কেন দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনতে বদ্ধপরিকর মোদি সরকার? নেপথ্যে কোন পরিকল্পনা?
The Uniform Civil Code: ২০২৩ সালের জুলাই মাসে মোদি এক জনসভায় বলেছিলেন, একই পরিবারের সদস্যদের যেমন ভিন্ন নিয়ম হতে পারে না, তেমনই একই দেশের নাগরিকদের মধ্যে আলাদা আইন থাকা ঠিক নয়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সকল সম্প্রদায়ের জন...
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জন্মদিনে অর্থাৎ 'রাষ্ট্রীয় একতা দিবসে' গুজরাটে স্ট্যাচু অব ইউনিটির সামনে বক্তৃতা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । এ বার সেদিনই ছিল দীপাবলি। প্রধানমন্ত্রী এই সুযোগে শুভেচ্ছাবার্তার পাশাপাশি ফের তাঁর বক্তৃতায় মনে করিয়ে দিলেন এক দেশ-এক ভোট এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা। একই সঙ্গে বার্তা দিলেন শহুরে নকশাল দমনেরও। এ ছাড়াও বক্তৃতায় উঠে এসেছে এক দেশ-এক স্বাস্থ্যবিমা, এক দেশ-এক করকাঠামো, এক দেশ-এক পরিচয়পত্রের মতো বিষয়গুলি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট বলেছেন, জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে এগুলি জরুরি। তবে স্ট্যাচু অব ইউনিটিকে সাক্ষী রেখে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তৃতায় রাজনীতির ছাপ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন। বিজেপি এবং আরএসএস-এর বহুদিনের লক্ষ্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এবং এক দেশ-এক নির্বাচন কার্যকর করা। আগামী দিনে বিজেপি সরকার যে এই পরিকল্পনার দিকেই এগোচ্ছে, তাঁরই ইঙ্গিত দিলেন এদিন প্রধানমন্ত্রী। আর তার পর থেকেই আবার এই বিধিগুলি নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। এর আগেও মোদি দেওয়ানি বিধির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এমনকী সুপ্রিম কোর্টও এই বিধি প্রণয়নের কথা বলেছে। আইনটিতে কী থাকবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এই আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে মোদি এক জনসভায় বলেছিলেন, একই পরিবারের সদস্যদের যেমন ভিন্ন নিয়ম হতে পারে না, তেমনই একই দেশের নাগরিকদের মধ্যে আলাদা আইন থাকা ঠিক নয়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সকল সম্প্রদায়ের জন্য এক আইনের কথা বলে। এই আইন অনুযায়ী, বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, দত্তক, উত্তরাধিকারের মতো ব্যক্তিগত বিষয়-সহ সকল ক্ষেত্রেই সব সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিধি থাকবে। প্রথম যখন এই আইন আনার কথা হয়েছিল, তখন থেকেই দেশের ছোট-বড় প্রায় সব দলই এই নিয়ে মতামত জানিয়েছিল। অনেক দল যেমন এই নীতি প্রণয়ন করার প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে, অনেকেই আবার এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেছে।
আরও পড়ুন: রাজ্যবাসীর মতামত শিকেয়, ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ পাশে প্রথম উত্তরাখণ্ড
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকের দাবি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করতে যে সকল যুক্তি দেওয়া হয়েছে তা অসার এবং ভিত্তিহীন। কারণ ভারতের সংবিধান দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীকে বিশেষ ধরনের সুবিধা দিয়েছে। দেশবাসীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার স্বার্থেই সংবিধান প্রতিষ্ঠাতারা এটা করেছিলেন। যেমন— সংবিধানে ভারতের বিভিন্ন এলাকাকে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তেমনই আবার বিভিন্ন সম্প্রদায় তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী আলাদা আইনের মর্যাদা পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, দেশের এই বৈচিত্র্য ধরে রাখতে পারলে তবেই জাতীয় ঐক্য থাকবে। দেশের সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীরা যদি নিজস্ব আইন মেনে দেশে বাস করতে পারে তবেই বৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে।
এই আইন সংবিধান স্বীকৃত মানবধিকার সংক্রান্ত আইনকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই নীতি আনাই হচ্ছে মুসলমানদের টার্গেট করে। যেমন, বাল্যবিবাহ রোধের নামে প্রচুর মুসলমান নারী-পুরুষকে জেলে ভরেছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। বিজেপি শাসিত অসমের মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, বাল্যবিবাহ রোধে ইউনিফর্ম সিভিল কোড আনছে অসম সরকার। এর আগে অসমে বিজেপি সরকার মুসলমানদের বিবাহ এবং বিচ্ছেদের শরিয়ত আইন (মুসলিম বিবাহ আইন) বাতিল করেছে। কিন্তু শরিয়ত আইনে বিবাহ এবং বিচ্ছেদের অধিকার ভারতীয় সংবিধান মুসলমানদের দিয়েছে। ওই রাজ্যে এখন মুসলিমদের বিবাহ এবং বিচ্ছেদ হয় স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টে। এখানে বলে রাখা দরকার, ১৯৫৪ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমলে হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের সমান্তরালে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট আনা হয়েছিল। যারা ধর্মীয় আইন মেনে বিয়ে করতে চান না বা ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করতে চান, এই আইন ছিল তাঁদের জন্য। এখন সেই আইনকে মোদি সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না, সেই আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
'অভিন্ন দেওয়ানি বিধি'র তীব্র বিরোধিতা করেছিল অল ইন্ডিয়া পার্সোনাল ল বোর্ড। তাদের যুক্তি ছিল, 'সংখ্যাগরিষ্ঠর বেঁধে দেওয়া নৈতিকতার' মাপকাঠিতে সংখ্যালঘুদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া যায় না। ভারতের মুসলমানদের এটি সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ ল বোর্ড। এটি ভারতের মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনের কাস্টডিয়ান বা হেফাজতকারী হিসেবে পরিচিত। ২০২৩ সালের জুলাই মাসেই এই বোর্ড আইন কমিশনের কাছে তাদের বক্তব্য লিখিত আকারে দিয়েছিল। ল বোর্ড তাদের সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করে তাদের মতামতের ১০০ পাতার খসড়া তৈরি করেছিল। এই কমিটির কেন্দ্রীয় মুখপত্র এস কিউ আর ইলিয়াস বিবিসিকে বলেন, 'আমরা বলেছি দেশের সাংবিধানিক কাঠামোতে যেখানে এই ধর্মীয় পরিচয় রক্ষার কথা বলা হয়েছে, তখন ভারতের মুসলিমরা কিছুতেই মেনে নেবেন না যে সেই পরিচয়টা লুপ্ত হয়ে যাক।'
উত্তরাখণ্ডেও এই আইন রয়েছে। উত্তরাখণ্ড সরকারের দাবি, ইউনিফর্ম সিভিল কোডে নাকি নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বিলটি কার্যকর হবার আগেই নারী অধিকার কর্মীরা এই আইনের বিরোধিতা করেছিলেন। উত্তরাখণ্ডের মহিলা সংগঠন একটি যৌথ বিবৃতিতে দাবি জানিয়েছিল, এই আইন কার্যকর হবার পূর্বে যেন বিলটি আলোচনার জন্য একটি স্থায়ী কমিটি বা নির্বাচন কমিটির কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু তখন কোনও দাবি না মেনেই আইনটি চালু করা হয়। মহিলা সংগঠনগুলির দাবি, এই নীতি নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং পছন্দের অধিকার খর্ব করবে।
২০২৩ সালের জুন মাসে গোয়ার এক সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলার শুনানির সময় শীর্ষ আদালত ওই রাজ্যকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির এক 'উজ্জ্বল উদাহরণ' বলে উল্লেখ করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, সংবিধান প্রণেতারা ভারতের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বলেছিলেন, কিন্তু তা প্রণয়ন করা হয়নি। উল্লেখ্য,সংবিধানের ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,ভারতের জনগণের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরির চেষ্টা করবে রাষ্ট্র। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, সংবিধানে উল্লেখিত অন্যান্য নির্দেশমূলক বিধিগুলির তুলনায় এটি অনেকটাই দুর্বল। তখন গণপরিষদের সদস্য বি.আর.আম্বেদকর বলেছিলেন, এই আইনকে সরকার যেন এমন ভাবে ব্যবহার না করে, যার জন্য মুসলমানেরা আন্দোলন করতে বাধ্য হয়। আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে থাকলেও তাঁর মতে, কোনও সম্প্রদায় যদি এই আইনের বিরোধিতা করে তবে এই আইন প্রণয়ন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
আরও পড়ুন: কোনও ধর্মের জন্য আর আলাদা বিধি নয়! অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নামে কী চাইছেন মোদি?
উল্লেখ্য, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি, ইহুদি এবং শিখ সকল ধর্মেই পৃথক আইন রয়েছে। যেহেতু আইনটিতে কী থাকবে তা এখনও স্পষ্ট নয়, তাই বাকি ধর্মের আইনে কী পরিবর্তন হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু মোদি সরকারের অতীতের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপই যেহেতু মুসলিম ধর্মবলম্বীদের বিরুদ্ধে ছিল, তাই পর্যবেক্ষকদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, মুসলিমদের শায়েস্তা করতেই আবার এই আইন আনতে চাইছে বিজেপি সরকার। যেমন, সিএএ-এর মতো আইনেও শুধুমাত্র মুসলিমদের কথাই উল্লেখ নেই। মুসলিমদের সিএএ-তে বাদ রাখার বিষয়ে, হিন্দুত্ববাদী সরকার প্রকাশ্যে যুক্তি দিয়েছে, মুসলিমরাই একসময় তিন দেশের (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের) হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের দাবি— কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের তরফে এই আইন নিয়ে হিন্দুদের 'প্রধান্য দেওয়ার' ন্যারেটিভ সেট করানো হচ্ছে। বলে রাখা ভাল, সাংসদদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এবং তাঁদের সহায়ক শক্তি নীতিনির্ধারণ করে।
শাসকগোষ্ঠী নিজেই 'ধর্মনিরপেক্ষ' দেশের মানুষদের ধর্মীয় বিভেদ, বিদ্বেষের দিকে ঢেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বারবার। বিজেপি সরকার একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের ক্ষমতা পেলেও তাদের ধর্মীয় পরিচয় যে ত্যাগ করতে পারেনি এই অভিযোগ নতুন নয়। এটি দলের সদস্যরা নিজেরাই প্রকাশ্যে বলেও থাকেন। ভারতের সংবিধান অনুসারে, সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলিকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। এই শর্ত লঙ্ঘন করলে ১৯৮৯ সালের 'রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অ্যাক্টে'র ২৯-এর ধারায় ওই রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি খারিজ করার বিধানও আছে। তবুও বার বার 'ধর্মনিরপেক্ষ'র আদর্শ ভঙ্গ হচ্ছেই। শেষে প্রশ্ন থাকছেই, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কি ভারতের নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকারের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা অমান্য করছে না?