সমলিঙ্গে বিয়ে করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় দাবি নয়
Same Sex Marriage : পাঁচ বছরের মধ্যে সমলিঙ্গে বিবাহকে আদালত মান্য়তা দিয়ে দেবে, এমন ভাবনাটাও একটু বেশি রকমের প্রত্যাশা।
একটা ছবি বানিয়েছি। ছবিটার নাম বিয়ন্ড দ্য ব্লু। একজন ট্রান্সম্যানকে নিয়ে। পড়শি নীলের আরশিনগর। সেখানে একটা দৃশ্য আছে, একটা ফুটেজ আছে যা ভয়ঙ্কর। প্রথম কয়েকবার আমি একা বসে দেখতে পারতাম না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখতাম। মনের ভিতর এতটাই ধাক্কা দিত দৃশ্যটা।
পরিবার এসেছে একটা বড় গাড়ি নিয়ে। রাত নয়, দিনের বেলা। একজন ট্রান্সম্যান এবং তাঁর বান্ধবী একসঙ্গে থাকছিলেন। দু'জনেই প্রাপ্তবয়স্ক। মেয়েটাকে তাঁর বাড়ির লোকজন নির্মমভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে গাড়িতে তুলছে। মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন। নর্দমায় পড়ে যাচ্ছেন। বাড়ির লোকজন চ্যাংদোলা করে তুলে গাড়িতে ঠেলে তুলে দিচ্ছেন। যেন কোনও মাল লোডিং হচ্ছে। আর গোটা সমাজ দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। দেখছে আর বলছে, এটা তো মেয়েটার বাবা-মা করছে, এখানে আমাদের আপত্তির কারণ কেন থাকবে? স্যাফোর লোকজন যখন পুলিশের কাছে গিয়েছে, পুলিশ বলেছে, বাবা-মা তুলে নিয়ে গিয়েছে তো ভালোর জন্যই। আপনাদের অসুবিধা কোথায়?
এই রকম একটা অবস্থায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলছে, কুইয়্যার কাপলদের কোনও রকম হয়রানি করা যাবে না। যখন তখন থানায় ডেকে পাঠানো যাবে না। হুটহাট বাড়িতে যেতে পারবে না। বাবা-মায়ের কাছে, জন্মগত পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য কোনওরকম চাপ দিতে পারবে না। ইচ্ছে হলেই যখন তখন এফআইআর করা যাবে না, তার আগে একটা প্রাথমিক তদন্ত করতে হবে। পুলিশের প্রতি কিন্তু নির্দিষ্ট করে বেশ কয়েকটা নির্দেশ রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের। অ্যাকটিভিস্টদের কাছে, সমলিঙ্গে একসঙ্গে সমাজবাসীদের (?) কাছে এটা একটা অস্ত্র। তাই শুধু বিয়ের দাবিটাই সবচেয়ে বড় দাবি নয়।
আরও পড়ুন: সমলিঙ্গে সম্পর্ক হলেই সোজা মৃত্যুদণ্ড! বিশ্বের এই দেশগুলিতে বিপন্ন LGBTQ অধিকার
সামাজিক ভাবে যদি দেখি, যদি 'ক্লাস' অর্থাৎ শ্রেণির কথা ভাবি। তা হলে দেখা যাবে, প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসকারী একজন প্রান্তিক মানুষের কাছে সেরকম কোনও বিকল্প নেই সঙ্গী পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রে, একটা শহুরে মানুষের কাছে যতটা আছে। একটা অ্যাপের মাধ্যমে আমি, আমরা যখন-তখন সঙ্গী বাছাই করে নিতে পারি। সেই সঙ্গীর ক্ষেত্রেও অনেক রকমফের আছে। সে কি আমার শুধু এক রাতের যৌনসঙ্গী হবে? নাকি তার সঙ্গে আমি গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে চাই? এ রকম নানা বিকল্প আছে। একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাছে সেই বিকল্প নেই। র্স্মাটফোন থাকলেও এই সুযোগটাই হয়তো নেই।
কিন্তু এত বড় একটা ঘটনা নিয়ে সেভাবে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিক্রিয়া কোথায়? সেভাবে মতামত কোথায়? জনমত তৈরির চেষ্টাই বা কোথায়? এমনকী খবরের কাগজেও এ নিয়ে বিরাট করে কোনও ধারাবাহিক আলোচনা নেই। সুপ্রিম কোর্ট সমলিঙ্গে বিবাহে না বলে দিয়েছে ব্যাস ও টুকুই। টিভি চ্যানেলগুলোয় সান্ধ্যকালীন যে সমস্ত বিতর্কসভা হয়, সেখানেই বা কোথায় এ নিয়ে আলোচনা হলো? যেখানে লোকজন পক্ষে-বিপক্ষে বিষয়টির সমর্থনে কথা বলছেন বা বিরুদ্ধে মত প্রতিষ্ঠা করছেন, একটা বড় ক্যানভাসে এ নিয়ে চর্চা হচ্ছে! আসলে আলোচনার পরিসরে এসব বিষয় এখনও কলকে পায় না।
সেই ১৮৬০ সাল থেকে চাপিয়ে দেওয়া সংবিধানের ৩৭৭ ধারার কথা বলি। কতদিন ধরে এ নিয়ে লড়াই ছিল। সমাজের চোখে এক ধরনের যৌন সম্পর্ক স্বাভাবিক, এক ধরনের মানসিক সম্পর্ক স্বাভাবিক। বাকি সব ধরনের সম্পর্ক অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃতিক। আইনের চোখে অপরাধ, অবৈধ, শাস্তিযোগ্য। এমনকী যাবজ্জীবন কারাবাস পর্যন্ত! তাই আইনের পথে গিয়েই এ নিয়ে অধিকার ছিনিয়ে আনতে হয়েছে। শেষপর্যন্ত ২০১৮ সালে ৩৭৭ ধারার আংশিক খণ্ডন হয়। সমলিঙ্গে যৌনসম্পর্ক অপরাধ নয় বলে রায় দেয় আদালত।
এক্ষেত্রেও তাই পাঁচ বিচারপতির একটা বিভক্ত নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেটাকে এখন মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। কিন্তু এটা তো অবশ্য়ই নিন্দনীয় যে আমি কীভাবে থাকব, আমার যৌনপছন্দ কী হবে সেটা আদালত বলে দেবে। শুধু তাই নয়, এখন তো আমি কী খাব, কী পরব, সেটাও প্রায় রাষ্ট্র ঠিক করে দিচ্ছে। আদালতের রায়ের আর একটা দিকও খুবই গুরুত্বপূ্র্ণ। ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে বিচারপতিদের যা পর্যবেক্ষণ। ট্রান্সজেন্ডার যাঁরা নারী-পুরুষ সম্পর্কের মধ্যে আছেন তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ককেই মান্যতা দিচ্ছে কোর্ট। ট্রান্সজেন্ডার যাঁরা হেটারোসেক্সুয়াল সম্পর্কের মধ্যে আছেন, অর্থাৎ আবারও সেই বাইনারি। সেই স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক। প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক। আবারও সেই নারী-পুরুষের সম্পর্ক। নারী বা পুরুষের বাক্সটাকে বেছে নিতে হবে। আর সেই বাক্সের বাইরে থাকলেই আইন-আদালত-সমাজ কেউ মেনে নেবে না। সেই জিনিসটাই আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া হলো।
আরও পড়ুন- নয়ের দশকের স্মৃতি ও একটি সমকামী ভালবাসার পরিণতি
আসলে সংখ্যালঘুদের সমাজ যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে, যে আচরণ করে এখানেও তাই। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় সংখ্যালঘু, ধর্মে সংখ্যালঘু, জাতিতে সংখ্যালঘু, যৌনচিন্তার দিক থেকে সংখ্যালঘু, সংখ্যালঘু হলেই শাসকের বুটের তলায় থেকে তাদের চিন্তা ভাবনার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলার অত্যাচার সহ্য করতে হবে। সমলিঙ্গে যৌনতা অপরাধ এই নিয়ে ধারাবাহিক লড়াই হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে বিচার পাওয়া সম্ভব হয়েছে। কাজেই তার পাঁচ বছরের মধ্যে সমলিঙ্গে বিবাহকে আদালত মান্য়তা দিয়ে দেবে, এমন ভাবনাটাও একটু বেশি রকমের প্রত্যাশা। সেই আশা করাটাও ঠিক নয়। এটা কোথাও হয়নি। এমনকী নেপালেও না। নেপালে যে বলছে হয়েছে, সেটা ভুল। একজন বিচারপতি বলেছিলেন, সমলিঙ্গে বিবাহের অধিকার দেওয়া হোক। সেটা যদি হতো তা হলে পিছিয়ে থাকা দেশগুলির মধ্যে নেপাল একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। আদালত থেকে বলেছে, ব্যাস ওই টুকুই। সরকারের এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। দু'জন মানুষ তাঁরা রেজিস্ট্রি করতে যায়, কিন্তু সেই আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়। আমেরিকার মতো দেশেও এটা হয়নি।
আবার আদালত যা যা পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, সেগুলিও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় যা বলেছেন। সেখান থেকে অনেকগুলি লড়াইয়ের রাস্তা তৈরি হয়েছে। বিচারপতি বলছেন, কুইয়্যারনেস হচ্ছে ন্যাচরাল ফেনোমেনন, অর্থাত প্রাকৃতিকভাবে ঘটমান একটা বিষয়। ভারতে প্রাচীনকাল থেকে এর দৃষ্টান্ত আছে এবং এটা কোনও নগরকেন্দ্রিক এলিট সম্প্রদায়ের ভাবনা বা দর্শন নয়। এর উলটো দিকটা, মানে এ ধরনের সম্পর্ক অস্বাভাবিক, এই দাগটাই তো এতদিন সমলিঙ্গপ্রেমে বিশ্বাসী গোষ্ঠী ১৮৬০ সাল থেকে বয়ে বেরিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই কথাগুলি বলছেন, বাক্যগুলিকে পরপর এভাবে সাজাচ্ছেন, এটাও তো পরবর্তী লড়াইয়ের একটা বড় হাতিয়ার।
আসলে বিবাহ এমন একটা প্রতিষ্ঠান যাকে অত্যন্ত 'পবিত্র' তকমা দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সমস্ত রকমের স্তম্ভগুলি দিয়ে আগলে রেখেছে। আমি সমলিঙ্গে প্রেমে আপত্তি দেখছি না। আমি বলছি না এটা এলিট শ্রেণির দাবি। বলছি প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে এর নজির রয়েছে। কিন্তু যে মুহূর্তে বিবাহ নামক তথাকথিত 'পবিত্র' প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এর জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তখনই তাকে আমরা আর ঢুকতে দিচ্ছি না। তবে পজ়িটিভ দিক ওটাই, পুলিশি হয়রানি, পারিবারিক সন্ত্রাস, কথায় কথায় সামাজিক হেনস্থা, আইনি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি। আদালতের রায়ের পরে এগুলি বোধহয় এবার কিছুটা হলেও বন্ধ হবে।
বৈবাহিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে আদালত দাঁড় করিয়ে রাখল, এ নিয়ে অবশ্যই সপাট নিন্দা করব। আবার এটাও ঠিক যাঁরা অধিকারের দাবিতে মাটি কামড়ে এতদিন ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন করছেন, আদালতের দেওয়া বাক্যগুলি কিন্তু তাঁদের হাতের এক একটা ধারাল অস্ত্র, প্রয়োজনে তা ব্যবহার করা যাবে।