দূষণ কমাতে বিদেশে ভরসা, কেন কলকাতাতে মৃত্যুর মুখে ট্রাম?
Kolkata Tram: পৃথিবীর আধুনিক রাষ্ট্রগুলির দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাব, প্রবল ব্যস্ত শহরগুলির মধ্যে কিন্তু আজও ট্রাম চলাচল করে।
প্রতিটি শহরেই কিছু না কিছু নিজস্বতা থাকে। সেই নিজস্বতাই গড়ে দেয় শহরের পরিচয়। সময় বদলায়, শহর বদলায়, মানুষজন বদলে যায়, সমাজ পাল্টায়, কিন্তু কোথাও সেই নিজস্বতাটুকু যেন থেকেই যায় বনস্পতির শক্ত শিকড়ের মতো। যতই তার ডালপালা ছেঁটে ফেলো, যতই ক্ষতবিক্ষত করো, শিকড় তবু থেকেই যায় যুগ যুগান্ত ধরে মাটির গভীরে। কলকাতার ট্রাম এই শহরের সেই শিকড়, কলকাতাকে মাটির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ট্রাম। তবে বয়স হয়েছে তার। ট্রামলাইনের চারপাশ দিয়ে ডিঙিয়ে যায় বাইক, ট্যাক্সি, পাবলিক বাস। মাটির নিচে আলো ঝলমলে পাতাল কুঠুরি দিয়ে এগিয়ে যায় মেট্রো রেল। তবু কলকাতার পিচঢালা রাস্তায় এখনও রয়েছে ট্রামের লাইন। পিচের রাস্তায় ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ট্রাম। বছর দশেক পরেই আর হয়তো এই ট্রামের শিকড় মিলবে না শহরের বুকে। ব্যস্ত মেট্রোপলিটন শহরে আবেদন কমছে ধীরগতির এই যানের।
কলকাতায় ট্রাম এসেছিল সেই ঔপনিবেশিক আমলে। শুধুমাত্র কলকাতা না, সেই যুগে ভারতের একাধিক শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল ট্রাম। মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাই, পটনা, কানপুর, বর্তমান শ্রীলঙ্কার কলম্বো আর পাকিস্তানের করাচিতে চালু ছিল ট্রাম। আস্তে আস্তে সমস্ত শহরেই পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে ট্রাম। রয়ে গেছে শুধুমাত্র কলকাতাতেই। সারা ভারতের মধ্যে কলকাতাতেই ১৫০ বছর পার করে দিল এই 'স্ট্রিট কার'। কলকাতার বহু ভালোমন্দের সঙ্গে জড়িয়েছিল ট্রাম। কলকাতার ট্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন কিছু ঘটনা যা সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা ভারতে। জীবনানন্দ দাসের মৃত্যু থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মোড় ঘুরে যাওয়া, সবকিছুই জড়িয়ে ট্রামের সঙ্গে।
ঘোড়ায় টানা ট্রাম থেকে বিদ্যুৎ বিবর্তন
কলকাতায় যে ট্রাম এসেছিল তার বিবর্তনের পিছনে রয়েছে এক বিশাল ইতিহাস। কলকাতা নগরীতে প্রথমে কিন্তু এসেছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। মূলত এই ট্রামের প্রয়োজন পড়ে মালপত্র আনা নেওয়ার জন্যই। সেই সময়ে কলকাতার দু'টি স্টেশনের মধ্যে মাল আদানপ্রদানের জন্যই ট্রামের ব্যবহার হতো। শিয়ালদা স্টেশনে আসা মালপত্র গঙ্গা পার করে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার জন্য চালু হয়েছিল ট্রাম। তবে সেই ব্যবস্থা বিশেষ সাফল্য পায়নি। ফলে খুব কম সময়ের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় সেই ট্রাম।
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ সালে কলকাতায় আগমন ঘটে ট্রামের। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বন্ধ করে দিতে হয় পরিষেবা। এরপর ১৮৮০ সালে আবারও নতুন করে চালু হয় ট্রাম পরিষেবা। সেই বছরই কলকাতার ট্রাম পরিষেবা সচল রাখার জন্য লন্ডনে ব্রিটিশ কোম্পানি স্থাপন করে কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি যাকে আপামর কলকাতাবাসী CTC বলে চেনে। বর্তমানে কোম্পানির হাতবদল হলেও এই কোম্পানির জন্যই এখনও টিকে আছে ট্রাম।
সেই আর্মেনিয়ান ঘাট থেকে শিয়ালদা পর্যন্ত বসানো হয় একটি মিটারগেজ লাইন। প্রথমবার ব্যবস্থাপনার অভাবে বন্ধ করে দিতে হলেও এবারে টিকে যায় ট্রাম পরিষেবা। এরপরই ট্রাম চড়াকে আভিজাত্যের মাপকাঠি করে দেওয়া হলো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে। তবে, ঘোড়ায় টানা ট্রাম দৌড়ে টেকেনি। বিলিতি বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের তখন সব জায়গায় জয়জয়কার। তাই অবশেষে এই ইঞ্জিনকেই ব্যবহার করে ট্রাম কোম্পানি। ১৮৮২ সালে কলকাতার বুকে ১৯ মাইল ট্রাম লাইন বসিয়ে ফেলে কোম্পানি।
আরও পড়ুন- কলকাতার গর্ব ট্রাম এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে? মুছে যাচ্ছে যে স্মৃতিগুলো
ট্রাম কোম্পানির ইতিহাস বলছে, অস্ট্রেলিয়ার ঘোড়ার সাহায্যে প্রথম ট্রাম চালানো হয়েছিল কলকাতায়। সেই ট্রামের সামনে ঝোলানো থাকতো একটি পিতলের ঘণ্টা। এই ঘন্টা বাজিয়ে মানুষকে ট্রামের যাত্রাপথ খালি করার জন্য সতর্ক করা হতো। ১৮৭৯ সালে লন্ডন ক্যালকাটা ট্রাভেলস কোম্পানি এবং কর্পোরেশনের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী ১৮৮০ সালের ২৭ নভেম্বর কলকাতার রাজপথে অশ্ব চালিত ট্রামের চলাচল শুরু হয়েছিল নতুন করে। ১০০০ ঘোড়া দিয়ে মোট ১১৭টি ট্রাম চালানো হতো।
তবে কলকাতায় ট্রামের আধুনিকীকরণের কাজ শুরু হয় ১৯০০ সাল নাগাদ। ১৯০২ সালে ঘোড়ায় টানা ট্রাম বন্ধ হলে সাহেবপাড়ায় প্রথম বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম চলাচল শুরু হয়। ১৯০০ সালের শুরুতে ৪ ফুট ৮.৫ ইঞ্চি মাপের স্ট্যান্ডার্ড গেজের ট্রাম লাইন চালু হয়। ১৯০২ সালে ট্রাম পরিষেবার বৈদ্যুতিকরণ শুরু হয় যেটি ছিল এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা। এই সময় থেকেই ট্রাম কলকাতার জনগণের অন্যতম জনপ্রিয় বাহনে পরিণত হতে শুরু করে। বিদ্যুতের ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ার ফলে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ চালিত ট্রামের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। তাই শেষমেশ ঘোড়া চালিত ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করে দেয় ক্যালকাটা ট্রাম কর্পোরেশন।
নিত্য যাত্রীদের ভিড়ের চাপ বাড়তে থাকায় ১৯৪৩ সাল নাগাদ হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত ট্রাম লাইনের প্রসার ঘটানো হয়। ১৯ মাইল থেকে ট্রাম পরিষেবা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ মাইল। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকা ট্রামে কিন্তু শ্রেণিবিভাগ ছিল খুব স্পষ্ট। দুই কামরার ট্রামের প্রথম কামরাটি ছিল উচ্চবিত্ত নাগরিকদের জন্য এবং দ্বিতীয় কামরাটি ছিল মধ্যবিত্তদের জন্য। ট্রামের দ্বিতীয় কামরায় ছাত্র এবং অফিস যাত্রীদেরই বেশি দেখা যেত। সেই সময় কলকাতায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি চ্যাপলিনের সিনেমা বা স্টার থিয়েটারে নাটক দেখতে বেশ পছন্দ করায় হাতিবাগান অঞ্চলে ট্রামের জনপ্রিয়তা বেশ বৃদ্ধি পায়।
ভারতের স্বাধীনতার পরেও, এই ব্রিটিশ কোম্পানি কলকাতার ট্রাম পরিষেবার দায়িত্বে ছিল। এরপর আইনের পর আইন তৈরি করা হতে থাকে ট্রাম কোম্পানি এবং তার সম্পদকে রাষ্ট্রায়ত্ত করার লক্ষ্যে। ব্যাপারটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জন্য খুব একটা সহজ ছিল না। স্বাধীনতা এবং যুদ্ধ পরবর্তী কলকাতা শহরের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তখন ভিন্ন দিকে বাঁক নিতে শুরু করেছে। শহরে বেকারত্ব বাড়ছে। তরুণরা ফুঁসছে এবং বেকারত্বের মার খাচ্ছে স্বাধীনতার স্বপ্ন। নিখিল ভারতের মতো তার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক তীর্থ কলকাতাতেও স্লোগান উঠতে শুরু করেছে - ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।
ভাড়া বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক পালাবদল
সুলভ পরিবহনের মাধ্যমে হিসেবে ছাত্র এবং উঠতি বয়সে তরুণদের মধ্যে ট্রাম হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছাত্র এবং সাধারণ কর্মজীবী মানুষ যাতায়াত করতেন। এর মধ্যে ১৯৫৩ সালের ব্রিটিশ মালিকানাধীন কলকাতা ট্রাম কোম্পানি মুনাফা বৃদ্ধির জন্য সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটের ভাড়া এক পয়সা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে মাঠে নামে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। প্রথম থেকেই সিপিআই ঘোষণা করে, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকারের যোগসাজসে এই ভাড়া বৃদ্ধির চক্রান্ত করা হচ্ছে। আর যদি সত্যিই ভাড়া বৃদ্ধি হয় তাহলে সংগঠন মাঠে নামবে।
১৯৫৩ সালের ২৫ জুন কলকাতা ট্রাম কোম্পানির বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া পয়লা জুলাই থেকে এক পয়সা করে বৃদ্ধি পাবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এতে সমর্থন জানালে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ চরমে ওঠে। ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা কলকাতা কেঁপে ওঠে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একজোট হয় কলকাতার সমস্ত বাম দল। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগ দেয়, প্রজা সোশালিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, সোশালিস্ট ইউনিটি সেন্টার। সকলকে নিয়ে গঠিত হয় ট্রাম বাসের ভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ কমিটি। এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসু, সিপিআই নেতা জ্যোতি বসু, অন্যান্য বাম দল থেকে ছিলেন সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
জুলাইয়ের ১ তারিখ, যেদিন ট্রাম কোম্পানি নতুন ভাড়া চালু করার প্রস্তাব দেয়, সেদিন প্রতিরোধ কমিটি পুরনো ভাড়া দিয়েই ট্রামে চাপার ঘোষণা করে। ট্রাম কোম্পানি পুরনো ভাড়া নিতে অস্বীকার করলে প্রথম দিন বিনামূল্যে ট্রামে চড়েন অনেকে। দ্বিতীয় দিনও এরকম ঘটনা ঘটে। ২ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের তরফ থেকে আসে হুঁশিয়ারি। সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, ট্রামের নতুন নির্ধারিত ভাড়া অমান্য করায় সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার অলস ভাবে বসে থাকবে না। ৩ জুলাই কলকাতার নানা জায়গায় পিকেটিং এবং মিছিল চলে। আইন অমান্য আর পিকেটিংয়ের জন্য প্রতিরোধ কমিটির নেতা জ্যোতি বসু, গণেশ ঘোষ এবং সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ ৬০০ জনকে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। এর প্রতিবাদে ৪ জুলাই প্রতিরোধ কমিটি হরতালের ডাক দেয়। এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধি আর ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার গুঞ্জন সবমিলিয়ে বেশ কিছুটা চাপে পড়ে যায় ট্রাম কোম্পানি। অবস্থার অবনতি দেখে মেঘনাথ সাহা থেকে শুরু করে হীরেন মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে সমাধান করার জন্য উদ্যোগী হতে আহ্বান জানান।
৫ জুলাই আসানসোলে ইন্ডিয়ান স্টিল কোম্পানির বিক্ষোভরত শ্রমিকদের উপরে গুলি চালায় পুলিশ। এতে পাঁচজন নিহত হন এবং অনেকে আহত হন। ফুঁসে উঠে কলকাতার শ্রমিক শ্রেণি। ১৫ তারিখ সম্মিলিত হরতালের ডাক দেওয়া হয়। ১৬ তারিখ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। পুলিশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ যায় ১৮ বছর বয়সের এক ছাত্রের। ১৪৪ ধারা ভাঙতে ২২ জুলাই কলকাতার ময়দানে সমাবেশ ডাকা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তড়িঘড়ি জ্যোতি বসু এবং বাকি বন্দিদের মুক্তি দেয়। এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। ব্রিটিশদের থেকে পাওয়া স্বাধীনতা এবং দেশভাগের শরণার্থী সব মিলিয়ে কলকাতা তখন কংগ্রেসের হাত ছাড়া হতে শুরু করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠতে থাকে কলকাতা।
১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ কোম্পানিকে সরিয়ে ট্রাম কোম্পানির জাতীয়করণ করা হয়। উন্নয়নের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে নগরায়নের চাপে পড়ে এখন বেশ কিছু ট্রাম লাইন বন্ধ হয়েছে। অবশ্য ট্রামে যোগ হয়েছে বেশ কয়েকটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। এসি, এফএম রেডিও, লাল-নীল বাতি আর ফাইবার গ্লাসের সিলিং দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু ট্রামে। কিন্তু মোটরের চাপে আর শহরের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় নাগরিক জীবনে অনেকটাই ব্রাত্য হওয়ার পথে ট্রাম।
যে অল্প সংখ্যক ট্রাম টেনেটুনে রাস্তায় চলছে, সেগুলিকে প্রায়শই খালি দেখা যায়। রাস্তা ট্রাফিক সিগনালে ট্রামচালক আর কন্ডাকটরের চুটিয়ে গল্প করবার দৃশ্য চোখে পড়ে মাঝেমধ্যেই। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার আগে পরাধীন ভারতে ট্রাম পরিষেবা কলকাতা থেকে শুরু করে, ছড়িয়ে পড়েছিল দিল্লি, মুম্বই, নাসিক এবং অন্যান্য শহরে। কিন্তু ৬-এর দশকের শেষে এসে দেখা গেল ট্রাম একমাত্র টিকে রয়েছে কলকাতায়। তখন থেকেই ট্রাম বাতিলের পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রফুল্ল চন্দ্র সেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এই সময় হাওড়া থেকে প্রথম ট্রাম তুলে দেন। যদিও জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আবার ট্রাম পরিষেবা বৃদ্ধি পেয়ে একেবারে কলকাতার দক্ষিণ প্রান্ত জোকা অবধি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তৎকালীন সরকারের আমলেই একাধিকবার ট্রাম তুলে দেওয়ার প্রস্তাব আসতে থাকে।
আরও পড়ুন- শেষ মুহূর্তে চেয়েছিলেন একটু কমলালেবু, জীবনানন্দের মৃত্যুর পর পুড়ে যায় ‘ঘাতক’ ট্রামটিও
সুভাষ চক্রবর্তী পরিবহনমন্ত্রী থাকাকালীন সময় একবার শোনা গিয়েছিল টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। সেই সময় প্রতিবাদে নেমেছিলেন বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ট্রাম তুলে দেওয়া এবং ট্রামের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে নানা সরকারের নানা মত। বর্তমান সরকার কেবলমাত্র ঐতিহ্য হিসেবেই কলকাতায় ট্রাম চালাতে চায়। বৃহস্পতিবার বিধানসভায় ট্রাম দপ্তর সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী হাকিম বলেছিলেন, "এমন এমন জায়গায় কলকাতার ট্রাম চলছে যেখানে প্রচণ্ড যানজট হয়। রাস্তার মাঝখান দিয়ে ট্রাম চলার জন্য যানজট হয়। যেমন, চিৎপুর রোড এলাকায় ট্রাম যাতায়াতের জন্য সেখানে যানজট হচ্ছে। এখানে যদি ট্রাম চালাতে চাই তাহলে সারাদিন যানজট লেগেই থাকবে।" পরিবহন মন্ত্রী আরও বলেছেন, "কিছু কিছু জায়গায় আমরা হেরিটেজ হিসেবে ট্রাম চালাব। যেখানে যেখানে যানজট হবে না সেইসব জায়গায় আমরা ট্রাম চালাব। যেমন, খিদিরপুর থেকে ধর্মতলা, এই রুটে তেমন যানজট হয় না। এমন রাস্তায় ট্রাম চালাতে হবে যেখানে রাস্তা চওড়া, যেখানে এক অংশ দিয়ে ট্রাম যেতে পারবে কিন্তু কোনও রাস্তার মাঝখান দিয়ে ট্রাম যাবেনা।" ‘ট্রামের বদলে ওই ট্রামগুলিকে কাজে লাগিয়ে কলকাতায় ট্রলিবাস চালানোর কথা বলেছেন ফিরহাদ।পোল্যান্ডে ট্রলিবাসের অর্ডারও দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বের ট্রাম বনাম কলকাতা
পৃথিবীর আধুনিক রাষ্ট্রগুলির দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাব, প্রবল ব্যস্ত শহরগুলির মধ্যে কিন্তু আজও ট্রাম চলাচল করে। তা বিশ্বের প্রথম ট্রাম চলা শহর লন্ডন হোক কিংবা জার্মানির বাণিজ্য নগর ডাসেলডর্ফ, কিংবা নতুন করে ট্রাম চালু করা দুবাই বা তাইওয়ান ইত্যাদি। আমেরিকা, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে, অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত কম খরচের এই পরিবহন চালু বা পরিষেবা বৃদ্ধি করার কথা। ইন্টারনেটে তথ্য তালাশ করে জানা গিয়েছে, জার্মানিতে প্রায় ৬০ টি, চিনে ৯ টি, জাপানে ১৬ টি, আমেরিকায় ৩৫ টি, ফ্রান্সে ২৮ টি, পোল্যান্ডে ১৫ টি এবং ব্রিটেনে ১০টি অঞ্চল ছাড়াও বিশ্বের আরও কিছু শহরে ট্রাম পরিষেবা সেখানকার মানুষের অন্যতম পরিবহন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু কলকাতায় দুর্ভাগ্যবশত ট্রাম পরিষেবা প্রায় বন্ধের মুখে।
গতি এবং ব্যস্ততার কাছে হার মেনে এখন অনেকটাই কোণঠাসা ট্রাম। শহরে বাইক, মেট্রো, অটো এবং ক্যাবের ভিড়ে ট্রাম অনেকটাই ব্রাত্য। অথচ গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের দাপটে বিশ্বের উন্নত দেশগুলি যখন ট্রাম চলার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছে, তখন কলকাতা রীতিমতো ক্ষতবিক্ষত ট্রাম হারানোর যন্ত্রণায়। পরিবেশ প্রেমীদের সংগঠনগুলি বারবার কলকাতায় ট্রামের সপক্ষে কথা বলছেন। তবুও ট্রাম যেন মহানগরীর বুকে বোঝার মতোই। ট্রাম তুলে নেওয়ার যুক্তি যখন বারবার সাজানো হচ্ছে, তখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউনেস্কোর ইন্ডাস্ট্রিয়াল হেরিটেজ তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে ট্রামের। অনেকেই চান ট্রাম ফিরে আসুক। তিলোত্তমার বুকে জেগে উঠুক বিগত শতকের নস্টালজিয়া। এসপ্ল্যানেড বা গড়িয়াহাটে ট্রাম মিউজিয়ামে শুধু অস্তিত্ব খোঁজার বদলে, কবিতার মতো ট্রাম হয়ে উঠুক মানুষের নিত্যসঙ্গী। সেই টুংটাং বেলের শব্দ, রাতের অন্ধকারে মৃদু আলো এবং তার সঙ্গে শহরের বুকে নস্টালজিয়া, সব মিলিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার নিবিড় মুহূর্তের আবার সাক্ষী থাকুক ট্রাম। আনন্দ, দুঃখ, বদলে যাওয়া শহরের ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকুক ট্রাম।