্দি ব্যক্তি মাসের পর মাস, কখনও কখনও বছরের পর বছর প্রিয়জনদের দেখতে পায় না, বিষয়টা একেবারেই অমানবিক।

প্রশাসনিক বন্দির ক্ষেত্রে অবস্থা আরও শোচনীয়। ইজরায়েলে ১,২৬৪ প্রশাসনিক ফিলিস্তিনি বন্দি রয়েছেন। প্রশাসনিক বন্দি কারা? এদের কোনও বিচার বা কোনও অভিযোগ ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে রাখা হয়েছে। এই প্রথা ব্রিটিশ আমলের এক আইনের অপভ্রংশ বলা যায়। 'গোপন প্রমাণের ভিত্তিতে' অনির্দিষ্টকালের জন্য এই বন্দিকে জেলে রাখা যেতে পারে। অর্থাৎ একজনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ না রইলেও তাকে জেল খাটানো যেতে পারে।

ইজরায়েল যদিও বলছে, কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজনদেরই আটক করে যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করার কাজ চলতেই থাকে। তবে ইজরায়েলি সমালোচক এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি বলছে এই আইনের ব্যাপক অপব্যবহার করা হয়।

২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হওয়ার পর থেকে ১২,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি শিশুকে ইজরায়েলি সেনা বাহিনী আটক করে রেখেছে।

ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে ১৮ বছরের কম বয়সি কমপক্ষে ৭০০ ফিলিস্তিনি শিশুকে ইজরায়েলি সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ এবং আটকের পর ইজরায়েলি সামরিক আদালতে প্রতি বছর এদের বিচার করা হয়। এই শিশুদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সাধারণ অভিযোগ হলো পাথর ছোড়া, এর সর্বোচ্চ শাস্তি ২০ বছরের জেল।

আরও পড়ুন- বিনা বিচারেই বন্দি নাবালক, মহিলারা? কোন ১৫০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিচ্ছে ইজরায়েল?

শিশু অধিকার গোষ্ঠীগুলি বলছে, জেলে এই শিশুরা নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। বাবা-মা বা আইনজীবীর উপস্থিতি ছাড়াই শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ইজরায়েল এই শিশুদের আটকে রেখে তথ্য খোঁজার কাজ করায়। এদের পরিবারকে বিশাল জরিমানা দিতে বাধ্য করে।

মিলিটারি অর্ডার ১৭২৬-এ বলা হয়েছে, অভিযোগ দায়ের করার আগে শিশুদের ১৫ দিনের জন্য আটকে রাখা যেতে পারে এবং সামরিক আদালত সর্বোচ্চ ৪০ বার, প্রতিবার ১০ দিন ধরে আটকে রাখতে পারে শিশুকে।

মিলিটারি অর্ডার ১৭৪৫-এ বলা হয়েছে যে, শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তা শিশুরা বোঝে এমন ভাষাতেই করতে হবে এবং তা রেকর্ড করা উচিত। তবে ফিলিস্তিনি শিশুদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটে না।

মিলিটারি অর্ডার ১৩২-এ বলা হচ্ছে, ১৬ বছর বা তার বেশি বয়সি ফিলিস্তিনি শিশুদের আগে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবেই ইজরায়েলি সামরিক আদালতে বিচার হয়েছিল ও সাজা দেওয়া হয়েছিল। আরও মজার বিষয় হলো, ফিলিস্তিনি শিশুদের শাস্তি দেওয়ার সময় সেই সময়ের বয়সটাই ধরা হয়। যখন গ্রেফতার বা আটক করা হয়েছিল সেই বয়স ধরা হয় না। ২০১৬ সালের অগাস্টে ইজরায়েল তার আইন পরিবর্তন করে বলে, ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের অপরাধমূলক কারণে দায়ী করা যাবে না।

More Articles