যোগী আদিত্যনাথ, আদানিই তবে 'আদর্শ' অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের?
Justice Abhijit Gangopadhyay: বিচারপতি অভিজিৎ কলকাতা পুরসভার আইনজীবীর উদ্দেশে বললেন, ‘‘দরকার পড়লে যোগী আদিত্যনাথের থেকে কিছু বুলডোজার ভাড়া করুন।’’
পথ নিজেকে 'দেব' (দীপকার্থে প্রচলিত মিম নয়) ভাবে। রথও নিজেকে বিশাল কেউকেটা ভাবে, মূর্তিও ভাবে তাঁকে ছাড়া বৃথা আয়োজন। সত্যটির খোঁজ রাখেন কেবল 'অন্তর্যামী'। তিনিই জানেন ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য, তিনিই জানেন এআই মানুষকে গিলে খাবে কিনা, তিনিই জানেন, দেশে দেশে যুদ্ধ লাগলে কোন অস্ত্র ফেলা হবে। যাকে মাঝে মাঝে 'আমাদেরই লোক' ভাবা হয়, তিনি আসলে যে কাহাদের এই প্রশ্নটির উত্তরও সেই অন্তর্যামীই জানেন। যেমন জানেন, আমাদের এই রাজ্যের অধুনা 'মসিহা' বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বেশ কিছুকাল ধরে, দুর্নীতিতে পচে যাওয়া রাজ্যে তিনিই হয়ে উঠেছেন একমাত্র আশার আলো। নিপীড়িতের হয়ে, ন্যায়ের হয়ে সওয়াল করেছেন তিনিই। যোগ্য হয়েও চাকরি না পাওয়া মানুষের পাশে থেকেছেন। শাসকদলের ক্রোধে পড়েছেন, সুপ্রিম আদালত মামলা কেড়ে নিয়েছে তবু অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ক্যারিশমা'-তে ভরসা রাখতে চেয়েছেন ক্ষয়ে যাওয়া একটা রাজ্যের মানুষ। কিন্তু ক্যারিশমাধারী মানুষটি নিজেকে কোন তরফে রাখেন? এ বোঝা বড়ই শক্ত।
সিপিআইএমপন্থীরা ভেবেছেন তিনি তাহাদেরই লোক, বিজেপি ভেবেছে বিরোধী তৃণমূলকে নাস্তানাবুদ করতে তাঁদের বিশ্বস্ত হাতিয়ার বিচারপতি অভিজিৎই। একমাত্র তৃণমূল ছাড়া হেন কোনও দল নেই যারা বিষ নজরে দেখে বিচারপতিকে। কিন্তু বিচারপতির নজরটা কেমন? কেমনই বা তাঁর দর্শন, কেমনই বা তাঁর দৃষ্টি? রাজনীতি হোক, জীবন হোক, একজন মানুষের অবস্থা বুঝতে 'লিটল অ্যাক্টস'-এর ভূমিকা অসীম। মুন্নাভাই এমবিবিএস সিনেমায় সঞ্জুভাই যখন পরিত্রাতা ও ত্রাতা দুই-ই, এক যুবতীকে জীবনসঙ্গী বাছতে সাহায্য করেছেন তিনিই। কীভাবে বোঝা যাবে একটা মানুষের সঙ্গে সারাজীবন কাটানো যাবে কিনা? মুন্নাভাই রেস্তোরাঁয় অপেক্ষারত সেই যুবতীকে পরামর্শ দিলেন, তাঁর সম্ভাব্য জীবনসঙ্গী রেস্তোরাঁর কর্মীকে কীভাবে ডাকছেন তা দেখতে। তিনি যদি শিস দিয়ে, নানা রকম দুর্বোধ্য অশ্লীল আওয়াজ করে একজন কর্মীকে ডাকেন, বুঝতে হবে এই মানুষটি সকলকে সম্মানই করতে জানে না। জীবনসঙ্গী হতে এটুকু শ্রদ্ধা তো দরকার। ব্যাস! কেল্লা ফতে! ছোট্ট একটি অঙ্গভঙ্গি, ছোট্ট আচরণ বুঝিয়ে দিল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। রাজ্যে কোনও যথোপযুক্ত মুন্নাভাই নেই। কিন্তু বিচারপতি আছেন। তাঁকে 'লিটল অ্যাক্টস' দিয়ে মাপতে বসা বিড়ম্বনার। তিনি আসলে কাহাদের লোক? কী তাঁর দর্শন? কী তাঁর আদর্শ? বিচারপতি অভিজিৎ সম্প্রতি বেআইনি নির্মাণ সংক্রান্ত একটি মামলায় কলকাতা পুরসভার আইনজীবীর উদ্দেশে বললেন, ‘‘দরকার পড়লে যোগী আদিত্যনাথের থেকে কিছু বুলডোজার ভাড়া করুন।’’
আরও পড়ুন- নিজের রায় গিললেন বিচারপতি! কেন ববিতাকে চাকরি দিয়েও ফের কাড়লেন অভিজিৎ?
মানিকতলা মেনরোডের এক বাসিন্দার অভিযোগ, তাঁর পৈতৃক বাড়ি দখল করে বেআইনি নির্মাণ করেছেন এক প্রতিবেশী। ওই প্রতিবেশী কলকাতা পুরসভায় বাড়ি মেরামতের আবেদন করে পাশের ভবনে যাতায়াতের জন্য বেআইনি ভাবে পথ নির্মাণ করেন। পুরসভায় অভিযোগ জানিয়েও কাজ হয়নি। তাই কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করেন তিনি। ২০১৮ সালে বিচারপতি দেবাংশু বসাক নির্মাণটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। আংশিকভাবে ওই বেআইনি নির্মাণ ভেঙেও দেয় পুরসভা। ছ’মাস পরেই ফের নতুন করে নির্মাণ শুরু করে ওই প্রতিবেশী পরিবার। ২০২১ সালে আবার নতুন মামলা দায়ের হয় হাইকোর্টে। সেই মামলার রেশ ধরেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পরামর্শ দিচ্ছেন, যোগীর পথে এগোতে। বুলডোজার দিয়ে উত্তরপ্রদেশে কী হয়, তা সকলের জানা। নির্মাণ ভেঙে উৎখাত করতে হলে সেখানে বুলডোজারের দাপটই শেষ কথা। বেআইনি নির্মাণ ভেঙে ফেলে ন্যায় দিতে হবে একথা সত্য। কিন্তু তাতে আদর্শ কিনা যোগী আদিত্যনাথ? কেন যোগীর রাজ্য চালানোর পন্থায় এত আস্থা রাজ্যের বিচারপতির?
এখানেই শেষ নয়, আরেকটি মামলাতে বিচারপতির কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছে আদানি গোষ্ঠী! ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ডের স্কুলের শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেছেন, স্কুল চালাতে না পারলে আদানিকে বেচে দিন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতন না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ডের বিরুদ্ধে। মোট ৪৪ জন শিক্ষক কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হছেন এই অভিযোগে যে, ইসিএল কোনও নিয়ম না মেনে, নিজের ইচ্ছেমতো বেতন দিচ্ছে। আসলে তলে তলে স্কুল বন্ধ করার চক্রান্ত করছে তারা। ইস্টার্ন কোলফিল্ডের অধীনে ঝাড়খণ্ডে ৯ টি ও বাংলায় ৭ টি স্কুল আছে। শিক্ষকরা বেতন পান যথাক্রমে ৭ হাজার, সাড়ে ৫ হাজার ও ৫ হাজার টাকা। সেই সামান্য বেতনও নাকি ৭-৮ বছর ধরে বাকি পড়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন- এবার অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখেও মমতা-স্তুতি!পালটে গেলেন বিচারপতি?
ন্যায়ের সওয়ালে রেগে গিয়েছেন অভিজিৎ। ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ডকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা তো করেছেন। পাশাপাশি ভর্ৎসনার প্রেক্ষিতে আস্থা রেখেছেন আদানির উপর। তাহলে স্কুল বা ইত্যাদি পরিকাঠামোর দেখভালে সারাদেশে আদানিই একমাত্র বিশ্বস্ত গোষ্ঠী? ধনকুবেরদের হাতে পড়লেই বাংলার স্কুলের মানোন্নয়ন হবে, শিক্ষকদের দুর্দশা ঘুচবে? অর্থাৎ বেসরকারি হলেই পরিষেবা ভালো হবে মন্ত্রেই বিশ্বাসী অভিজিৎ? এইখানে এসেই ঘেঁটে গিয়েছে 'দেব' ভাবা সমস্ত পথ, রথ ও মূর্তির যাবতীয় দ্বন্দ্বরা। বিচারপতির দর্শন কি তবে আমজনতার মতো নয়? দেশ বা রাজ্য শাসনের প্রসঙ্গে যে যোগীরাজ্যের নিরন্তর সমালোচনা করেন একাংশের শুভবুদ্ধিসম্পন্নরা, সেই যোগী আর বুলডোজারের উগ্র রাজনীতিকেই 'দৃষ্টান্ত' ভাবছেন কেন অভিজিৎ? কেন আদানি গোষ্ঠীর মোদিনির্ভরতা (পড়ুন, মোদির আদানি নির্ভরতা) তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে 'উদাহরণ'?
আসলে, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে যে 'স্মার্টনেস'-কে ভরসা করেছিল রাজ্য, ভরসা করে রাজ্য- সেই তালমেল রাখতে গিয়ে বিচারপতি এর আগেও এমন কিছু কথা বলেছেন, উদাহরণ দিয়েছেন যা সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় 'ক্যাচি'। তাহলে, এমন পদাধিকারী ব্যক্তিও কি 'ক্যাচি'র মোহেই পড়েছেন? নাকি সেই 'লিটল অ্যাক্টস'-এর গল্প? তাঁর বেছে নেওয়া উদাহরণই বলে দিচ্ছে আসলে বিচারপতি কীভাবে ভাবতে ভালোবাসেন? স্রেফ 'কথার কথা' বলে যে কিছু হয় না, তা মনস্তত্ত্বের কোনও পাঠ না থাকা মানুষও বুঝবেন। ফের সেই প্রশ্নের ঘাটেই নোঙর ফেলা যাক, বিচারপতি কাহাদের লোক না বলে ভাবা যাক, বিচারপতির আদর্শ আসলে কোনমুখী। বড়ই বিড়ম্বনার সওয়াল, যে অন্তর্যামী হাসছেন আড়ালে, তিনিও দিকভ্রষ্ট হচ্ছেন কিনা সন্দেহ!