বগল বাজাতে বাজাতে তাঁর ছবি দেখা যায় না! গোদারের সিনেমা কেন দেখবে মানুষ?

Jean-Luc Godard: আজকের আধুনিক তথাকথিত বাজারি ছবিতে গোদারের কোনও ভূমিকা নেই? অবশ্যই আছে।

কেন গোদার চারটি আকাডেমিক মানুষের কঠিন আলোচনায় থেকে যাবেন? কেন দুর্বোধ্য বোঝাতে তপন সিংহ গল্প হলেও সত্যি-তে তাঁর নাম ব্যবহার করবেন? গোদার চাইতেন না তিনি সবার হয়ে উঠুন। না। এক্কেবারে না। বরং পড়াশুনো না করে শুধু ছবি দেখার আর বগল বাজাতে বাজতে একই সঙ্গে কাপরা আর তাঁর ছবি যাতে না দেখা যায় সেই চেষ্টা চিরজীবন চালিয়ে গেছেন। তাহলে কি আজকের আধুনিক তথাকথিত বাজারি ছবিতে গোদারের কোনও ভূমিকা নেই? অবশ্যই আছে।

গোদারকে কেউ পছন্দ করে না। করতে পারে না। তিনি নিজেই চাননি দর্শক তাঁকে ভালোবাসুক বা তাঁর কাজকে ভালবাসুক। বরং চেয়েছিলেন এমন কাজ করতে যাতে ভালবাসা না থাকলেও তাঁকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হয় সবাই। সমস্যাটা তাঁর না সমালোচকদের। সত্যজিৎ রায় তাঁর “A Word About Godard,” এ একেবারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,

“Now, I don’t like Godard too. But then, ‘like’ is a word I seldom use to describe my feeling about truly modern artists. Do we really like Pablo Picasso, or Claude-Michel Schönberg, or Eugène Ionesco, or Alain Robbe-Grillet? We are variously provoked and stimulated by them, and our appreciation of them is wholly on an intellectual level. Liking suggests an easy involvement of the senses, a spontaneous ‘taking to’, which I doubt if the modern artist even claims from his public. The trouble, really, is not with Godard, but with his critics— or, at least, a good many of them– who are constantly trying to fit a square peg into a round whole. With any other art, I would have said with confidence that Godard would win in the end. But in the ruthless and unserious world of commercial cinema that he has to operate, I have my doubts.”

আরও পড়ুন- ১৬ বছরেই গলায় চরম মাদকতা! ‘স্নো হোয়াইট’-এর পর কোথাও কেন গলা দিলেন না গায়িকা?

কী করেছিলেন গোদার? ক্যামেরার জার্কি মুভমেন্ট আর জাম্প কাটের মতো কঠিন কঠিন শব্দের বাইরে? গোদার প্রথম শিখিয়েছিলেন, সিনেমা একটা আলাদা শিল্প মাধ্যম। আর সেই মাধ্যমটা মানুষের তৈরি। ঠিক সেই জন্যই যেমন ইম্প্রেসনিস্টদের ছবিতে প্রকৃতি অন্য ভাবে ধরা দেয়, পিকাসোর কিউবিজমে মানুষের আকার বদলে যায় বারে বারে, সিনেমাও তেমন এক মাধ্যম যার দ্বারা নতুন এক ভাষা তৈরি করা যায়, সিনেমার ভাষা। তাঁর ছবি সারাক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে, তা নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য/প্রশ্ন রাখতে থাকে। অজস্র উদ্ধৃতি আসতে থাকে। আসে একের পর দৃশ্যের কোলাজ। যত দিন গেছে সিনেমার টেক্সট আর ইমেজারির সঙ্গে সঙ্গে গল্পকে এক অদ্ভুত স্যুরিয়াল জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি। সেখানে সবসময় যে কিছু ঘটবেই তার কোনও মানে নেই। নদীর ধারে একলা বসে গান কি আর কাউকে শোনানোর জন্য? গোদারের ছবিও নিজের নতুন ব্যাপ্তি পেতে থাকে। গোদার তৈরি করে চলেন এমন এক পৃথিবী যেখানে “যেখানে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই– মানুষ শুধু ইমেজ, ইমেজ আর ইমেজ নির্মিত যন্ত্র। গোদারের ছবির শেষ ইমেজে প্রজেক্টরের রোল থেকে ফিতে শেষ হয়ে যাওয়ার মতো করে মানুষ পরস্পরের থেকে হাত সরিয়ে নেয়– পর্দাজুড়ে পড়ে থাকা ধূসর মরুভূমি শুধু– ধবধবে সাদা বিছানার চাদর।”

আরও পড়ুন- একের পর এক হিট, তবু কেন গান লিখতে চাননি বলিউডের বিদ্রোহী কবি কাইফি আজমি?

নিজের কথা বলার জন্য গল্প, কবিতা, গান, ছবির মতোই এ ভাষা অনন্য। এ ভাষায় যে কথা বলে গেছেন গোদার অন্য কোনওভাবে তা বলা সম্ভব ছিল না। আর এই ব্যাপারটা মাথার খুলি ফুটো করে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন তিনি। হয়তো প্রথমবার। তাই যখনই দেল তোরো রিয়েলিজম আর ফ্যান্টাসিকে মেশাতে যান, মার্টিন স্কোরসসে যখন মাফিয়াদের নিয়ে মিন স্ট্রিট বানান, বা ডেভিড নিউম্যান লিখতে বসেন বনি এন্ড ক্লাইডের মতো সুপারহিট ছবির চিত্রনাট্য, পিছনে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে থাকেন গোদার। এক অদ্ভুত অস্বস্তি থেকে চরিত্রদের চামড়ার ভিতরে ঢুকে পড়া। তিনিই তো শিখিয়েছেন। যে অস্বস্তি প্রতি মুহূর্তে আমাদের হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবি দেখতে গেলে। গোদারই বুঝিয়েছেন ক্যামেরা কাঁপতেই পারে। আমি তাও ট্র্যাক শট না করে হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরায় ছবি তুলব। কলকাতা ৭১-এর মৃণাল তারই প্রয়োগ করেছেন সফলভাবে। ক্রমাগত লং মিড আর ক্লোজ শটে দর্শককে শান্ত হয়ে বসতে দেননি এক মুহূর্তের জন্য।

কিছুদিন আগেই সেই দুরন্ত ভদ্রলোক কেমন অদ্ভুত শান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছেন। আর শোবার পড়েও রোজ রোজ নাড়িয়ে দিচ্ছেন হাজার হাজার সিনেমাপ্রেমীদের। Rest in Conflict, Mon Godard.

 

More Articles