এবার অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখেও মমতা-স্তুতি!পালটে গেলেন বিচারপতি?

Justice Abhijit Ganguly: বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "কুণাল ঘোষের কথা আমি খুব এনজয় করি। রোজ কিছু না কিছু বলেন। তবে আমি কোনও অতিরিক্ত মন্তব্য করব না।"

বিচারপতির কি পরিবর্তন হয়েছে? বিচারপতি কি বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন? এই ডিসেম্বর কি নতুন কোনও সূত্রপাত ঘটাতে চলেছে ফের! বঙ্গের রাজনৈতিক এবং বিচারবিভাগীয় মঞ্চে আবারও উঠে আসছে এমনই সব আবহ। আর সেখানেই ফের মূল রসদ হয়ে উঠেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Justice Abhijit Ganguly)। নতুন করে জল্পনা বাড়িয়েছেন তিনি! কেন?

গরু-কয়লা থেকে বগটুই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয়বার শপথ নেওয়ার এক বছরের মধ্যেই একের পর বিড়ম্বনায় পড়েছে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার। দলের নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি আমলা, একের পর এক নাম উঠে এসেছে দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে। ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন মমতা। অস্বস্তিতে পড়েছে তাঁর দলও। ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়েই উঠে এসেছে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ। প্রাথমিক থেকে উচ্চ বিদ্যালয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে গিয়েছে দুর্নীতির শিকড়। অবস্থানে বসেছেন চাকরিপ্রার্থীরা। একের পর এক অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে তৃণমূল সরকার।

আর এই অভিযোগ এবং অস্বস্তির মধ্যেই উঠে এসেছে আদালত-বিচারপতির নাম! শিরোনামে এসেছেন কলকাতা হাইকোর্টের 'জনপ্রিয়' বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ২০২২-এর প্রথম থেকেই যাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এই রাজ্যের দুর্নীতি মামলার তদন্ত। একের পর ঘটনায় সিবিআই (CBI) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি। তদন্তে নেমেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। সরব হয়েছে ইডি (ED)। একাধিক মাথার টানাপড়েনে ফের শুরু হয়েছে জল্পনা। গ্রেফতার থেকে মন্তব্য, বারবার উঠে এসেছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম। কিন্তু একাধিক ক্ষেত্রেই আবর্তিত হয়েছে বিচারপতি এবং সরকারের টানাপড়েনের কথা। শুনানি চলাকালীন রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে একাধিক মন্তব্যে সরব হয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। নির্দেশের সঙ্গেই তুলে এনেছেন একাধিক ইস্যু। যা বেড়েছে, রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারির পর। ফের রাঘববোয়াল-ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়েছে এজলাসও।

কিন্তু এবার! ৮ ডিসেম্বরের একটি ঘটনাক্রম সমস্ত জল্পনা, প্রশ্নের নিরসন ঘটিয়েছে! অনেকেই দাবি করছেন, আগের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং ৮ ডিসেম্বরের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বেশ আলাদা! কেন? এদিন আদালতকক্ষে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানি চলাকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, ''মুখ্যমন্ত্রী ভালো কাজ করছেন!'' এর সঙ্গেই তিনি ওই দিন বলেন, "সেদিন ধেঁড়ে ইঁদুর বলেছি সুব্রতদার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে। উনি বুঝেছিলেন কেন বলেছি। এই পরিবেশে সেটায় অন্যমাত্রা যোগ হয়েছে।" প্রসঙ্গত, কয়েক দিন আগেই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই 'ধেড়ে ইঁদুর' ধরার প্রসঙ্গ টেনে আনেন।

আরও পড়ুন- দুঁদে গোয়েন্দা না বিচারপতি! অভিজিতের নতুন স্ট্র‍্যাটেজি হার মানাবে ফেলুদাকে

এরপর তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কথা প্রসঙ্গে পর্ষদের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "কুণাল ঘোষের কথা আমি খুব এনজয় করি। রোজ কিছু না কিছু বলেন। তবে আমি কোনও অতিরিক্ত মন্তব্য করব না। কারণ, কথার মানে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। আমি তো বলেছি, ঢাকি বিসর্জন দিয়ে দেব। ওরা আমাকে বলতে বাধ্য করে।" শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করে বিচারপতির মন্তব্য, "চন্দ্রিমাদিকে (রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য) বলে দেবেন, আর কোনও মন্তব্য করব না। আমি কেন খারাপ কথা বলব? মুখ্যমন্ত্রী ভালো কাজ করছেন।"

যদিও গত ২৫ নভেম্বরই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এবং পরোক্ষে ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। সংবিধান দিবসে রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আদালত-মন্তব্যের বিরুদ্ধে সরব হন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বলেন, "স্থগিতাদেশ এগরোল নাকি! চাইলেই পাওয়া যায়!"

ঠিক এর আগেই রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্তে অগ্রগতি নিয়েও ক্ষুব্ধ হন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অসন্তোষ প্রকাশ করতেও দেখা যায় তাঁকে। এমনকী গত সেপ্টেম্বরে একটি সাক্ষাৎকারে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে বলেন, "শুনেছি প্রতিহিংসাপরায়ণ!" আবার ওই একই সাক্ষাৎকারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। হুঁশিয়ারি দিতেও দেখা যায় বিচারপতিকে।

এদিকে গত অগাস্ট মাসে একটি অনুষ্ঠানে মুখোমুখি হন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয় দু'জনের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বিচারপতিকে বলেন, "অনেক কিছু করছেন, কাজ চালিয়ে যান।"

একের পর এক মামলা। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি। ওএমআর শিট থেকে শুরু করে ১৮৩ জনের অবৈধ নিয়োগের তালিকা প্রকাশ। ববিতা সরকারের চাকরি থেকে শুরু করে মন্ত্রী পরেশের কন্যার চাকরি যাওয়া। সুকন্যা থেকে প্রাথমিকে টেট দুর্নীতি। একের পর ক্ষেত্রে বারবার প্রকাশ্যে এসেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বিচারব্যবস্থা এবং অভিজিৎ-আবহে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন তিনি। কার্যত অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই দুই চরিত্রের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা! কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাসে তৈরি হয়েছে নয়া নজির। প্রথা ভেঙে বারবার তৃণমূল নেতাদের লক্ষ্য হয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যাযয়ের "মুখ্যমন্ত্রী ভালো কাজ করছেন,"- এই মন্তব্যে শুরু হয়েছে বিতর্ক। তৈরি হয়েছে আলোচনার আবহও। কেন? রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন;

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মূলত গত একবছরে এই রাজ্যের দুর্নীতি-বিরোধী মুখে বিবর্তিত হয়েছেন। অর্থাৎ আদালত এবং বিচারব্যবস্থাকে সঙ্গী করেই যে দুর্নীতির অভিযোগের খোলনলচে পাল্টে দেওয়া যায়, তা বারবার প্রকাশিত হয়েছে এই বিচারপতির কাজে। আদালত এবং সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া, একসূত্রে বেঁধে দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যেন হয়ে উঠেছেন নিপীড়িত, বঞ্চিতদের বিচারপতি!

ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই, শুধু দুর্নীতির অভিযোগ বা নেতা-মন্ত্রীর গ্রেফতারি নিয়ে অস্বস্তি নয়, রাজ্যের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর মন্তব্য! ক্রমশ শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির পর্দাফাঁস করতে যেন দুঁদে গোয়েন্দা হিসেবে পর্যবসিত হয়েছে তাঁর নাম। আর এই অবস্থায় নবান্নের শঙ্কা বেড়েছে প্রতিনিয়ত! পাল্টা, আইন-বিচার ব্যবস্থায় ভরসার সঙ্গেই রাজনৈতিকভাবে অভিজিৎ-নিধনে ব্যস্ত হয়েছে তৃণমূল। এই দ্বৈত টানাপড়েনের মধ্যেই বারবার আদালতে অনুরণিত হয়েছে সরকার বিরোধী মন্তব্যের ঝঙ্কার, বলছেন সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশ। যা ৮ ডিসেম্বরের পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ বিপরীত আবহ তৈরি করেছে।

তাহলে কি বদলে গেলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়? তাঁর মননে কি পরিবর্তন এসেছে ফের? নাকি এর মধ্যেও রয়েছে অন্য কোনও ইঙ্গিত!

একাধিক প্রশ্নের আবহে কেউ কেউ বলছেন, আদতে কয়েক দিন আগেই দুর্নীতির মাথার গ্রেফতারি প্রসঙ্গে 'ধেড়ে ইঁদুর' প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বারবার তিনিই সিবিআইয়ের তদন্তে অগ্রগতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। সেই তিনিও এবার সরাসরি বলে দেন, দুর্নীতি-বিরোধী তদন্তে ধেড়ে ইঁদুর অর্থাৎ বড় মাথা পর্যন্ত যাওয়া প্রয়োজন! এখানেই ওঠে প্রশ্ন। তাহলে কি পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার, মানিক ভট্টাচার্য সহ একাধিক 'মাথা'র গ্রেফতারের পরেও এই 'ধেড়ে ইঁদুর' বলতে কাকে বোঝাচ্ছেন তিনি! পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের তুলনায় বড় মাথা কি তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? তাঁর দিকেই কি ইঙ্গিত করলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়? এই প্রশ্নেই উত্তাল হয় রাজনৈতিক মহল। আর সেই জল্পনায় জল ঢালতে পাল্টা সরব হয় তৃণমূল। একেবারে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম করেই নজির সৃষ্টি করেন তৃণমূল নেতারা। সরব হন কুণাল ঘোষ। সাংবাদিক বৈঠক করে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিষোদ্গার করেন তৃণমূল নেতা। একের পর রাজনৈতিক আক্রমণেও বিদ্ধ হন বিচারপতি।

আরও পড়ুন- অভিজিৎ-ছোঁয়ায় মুশকিল আসান হবে ডিএ সমস্যার? যে আশায় বুক বাঁধছেন সরকারি কর্মীরা

অনেকেই বলছেন, এই পরিস্থিতি এবং জল্পনা নিয়ে অবগত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। আর সেই কারণেই ফের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগের মামলা এজলাসে উঠতেই টেনে আনলেন এই প্রসঙ্গ। যেখানে কেন তিনি 'ধেড়ে ইঁদুর' বলেছেন, সেই ব্যাখ্যা যেমন দিলেন, বিপরীতভাবে ওই কথার সঙ্গে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও সম্পর্ক নেই, একথা আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন তিনি।

দাবি, এই বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য আসলে নিজেকে স্পষ্ট করার কৌশল। বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টাও রয়েছে। বিচারপতি যে তদন্তের আগেই কারও দিকে নির্দিষ্ট করে কিছু বলছেন না, একথা নিশ্চিত করতেও চাইতে পারেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়! অনেকেই বলছেন, এখানে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পরিবর্তন হয়েছেন, এমন বলা এখনই ঠিক হবে না। কারণ তিনি সেদিন বলেছিলেন, "অপেক্ষা করুন অনেক ধেড়ে ইঁদুর বেরোবে!" যদিও স্পষ্ট করে কিছু বলেননি বিচারপতি। 

যদিও বিচারপতির ব্যাখ্যার পরেই সুর নরম হয় কুণালের। তিনি জানিয়ে দেন, "বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করার কোনও উদ্দেশ্য আমার ছিল না। ওঁর কিছু মন্তব্য কানে আসে। তার প্রতিবাদ করছি। যিনি মাথা জানেন, ঢাকি জানেন, তাঁকে সাক্ষী করা হোক। সিবিআইয়ের উচিত তাঁকে সামনে আনা। মুখ্যমন্ত্রী ও সরকার ভালো কাজ করছেন, এটা সবাই জানে।"

আসলে রাজ্যের দুর্নীতি কাণ্ড এবং বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিচারপর্ব, একাধিক ক্ষেত্রেই নজির স্থাপন করেছে দেশজুড়ে। সমালোচনা থেকে প্রশংসা, নানান আঙ্গিকেই উঠে এসেছে তাঁর নাম। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। ফের নিজের মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই জল্পনার, বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। আর সেখানেই আবার তাঁর তরফেই এসেছে জল্পনা নিরসনের ব্যাখ্যা। যা কেন্দ্রীভূত হয়েছে বিচারপতির নয়া কৌশলের বাতাবরণেই, বলছেন কেউ কেউ।

 

More Articles