রাজা আসে রাজা যায়, চাঁদে আর পা পড়ে না মানুষের
Moon Mission: ১৯৬৯ সালে মানুষ যদি চাঁদে যেতে পারে, তাহলে প্রযুক্তির এমন অগ্রগতির যুগে মানুষ কেন চাঁদে যায় না আর?
'কে প্রথম চাঁদে গেছে বলো তো নাম?' সেই প্রশ্নটার উত্তর গানের মতোই আমাদের কাছে চেনা। নীল আর্মস্ট্রং। কার্যত 'চাঁদে পা' শব্দের সমার্থক আমাদের কাছে এই নাম। আর কে না জানে, সবসময় প্রথম স্থানাধিকারীদেরই মনে রেখেছে এ পৃথিবী। ফলে চন্দ্রাভিযান মানেই আমাদের কাছে নীল আর্মস্ট্রং, আর নীল আর্মস্ট্রং মানেই চাঁদে পাড়ি! কিন্তু সত্যিই কি তাই! মানুষের চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ার আলোচনায় সব সময়ে আমরা নীল আর্মস্ট্রং-কে নিয়েই চর্চা করি। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসের অ্যাপোলো ইলেভেন মিশন নিয়েই যাবতীয় কৌতুহল, আলোচনা, বিতর্ক, তত্ত্ব। কিন্তু তার পরেও আমরা চাঁদে গিয়েছি। একবার, দু'বার নয়, পাঁচ পাঁচ বার গিয়েছি।
...I'm on the surface; and, as I take man's last step from the surface, back home for some time to come - but we believe not too long into the future - I'd like to just [say] what I believe history will record. That America's challenge of today has forged man's destiny of tomorrow. And, as we leave the Moon at Taurus-Littrow, we leave as we came and, God willing, as we shall return, with peace and hope for all mankind. Godspeed the crew of Apollo 17.
'ইতিহাসের কাছে সব দলিল জমা থাকে।' এমনটাই মনে করতেন ইউজিন কারম্যান। চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে নীল আর্মস্ট্রং যেমন ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন , তেমনইএখনও পর্যন্ত চাঁদের মাটিতে মানুষের শেষ অভিযানের শেষ অভিযাত্রী ইউজিন। 'চাঁদে পাড়ি দেওয়ার যে ঝুঁকি সেদিন আমেরিকা নিয়েছিল, তা আসলে বুনে দেবে আপামর সভ্যতার ভবিষ্যতের মাটি', বলেছিলেন ইউজিন। মিথ্যা বলেননি। চাঁদে ঠিকঠাক পাড়ি জমাতে পারলে ভবিষ্যত কী হত বলা কঠিন, তবে মানুষের সামনে নতুন একটা দিগন্ত যে খুলে যেত, তা বলার অবকাশ থাকে না। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে, নাসার অ্যাপোলো-১৭ মিশনই এখনও পর্যন্ত শেষ চন্দ্রমা অভিযান, যেখানে মানুষ চাঁদের মাটি থেকে পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ করেছে, নিজের হাতে নিয়ে এসেছে চাঁদের মাটি।
আরও শুনুন: চাঁদে কি আদৌ কোনও দিন পা দিয়েছিলেন নীল আর্মস্ট্রং?
তবে এত বছর পরেও চাঁদ নিয়ে মানুষের আগ্রহে কোনও রকম ঘাটতি পড়েনি। এত কিছুর পরেও চাঁদকে ঘিরে আজও কৌতুহলের শেষ নেই মানুষের। কবির কল্পনা, প্রেমিকের উপমা, আর মহাকাশবিজ্ঞানীদের কাছে অপরিসীম রহস্য। চাঁদের উদ্দেশে অভিযান তাই আজও চলছে। আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ইউরোপ, কে যায়নি চাঁদে। এমনকী সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছে আমাদের দেশও। কিন্তু, গত পঞ্চাশ বছরে একটি অভিযানেও মানুষ যায়নি।
কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। নাসা তো অ্যাপোলো-২০ মিশন অবধি পরিকল্পনা করেই রেখেছিল। তাহলে ঠিক কী কারণে বন্ধ হল মানুষের চাঁদে যাওয়া? তাহলে কি নিন্দুকদের দাবিটাই সত্যি। ওয়াকিবহাল মহলের একটি অংশের দাবি, মানুষ আদতে কোনওদিনই চাঁদে যায়নি। নাসা অ্যাপোলো 11 মিশনের গোড়াতেই নাকি রয়েছে ধোঁকা। আসলে নাকি মার্কিন চিত্র পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিককে দিয়ে গোটাটা শুট করানো হয়েছিল। এই দাবিগুলো কি সত্যি? আরও একটা প্রশ্ন তো জাগেই। সেই ১৯৬৯ সালে মানুষ যদি চাঁদে যেতে পারে, তাহলে প্রযুক্তির এমন অগ্রগতির যুগে মানুষ কেন চাঁদে যায় না আর?
না, কোনও রকমের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা এখানে নেই। তবে একটা কথাই বলা যায়, সেদিনের অভিযানের গোটাটা যদি সাজানোই হত, তাহলে বিগত ৫০ বছরে আরও পাঁচটা অ্যাপলো মিশন সাজিয়ে নেওয়া যেত নাকি! কুব্রিক ইহলোক ত্যাগ করেছেন তো কী হয়েছে? স্পিলবার্গ বা জেমস ক্যামেরুনের মতো বিশ্বমানের সিনেমানির্মাতারা কি ছিলেন না?
We choose to go to the moon. We choose to go to the moon in this decade and do the other things, not because they are easy, but because they are hard, because that goal will serve to organize and measure the best of our energies and skills, because that challenge is one that we are willing to accept, one we are unwilling to postpone, and one which we intend to win, and the others, too.
সকলেই চাঁদকে জয় করতে চেয়েছে। তার জন্য চেষ্টাও কম হয়নি। একটা সময় এই চন্দ্রাভিযান ছিল জয়ী দেশের স্মারকও। ১৯৬১ সালের ২৫ মে। মার্কিন কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি করলেন এমনই এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। গোটা বিশ্বকে তিনি জানিয়ে দিলেন, মানবজাতির পা এবার পৃথিবীর বাইরে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে তাঁর দেশ আমেরিকা। বীরদর্পে জানালেন, ষাটের দশক শেষ হওয়ার আগেই চাঁদ জয় করবে মানুষ। কিন্তু তিনি কি সমগ্র মানবজাতিকে তারাদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ থেকে এই ঘোষণা করেছিলেন?
উত্তরটা হল, না। মানবসভ্যতাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার কোনও তাগিদ তাঁর ছিল না। বরং প্রয়োজন ছিল অন্য। উন্নাসিক আমেরিকা তখনও বেশ পিছিয়ে। কারণ ততদিনে মাথার ওপর দিয়ে চরম শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট স্পুটনিক চলে গিয়েছে। সেটা জেনেও কিছু করার উপায় নেই তাদের। যুদ্ধে গোহারান হারছে আমেরিকা।
ঠান্ডা যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। শুধু গোলাবারুদের যুদ্ধই নয়, যত দিক দিয়ে সম্ভব, সব রকম ভাবেই যুদ্ধ চলছে। তা সে কূটনৈতিক ভাবেই হোক, বা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। এমনকী সিনেমার ময়দানে রীতিমতো যুদ্ধ চালাচ্ছে দুই দেশ। স্বাভাবিকভাবেই, মহাকাশকে জয় করার জন্যে যে দৌড় শুরু হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আশা ছিল, তা হচ্ছিল না একেবারেই। উল্টে সোভিয়েত বলে বলে গোল দিয়ে চলছিল আমেরিকাকে। ফুটবলের ভাষায় যাকে বলে, প্রথম অর্ধেই পাঁচ গোল খেয়ে বসে ছিল আমেরিকা। কেনেডির এই ভাষণের ঠিক এক মাস আগেই, ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল এ ইউরি গ্যাগারিনকে প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে পাঠিয়ে দিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তার চার বছর আগে তারাই প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিককে পাঠায় পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে। আর পর পর এই সমস্ত ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছিল আমেরিকাকে। বিশেষ করে আলোড়ন সৃষ্টি করল গ্যাগারিনের মহাকাশ যাত্রা। প্রবল রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ল মার্কিন সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই কেনেডির পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দেওয়ালে। ঠিক তার পরেই, ৫ মে নভশ্চর অ্যালন শেফার্ডকে মহাকাশে পাঠাল আমেরিকা। আর আবারও প্রথম হওয়া হল না আমেরিকার। যা তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ ছিল না।
সঙ্গে সঙ্গেই উপরাষ্ট্রপতি জনসন এবং নাসার আধিকারিকদের সাথে জরুরি বৈঠকে বসলেন কেনেডি। উদ্দেশ্য এমন কিছু পরিকল্পনা করা, যা ইতিহাসের পাতায় প্রথম হিসেবে স্থান করে দেবে আমেরিকাকে। অনেক আলোচনার পরে সিদ্ধান্তে আসা গেল, চাঁদের মাটিতে প্রথম দেশ হিসেবে পা দেবে আমেরিকা। ভীষণই কঠিন এক লক্ষ্য, কিন্তু সেটাই একমাত্র উপায় সোভিয়েতকে পাঁচ গোল ফেরত দেওয়ার। এই প্রকল্প ছিল বিশাল, শুধু মাত্র ধারে-ভারে নয়, টাকার অঙ্কের দিক থেকেও। এতটাই বড়, যে এর সঙ্গে পানামা খাল খনন, বা প্রথম পরমাণু বোমা বানানোর প্রকল্পকেই শুধু তুলনা করা যেতে পারে। এতটাই বড়, যে সেসময় আমেরিকার সমগ্র বাজেটের চার শতাংশ বরাদ্দ ছিল শুধু মাত্র নাসার জন্যে, যা এই মুহূর্তে মাত্র 0.৪ শতাংশ।
অবশেষে এল সেই দিন। পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদে পা রাখল আমেরিকা। নাসা অবশ্য তার পরে আরো পাঁচটি অভিযান চালায় এবং ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ১২ জন নভোশ্চরকে চাঁদের মাটিতে পাঠায়। পরিকল্পনা ছিল আরও অভিযানের, অ্যাপোলো-২০ মিশন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ছকাও ছিল তাদের। কিন্তু বাধ সাধল মার্কিন জনতা। সোভিয়েতের সঙ্গে এই মহাকাশের দৌড়ে আর আগ্রহী ছিল না তাঁরা। আজকের অঙ্কে প্রায় দেড়শো বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গিয়েছিল সমস্ত অ্যাপোলো মিশন মিলিয়ে। ইতিমধ্যেই অ্যাপোলো-১৩-র অভিযান ব্যর্থ হয়। সেই অভিযানে সামিল হওয়া নভশ্চরেরা কোনো রকমে প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে ফেরেন। এরই মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের এক অন্য প্রান্ত খুলে গেল আমেরিকার সামনে। ভিয়েতনামের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াল আমেরিকা। যুদ্ধ মানেই খরচ। ফলে সেই খরচ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিল মার্কিন সরকার। ফলে যুদ্ধের বিপুল খরচের পাশাপাশি এত ব্যয়বহুল চন্দ্রমা অভিযান চালাতে আমেরিকার সরকার বা জনতা, কেউই আগ্রহী ছিল। ফলে বন্ধ হয়ে গেল সেই বারের মত অ্যাপোলো যাত্রা। আর এর দু'দশকের মধ্যে পতন ঘটল সোভিয়েতের। ফলে না রইল বাঁশ, না বাজল বাঁশি। শত্রুর পতনের সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়দৌড়ের প্রয়োজনও শেষ হয়ে গেল আমেরিকার।
এমন নয় যে, মহাকাশ অভিযান বা গবেষণা থেকেই পিছিয়ে এল আমেরিকা। এমনকী চাঁদের প্রতিও তার আগ্রহ কমল। কিন্তু মানুষকে চাঁদে পাঠানোর প্রয়োজন, সেই সময়ের মত গেল ফুরিয়ে গেল। অথচ মজার কথা, আমাদের মানবসভ্যতা যুদ্ধে তার থেকে দশ গুণ বেশি অর্থ খরচ করে প্রতি বছর। কিন্তু সভ্যতা, বিজ্ঞানকে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টার পিছনে অত অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন অনুভব করলেন না রাষ্ট্রপ্রধানেরা। বিশেষ করে আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলি তো বটেই।
এরপর নতুন শতকের শুরুতে ফের চাঁদে ফেরত যাওয়ার পরিকল্পনা পেশ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, ২০২০ সালের মধ্যে মানুষকে আবার চাঁদে পাঠানোর। ২০০৪ সালে বুশ কনস্টিলেশন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করলেন। তার পরবর্তী পাঁচ বছরে নাসা প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করে নতুন মহাকাশযান 'ওরায়ন'-কে প্রস্তুত করে ফেলে। কিন্তু পথে ফের কাঁটা। ২০০৯ সালে বারাক ওবামার সরকার একটি রিপোর্টে জানাল, বুশ প্রশাসনের প্রকল্পের পরিকল্পনা ত্রুটিপূর্ণ। এবং তার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তা একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। ফলে ফের ঘেঁটে গেল ২০২০ সালের মধ্যে চাঁদে যাওয়ার পরিকল্পনা। ওবামা জানালেন, চাঁদের পরিবর্তে বরং তাঁরা পা দেবেন পৃথিবীর কাছাকাছি প্রদক্ষিণ করা কোনও গ্রহাণুতে।
২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বদলে গেল গদি। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর প্রেসিডেন্ট পদে বসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবং একই ভাবে তিনিও তাঁর পূর্বসুরীর পরিকল্পনা খারিজ করে জানালেন, যে মানুষ গ্রহাণু নয়, চাঁদের মাটিতেই ফের পা দেবে। ঘোষণা হয় আর্টেমিস প্রকল্পের। আর সেই প্রকল্প অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে ফের চাঁদের মাটিতে পা রাখার কথা মহাকাশচারীদের।
এই রাজনৈতিক চাপানউতরের ফলে বার বার ব্যহত হয়েছে নাসার পরিকল্পনা। বিপুল পরিমাণ অর্থব্যায় হয়েথে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। সৌভাগ্যবশত জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হয়ে অনেক পরিকল্পনায় বদল আনলেও এখনও পর্যন্ত চাঁদে যাওয়ার পরিকল্পনা খারিজ করেননি। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরই বাস্তবায়িত হতে চলেছে আর্টেমিস প্রকল্প। চাঁদের মাটিতে পা রাখতে চলেছেন চার মার্কিন নভশ্চর। শুধু তাই নয়, এই অভিযানে অংশ নিতে চলেছেন নভশ্চর খ্রিস্টিনা কোচ। আর এই অভিযান সফল হলে তিনিই হবেন প্রথম মহিলা, যিনি চাঁদের মাটিতে পা রাখবেন।
তবে মানুষের চাঁদে অভিযানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণ বা সাধারণ মানুষের অনীহা রয়েছে তা নয়। অর্থের সমস্যাও বড় কথা নয়। কিন্তু সবার প্রথমে মনে রাখতে হবে, চন্দ্রাভিযান কোনও সহজ কাজ নয়। বিশেষত নভোশ্চরদের জন্য তো বটেই। নভশ্চরদের সুরক্ষিত ভাবে নিয়ে যাওয়া এবং ফেরত নিয়ে আসার মত ঝুঁকি রয়েছে যে কাজে, সেখানে বাধা আসাটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞান বা সভ্যতা এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছয়নি, যেখানে মহাকাশের সমস্ত কঠিন প্রশ্নের উত্তর তার কাছে থাকবে। তা সে মহাকর্ষই হোক বা তেজস্ক্রিয়তা। একবার ভাবুন তো, সাড়ে চারশো কোটি বছর পুরনো এক মহাকাশীয় বস্তু, যা বিশাল বিশাল খাদ, খানাখন্দে পরিপূর্ণ, তাতে পা রাখার কাজটা আদপেই কি সহজ? চাঁদের মাটিতে এমন অনেক জায়গাই রয়েছে, যেখানে কোটি কোটি বছর ধরে গ্রহাণুর আঘাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছে কয়েক মিটার ধুলিকনার স্তর। তার উপর চাঁদে কোনো বায়বীয় পরিমন্ডল নেই। মাসের ১৪ দিন সেখানে ভীষণ তাপমাত্রা, এবং বাকি ১৪ দিন ভয়াবহ শীতল। এই সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে প্রয়োজন প্রচুর অর্থ এবং অবশ্যই রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার। যা গত পঞ্চাশ বছরে নাসা পায়নি।
বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের কাছে এমন অনেক তথ্য এনে দিয়েছে, যা এককালে ছিল সম্পূর্ণ অজানা। আগামী কয়েক কোটি বছরে পৃথিবীর ভবিষ্যত ঠিক কোন দিকে যেতে চলেছে, সামান্য হলেও তার একটা আঁচ আমরা আজকের দিনে পাই। আজ আমরা জানি, মানবজাতির ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে, পৃথিবীকে ভালো রাখতে পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মহাকাশে বেরিয়ে পড়া কতটা জরুরি। কারণ অধিক ব্যবহারে পৃথিবীর প্রায় নিঃশেষিত। হু হু করে বাড়ছে দূষণ। বাড়ছে বিশ্ব উষ্ণায়ণ। গলে যাচ্ছে সমস্ত হিমবাহ। বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। পৃথিবীর শেষ ঘণ্টা বেজে গিয়েছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। অনেকেরই দাবি এর পরেই শুরু হবে 'মাস এক্সটিংশন'। একদিন ডায়নোসরের যে অবস্থা হয়েছিল, তেমন অবস্থা হবে মানুষেরও। ফলে আগেভাগেই খুঁজে রাখতে হবে নয়া বাসস্থান। তা হয়তো এখানে নয়, অন্য কোথা অন্য কোনও খানে। হয়তো গ্রহান্তরে। একই সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন, পৃথিবীকে দূষণ থেকে বাঁচাতেও আমাদের পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মহাকাশে যাওয়া প্রয়োজন। কারণ গ্রহাণু এবং চাঁদে রয়েছে সেই সমস্ত কিছু যা আমাদের মানুষের প্রয়োজন। মানুষ সত্যিই যদি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে সেই স্তরে যদি উন্নীত করতে পারে, তাহলে আগামিদিনে হয়েতো কোনও কিছুর জন্যেই পৃথিবীতে আর খনন করতে হবে না। বরং সমস্ত কিছুই প্রস্তুত হবে মহাকাশে এবং পৃথিবী থাকবে দূষণমুক্ত। সত্যিই সেই দিনটা আসবে কিনা তা অবশ্য অন্য প্রশ্ন।
আরও শুনুন: চাঁদে যেতে গিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলেন ওঁরা
তবে মানবজাতিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরবর্তী স্তরে পৌঁছতে হলে মহাকাশে নিজেদের অস্তিত্বকে মজবুত করার প্রয়োজন আছে বৈকি। পৌঁছে যাওয়া প্রয়োজন চাঁদে। আর এসব কাজের জন্য যেমন রাজনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন জনমতেরও। তবে তার জন্য গোড়াতেই প্রয়োজন বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা। মানুষকে আরও বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে, বুঝতে হবে এই ধরনের অভিযানের গুরুত্ব। এক এক করে মহাকাশে অস্তিত্ব বৃদ্ধি করতে হবে মানুষকে। একই সঙ্গে চাঁদে এবং মঙ্গলে পা রাখতে হবে আমাদের। সেই সঙ্গে শুরু করতে হবে গ্রহাণু খনন। এ সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিপুল অর্থের। আর সেই অর্থ তো মহাকাশ থেকে পড়ে না। এ টাকা মানুষের কষ্টোপার্জিত রোজগারের টাকা, যা আয়কর হিসেবে সরকারকে দেন নাগরিকেরা। সেই টাকা যে আসলে ভস্মে যাচ্ছে না, সেই ভরসাটুকু তাঁদের জোগানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের। তবেই মানুষ একটু একটু করে এগিয়ে যাবে আরও একটু সামনের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে।