মোদির রামমন্দির উদ্বোধনে কেন ব্রাত্য লালকৃষ্ণ আদবানিরা?
Ram Mandir Inauguration : লালকৃষ্ণ আদবানিকে অপছন্দ করার রাজনৈতিক কারণ রয়েছে নরেন্দ্র মোদির।
রিকোয়েস্টেড নট টু কাম। আপনাদের না আসার অনুরোধ জানাচ্ছি। এই ভাষাতেই রামজন্মভূমি আন্দোলনের দুই প্রাণপুরুষ লালকৃষ্ণ আদবানি ও মুরলিমনোহর যোশীকে বার্তা দিল মন্দির ট্রাস্ট। ব্যখ্যা, তাদের বয়স হয়েছে। কিন্তু সঙ্গত কারণেই এই যুক্তিতে চিঁড়ে ভিজছে না। কারণ এই একই অনুষ্ঠানে বহু অশীতিপরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, আসা না আসার সিদ্ধান্ত তো আদবানি যোশীর হাতেই ছেড়ে দিতে পারত উদ্যোক্তারা? তবে কি কোনো অদৃশ্য শক্তি ট্রাস্টকে দিয়ে এ কাজ করালো! লৌহপুরুষ এলে মোদি-শাহর উপর পড়া আলো ভাগ হয়ে যেতে পারে, সেই ভয়েই কি দূরে ঠেলে দেওয়া হলো লৌহপুরুষকে!
নরেন্দ্র মোদির মেন্টর লালকৃষ্ণ আদবানি এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ইন্টারনেটের দৌলতে ছোট বাচ্চারাও খুঁজে পাবে গুরু আদবানি শিষ্যমোদির যুগলভজনার ছবি। তিন দশক আগে আদবানিই রাম জন্মভূমি আন্দোলনের ঢেউ তুলতে সোমনাথ থেকে অযোধ্যার পথে রথযাত্রা করেছিলেন। অন্য দিকে মুরলি মনোহর যোশী ১৪টি রাজ্য জুড়ে একতা যাত্রা করে ১৯৯১ সালে বিজেপির সপক্ষে জনমত গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেই দুই প্রাণপুরুষকে যে আজ হঠাৎ ব্রাত্য করা হয়েছে তা নয়। রামমন্দিরের শিলান্যাস ও ভূমিপুজোর অনুষ্ঠানেও তাদের ডাকা হয়নি। আমন্ত্রণ জানানো দূরের কথা, ভিডিয়ো কনফারেন্সে পুজোয় শামিল হওয়ার আলাদা কোনও ব্যবস্থাও করা হয়নি। একই ভাবে বাদ পড়েন কল্যাণ সিং। বলা হয়েছিল, তিনি যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠানে না আসেন।
নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি দলের রাশ হাতে নেওয়ার পরই লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর জোশীর মতো প্রবীণ নেতাদের মার্গদর্শক মণ্ডলীতে স্থান দিয়ে রাজনৈতি সন্ন্যাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরে একটিও মার্গদর্শক মণ্ডলীর বৈঠক হয়নি।
মোদি শাহ যোশী আদবানির সঙ্গে দূরত্ব রাখেন বহুদিন ধরেই। নামও মুখে আনা হয় না তাদের। তবে স্যাকরার ঠুকঠাকের বদলে কামারের ঘা পড়ে ২০১৯ সালে। ৭৫ বছরের বেশি বয়সের নেতাদের সেবার লোকসভা ভোটে টিকিট দেয়নি বিজেপি। সেই সূত্রেই প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন গাঁধীনগর থেকে পর পর ছ’বার জয়ী সাংসদ লালকৃষ্ণ আদবানি এবং কানপুরের সাংসদ মুরলীমনোহর জোশী। আর সেই গাঁধীনগরেই টিকিট দেওয়া হয় অমিত শাহকে। পরিষ্কার বুঝিয় দেওয়া হয়, আদবানি যোশী নয়, মোদি-শাহই মুখ সর্বত্র।
সে সময় যোশী ক্ষোভ প্রকাশ করে স্পষ্ট বলেন তাঁকে টিকিট দেওয়া হয়নি । প্রথম দিকে আদবানি প্রকাশ্যে কিছু না বললেও গত সপ্তাহেই ব্লগে নিজের ক্ষোভের কথা লেখেন। তারপর ক্রমে অন্তরালেই চলে গিয়েছেন ওরা। জন্মদিনে ছেলেভোলানো শুভেচ্ছাই বরাদ্দ ওদের জন্য।
সামনে লোকসভা ভোট। রামমন্দিরের সমস্ত কৃতিত্ব নিতে চান মোদি-শাহ। অনেকটা ঠিক বালাকোটের মতো এটাই এবার পাখির চোখ। সেই পিঠ চাপড়ানির ভাগ অন্য কেউ নিলেই গোলমাল। তাই কি যোশী-আদবানীর মতো প্রবীণদের ছায়াকেও ভয়? কেন এই রাজনীতি? 'বাংলা যা ভাবছে' অনুষ্ঠানে মতামত রাখলেন আমাদের আলোচকেরা।
সুমন ভট্টাচার্য
লালকৃষ্ণ আদবানিকে অপছন্দ করার রাজনৈতিক কারণ রয়েছে নরেন্দ্র মোদির। আদবানি পাকিস্তানে গিয়ে জিন্নার সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেন, তখন থেকেই সংঘের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হয়। সংঘ ঠিক করে মোদিকে বিজেপির মুখপাত্র হিসাবে তুলে ধরা হবে। ২০১৪-তে বিজেপির শীর্ষ সম্পাদক মণ্ডলী যে সভায় মোদির নাম ঘোষণা করেন, তা বয়কট করেছিলেন আদবানি। তিনি মনে বিজেপি আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনবে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। ফলে খুব অসন্তুষ্ট হন আদবানি। কিন্তু সংঘ এবং মোদি সেই পরিকল্পনা সত্যি হতে দিল না। এখন আদবানির সমর্থক দলে আর তেমন আর কেউ নেই। আদবানির আশা ছিল, প্রধানমন্ত্রী না হতে পারলেও তিনি রাষ্ট্রপতি হবেন। হতে দেননি মোদি। মোদি কেবলমাত্র নিজের সমর্থকদেরই রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছেন। যাতে কোনও রকম বাধা না আসতে পারে। রাজনীতিতে গুরুর পরিচয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। মোদির গুরু লালকৃষ্ণ আদবানি। মোদিকে যখন অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন বরখাস্ত করেই দিয়েছিলেন প্রায়, আদবানিই তাঁকে রক্ষা করেন। অতএব এত শক্তিশালী একজন নেতাকে মুছে ফেলতে না পারলে মোদির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। ক্ষমতায় দীর্ঘদিন একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে গেলে গুরুকে সরিয়ে দেওয়াটা প্রয়োজন। হিন্দুত্বের রাজনীতি কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী টিকিয়ে রাখতে পছন্দ করে না। এই মুছে ফেলার কাজ খুব সফলভাবে করতে পেরেছেন মোদি-শাহ'রা। তার সঙ্গে থাকছে ভোগবাদী সুবিধা। সেই সুবিধার কাছে বিকিয়ে যাচ্ছে সংঘের আদর্শ। আদর্শ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তাই তারাও মোদি-শাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে না।
সম্বিত পাল
যে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে দিতে পারবে তাকেই যে বেশি গুরুত্ব দেবে সংঘ, সেটা এখন পরিষ্কার। সেইজন্যেই মোদি এতটা সমর্থন পাচ্ছেন। আদবানি বা যোশীর আর সেই ক্ষমতাও নেই আজ। তাই তারা ব্রাত্য। অথচ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঝোঁকটা বুঝে বিজেপিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন আদবানিই। রামমন্দির গঠনের প্রথম স্লোগান তুলেছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। আদবানি সেটাকে গ্রহণ করলেন, ব্যবহার করলেন। রামজন্মভূমির ভিত্তি আদবানির নিজের হাতে গড়া। অন্যদিকে মুরলী মনোহর যোশী সে সময় বিজেপির জাতীয় সভাপতি। তার সময়েই বাবরি ধ্বংস হচ্ছে। একতা যাত্রা হচ্ছে। বরাবর সংঘের নিষ্ঠাবান কর্মী তিনি। নিজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হয়েও যেভাবে শিক্ষার যথেষ্ট গৈরিকিকরণ করেছেন, তা সংঘকে প্রচুর পরিমাণে সাহায্য করেছে। এই দুজনকে ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে! অদ্ভুত একটা সিদ্ধান্ত। হিন্দুত্বকে তাঁদের মতো করে একটা স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন আদবানি ও যোশী। কিন্তু মোদি-শাহ'র হিন্দুত্ব তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ আমলে সুপ্রিম কোর্টও সরকারের সমস্ত পদক্ষেপ সমর্থন করছে। সংঘের প্রায় সমস্ত ইচ্ছেই পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এ আমলে, বাস্তবায়িত হচ্ছে বিজেপির ম্যানিফেস্টোও। ফলে মোদির পথে কোনও কাঁটা থাকতে দেবে না সংঘ বা বিজেপি। মোদির আত্মপ্রেমকে একরকম ব্যবহারই করছে সংঘ। তারা বিপন্ন বলে মনে হয় না। বরং ২০২৫-এ শতবর্ষ উদযাপন করবে তারা। এবং প্রায় একই সঙ্গে যে কমিউনিস্টদের যাত্রা শুরু, সর্বভারতীয় স্তরে সেই শত্রুদের অবস্থা তাদের নিশ্চয়ই আনন্দ দিচ্ছে। সংঘের একশো বছরের স্বপ্ন সফল করছে বিজেপি।
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য
সংঘ যা চেয়েছিল তার শ্রেষ্ঠ প্রয়োগ করছেন মোদি-শাহ'রা। আদবানিদের অবস্থানের মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক ভাব রাখতে তাঁরা সম্ভবত বাধ্য হয়েছিলেন। যে যুগে তাঁরা রাজনীতি করেছিলেন সে সময় গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি বজায় রাখার একটা চাপ কাজ করত। কিন্তু সে যুগ বদলে গেছে। বিজেপির সাংগঠনিক গঠনেও একটা মূলগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগামী কিছুদিন বিজেপি সংগঠন, ক্ষমতা সবই বাড়বে। কিন্তু দূরপাল্লার নিরিখে ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে বিজেপি। বিজেপির অন্যতম শক্তি ছিল আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র। সেটা আর নেই। এ জিনিস ভারতবর্ষে কেবল বামদলগুলির মধ্যে পাওয়া যেত। আর ছিল বিজেপির মধ্যে। বাকি সমস্ত দল একনায়কতন্ত্রের দল। গণতন্ত্র ছিল বলেই রাজনাথ সিং মোদিকে জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এখন সবটাই অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদি। তাঁদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। এদেশে ব্যক্তিপূজার একটা ঝোঁক আছেই। তা আরও সাহায্য করেছে। সংঘও সমর্থন করছে, কারণ দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে মোদি-শাহ'রা সমালোচিত হতে পারেন। সংঘও সেটা চাইছে না। তবে বালাকোট বা পুলওয়ামা যেভাবে সমগ্র দেশকে এক করেছিল, মানুষ নিরাপত্তার কথা ভেবে ভোট দিয়েছিলেন, রামমন্দিরের উদ্দীপনা তা পারবে না। উত্তর ভারতে ভোট টানবে ঠিকই, কিন্তু দক্ষিণে বা উত্তর-পূর্বে এ নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন উন্মাদনা সৃষ্টি না হওয়াই স্বাভাবিক। তাই আমার ধারণা, আস্তিনের নিচে আরও কিছু তাস লুকানো রয়েছে। যা আমরা ধীরে ধীরে দেখতে পাব। নির্বাচন যত এগোবে, সেগুলি প্রয়োগ করা হবে।