ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের গণেশপুজোয় মোদি! ভারতের প্রধান বিচারপতি আদৌ নিরপেক্ষ?

Modi Chandrachud: প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির 'একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা'-ও ভুল কারণ সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্ব ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধগুলিকে বজায় রাখা।

সুপ্রিম কোর্ট কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে? দেশে এই সওয়াল বারেবারেই উঠেছে, বিশেষত সাম্প্রতিক কালে। দেশের শীর্ষ আদালতের উপর কথা বলা যায় না। মহামান্য আদালতকে মেনে চলতে হয় কিন্তু আদালতও কি কাউকে মেনে চলে? নিরপেক্ষতার প্রশ্নে আদালত কি আপোস করে নেয় কখনও সখনও? এই মুহূর্তে এই প্রশ্ন আবারও চাগাড় দিয়েছে। সম্প্রতি গণেশ পুজো পেরিয়েছে। বাড়িতে গণেশ পুজো করেছেন দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। সেই পুজোয় অংশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গণেশের সামনে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ও মোদির ছবিও ভাইরাল হয়েছে। এইখানেই উঠছে প্রশ্ন। এমনটা কি করা যায়? দেশের আইনজীবীদের একাংশ এবং বিরোধী নেতারা এখানেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু কীসের উদ্বেগ? একজন প্রধানমন্ত্রী কি প্রধান বিচারপতির বাড়িতে আমন্ত্রিত হতে পারেন না? আনুষ্ঠানিক সৌজন্য দেখাতে পারেন না? দুইজনে পাশাপাশি বসতে পারেন না? তেমনটা হলেই গেল গেল রব উঠবে কেন? গত বুধবার সন্ধ্যায়, প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এবং তাঁর স্ত্রী কল্পনা দাসের দিল্লির বাড়িতে নরেন্দ্র মোদি যান। তারা মোদিকে স্বাগত জানান। এরপর প্রধান বিচারপতি ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আরতিতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। সবটাই ধরা আছে ভিডিওতে। অনেক আইনজীবী ও বিরোধী দলের নেতারা বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর সরকারের হস্তক্ষেপ এখানেই প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। প্রাক্তন অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ইন্দিরা জয়সিং অভিযোগ করেছেন, রাজনীতি এবং বিচার বিভাগের মধ্যে যে ক্ষমতার ফারাক রয়েছে, তার সঙ্গে আপোস করেছেন চন্দ্রচূড়।

আরও পড়ুন- আয়ুর্বেদ ডায়েট, যোগব্যায়াম! চমকে দেবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির রুটিন

ইন্দিরা জয়সিং বলছেন, "ভারতের প্রধান বিচারপতির স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি সমস্ত আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনকে অবশ্যই প্রধান বিচারপতির স্বাধীনতার এই প্রকাশ্যে আপোসের নিন্দা জানাতে হবে।" বর্ষীয়ান আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের অভিযোগ, ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বিচারকদের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। একটি ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির বাড়িতে যাওয়া মোদির পক্ষেও 'সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত'। প্রশান্ত ভূষণের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির 'একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা'-ও ভুল কারণ সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্ব ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধগুলিকে বজায় রাখা। প্রশ্ন উঠছে, কোনও নির্দিষ্ট ধর্মাচারণ যে কেউ ব্যক্তিগতভাবে করতেই পারেন। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের প্রধান বিচারপতি কি তা প্রকাশ্যে জাহির করতে পারেন? তাতে কি সমান নিরপেক্ষতা বজায় থাকে আদৌ?

 

শিবসেনার (উদ্ধব-বালাসাহেব ঠাকরের শিবির) সাংসদ সঞ্জয় রাউত বলছেন, সংবিধানের একজন রক্ষক অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি যদি এইভাবে কোনও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তাহলে তা জনগণের মনে সন্দেহ তৈরি করতে পারে। মোদি-চন্দ্রচূড়ের এই গণেশ বন্দনা দেখে সঞ্জয় রাউত প্রশ্ন তুলেছেন, উদ্ধব সেনাকে আদৌ কি 'ন্যায়বিচার' দিতে পারবেন প্রধান বিচারপতি? মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বের শিবসেনা দলকে বৈধ শিবসেনা দল হিসাবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন যে রায় দিয়েছে তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে উদ্ধব সেনার শিবির। সঞ্জয় রাউত দাবি করেছেন, প্রধান বিচারপতিকে এমন একটি মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতেই হবে। উদ্ধব সেনা সাংসদ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীও প্রশ্ন করেছেন, এসব উৎসব পালন সাঙ্গ হলে প্রধান বিচারপতি কি মামলার 'স্বাধীন' বিচার করতে পারবেন।

বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের সদস্যরা বলছেন, মোদির সফরকে এভাবে রাজনীতিকরণ করা সম্পূর্ণ ভুল। স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেসের উদাহরণ টেনে এনেছে বিজেপি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁর আমলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কোন কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন সেসব উদাহরণ টেনে এনেছে বিজেপি।

আরও পড়ুন- আরজি কর ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডে কি পিতৃতন্ত্রকেই বাঁচাতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট?

রাজ্যসভার সাংসদ এবং শিন্দে সেনা শিবিরের মিলিন্দ দেওরা বলেছেন, যখন বিরোধীদের পক্ষে রায় হয়, বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশংসা করে, কিন্তু "যখন বিরোধীদের পছন্দমতো রায় হয় না, তখন তারা সুবিধামতো দাবি করে যে বিচার বিভাগ আপোস করেছে।" মিলিন্দ দেওরা বলেছেন, মহারাষ্ট্রে ১০ দিনের গণেশ চতুর্থী উত্সবের সময়, লোকজন তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়িতেও যান। ২০০৯ সালে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেজি বালকৃষ্ণণ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কর্তৃক আয়োজিত একটি ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।

 

বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যও প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির ওই ইফতার পার্টিতে অংশ নেওয়া নিয়ে কথা বলেছেন। অমিত মালব্যর অভিযোগ, কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের সমস্যা আসলে গণেশ চতুর্থীর উত্সব নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির মধ্যেকার সৌহার্দ্য নিয়ে তাঁদের তেমন মাথাব্যথা নেই।

প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বালকৃষ্ণণ কী বলছেন? ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কর্তৃক আয়োজিত ইফতার পার্টিতে তাঁর উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, "এই ধরনের ইফতার পার্টিতে যোগ দিতে কোনও সমস্যা নেই।" কিন্তু প্রধান বিচারপতির বাসভবনে প্রধানমন্ত্রীর সফর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন থাকে। বিচার বিভাগীয় আচরণবিধিতে বিচারকদের দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রকাশ্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির অংশগ্রহণ এই বিধির লঙ্ঘন তো বটেই।

আইনজীবী তথা সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কপিল সিবাল বলছেন, প্রধান বিচারপতির এতে দোষ নেই। দোষ প্রধানমন্ত্রী মোদির যে তিনি এমন আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কপিল সিবাল বলছেন, “মহারাষ্ট্রে একটি নির্বাচন হতে চলেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কোনও ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের যাওয়ার উপযুক্ত সময় এটা ছিল না।” সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারক অজয় রাস্তোগি অবশ্য বলছেন, একটা পুজোয় যোগ দিলেই কেউ প্রভাবিত হয়ে যায় না। যিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারকের পদে রয়েছেন তিনি একটি বৈঠকেই প্রভাবিত হয়ে যাবেন এমনটা নিছকই কষ্টকল্পনা।

More Articles