বিশ্বজোড়া দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে বিজেপি, কোন লক্ষ্যে?
RSS-BJP: বিজেপি সামনে বলছে তারা হিংসার রাজনীতির বিরোধী, অথচ পিছনে মদত দিচ্ছে সেই শক্তিগুলোকে, যারা সারা বিশ্বে প্রতিক্রিয়াশীল কাজকর্মের জন্য কুখ্যাত।
সারা বিশ্বের বেশ কিছু রক্ষণশীল এবং অতিদক্ষিণপন্থী দলের সদস্যরা ‘ন্যাশানাল কনসারভেটিসম’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন, যাদের উদ্দেশ্য দেশে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস করা। সেখানে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত কাছের দু’জন মানুষ। তাঁরা দু’জনেই আরএসএস এবং বিজেপির সক্রিয় সদস্য, রাম মাধব এবং স্বপন দাশগুপ্ত। ঘটনাচক্রে এই দু’জনের উপরেই দায়িত্ব ছিল, ইংরেজি দৈনিকে উত্তর সম্পাদকীয় লিখে, সংসদে রাহুল গান্ধির বক্তব্যের বিরোধিতা করে, জনমত তৈরি করা যে, সঙ্ঘ পরিবার একটি সামাজিক সংগঠন এবং তাদের কাজকর্মের সঙ্গে হিংসার কোনও যোগসূত্র নেই। আরএসএস গণতান্ত্রিক পরিবেশেই তাদের সামাজিক কাজ করে এসেছে এতদিন এবং ভবিষ্যতেও করতে বদ্ধপরিকর।
ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমেরিকা, পোল্যান্ড, ইজরায়েল, হাঙ্গেরি সহ নানা দেশের ১১৪ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন। ভারতের তরফে ছিলেন রাম মাধব এবং স্বপন দাশগুপ্ত। কীভাবে এই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির প্রসার ঘটানো যায় এদেশে, তা নিয়েই আলোচনা করতে এই সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনটির মূল উদ্যোক্তা হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরব্যান, যাঁর সঙ্গে রাশিয়ার পুতিন এবং আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন- ‘হিন্দুই নন!’ লোকসভায় সরাসরি আক্রমণ রাহুলের, উত্তর দিতে কালঘাম ছুটল টিম মোদির
বিজেপি ছাড়া অন্য যারা এই আন্তর্জাতিক ‘ন্যাশানাল কনসারভেটিসম’ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন, তার তালিকা দেখলে মনে হতে বাধ্য, ওই সম্মেলনের আলোচিত বক্তব্য আগামীদিনে আরও হিংসার দিকে ঠেলে দেবে সারা বিশ্বকে। আমেরিকার হেরিটেজ ফাউন্ডেশন খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত একটি সংগঠন। এরা মনে করে সমস্ত গণতান্ত্রিক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠনকে ভেঙে দিতে হবে ২০২৫ সালের মধ্যে, তাদের প্রতিনিধিরা ছিলেন এই সম্মেলনে। তাদের তরফ থেকে অন্তত দশজন বক্তব্য রেখেছেন। তাদের নিজস্ব গণমাধ্যম, ‘দ্য ডেইলি সিগন্যাল’, তার অন্যতম প্রধান মেরি মার্গারেট উপস্থিত ছিলেন এখানে। ট্রাম্পের বহু সমর্থক, যারা একসময়ে ট্রাম্পের জাতিবিদ্বেষ সহ অভিবাসন নীতির পক্ষ নিয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতেও নেবেন, তেমন বহু মানুষও ছিলেন। প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রার্থী বিবেক রামস্বামী ছিলেন। যারা ওই সম্মেলনে ছিলেন, তাদের প্রত্যেককে নিয়ে চর্চা করা হলে দেখা যাবে, এঁদের সবার মতাদর্শ প্রতিক্রিয়াশীল। যে যে সংগঠন ওখানে ছিল, তারা সকলেই হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরব্যানের স্বৈরতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে সমর্থন করেছে, কোনও না কোনও সময়ে। পোল্যান্ডের অতি দক্ষিণপন্থী দল, যাদের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে সেই দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছিল, যাদের বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষ গর্জে উঠে তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়েছিল, সেই দলের প্রথম সারির নেতারা এসেছিলেন। ইজরায়েলের জাতীয়তাবাদী সংগঠনের বিশিষ্ট মানুষজন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন, প্যালেস্টাইনের উপর আক্রমণের সমর্থন করে তাদের বক্তব্য রেখেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, প্রতিটি সংগঠন এবং ব্যক্তি কোন অভিমুখে তাঁদের বক্তব্য রেখেছিলেন। অভিবাসন বিরোধী সংগঠন, সেন্টার ফর ইমিগ্রেশন স্টাডিজের প্রধানও তাঁর অভিবাসন বিরোধী বক্তব্য রেখেছেন। ফ্রান্সে যদিও বামপন্থী এবং সমাজতান্ত্রিক দল নতুন করে ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু সেই দেশের এলজিবিটিকিউ আন্দোলন বিরোধী অতি দক্ষিণপন্থী সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
একদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে রাশিয়া যাচ্ছেন, এক যুদ্ধবাজ নেতার সঙ্গে দেখা করছেন, অন্যদিকে স্বপন দাশগুপ্ত এবং রাম মাধব ওই সম্মেলনে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখছেন। বিজেপি কি তাহলে দ্বিচারিতার রাজনীতি করছে? সামনে বলছে তারা হিংসার রাজনীতির বিরোধী, অথচ পিছনে মদত দিচ্ছে সেই শক্তিগুলোকে, যারা সারা বিশ্বে প্রতিক্রিয়াশীল কাজকর্মের জন্য কুখ্যাত। যতই প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপির মন্ত্রীরা সংসদে বিরোধী দলনেতার বক্তব্যের বিরোধিতা করে গলা ফুলিয়ে বলুক যে, রাহুল গান্ধি তাঁর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সমস্ত হিন্দুদের অপমান করেছেন, তাঁরা নিজেরা জানেন, সঙ্ঘ পরিবার তাদের জন্মলগ্ন থেকেই হিংসার রাজনীতি করে আসছে। গান্ধি হত্যাই তার অন্যতম প্রমাণ। বিভিন্ন সময়ে যে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ শানানো হয়েছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নানা জায়গায় যে দাঙ্গা হয়েছে, তার প্রত্যক্ষ মদতদাতা যে সঙ্ঘ পরিবার, তা ইতিহাস সচেতন সকলেই জানেন।
রাহুল সংসদে দাঁড়িয়ে কী বলেছিলেন? রাহুল গান্ধি খুব স্পষ্টভাবে বলেন, দেশের অধিকাংশ হিন্দু মানুষজন, বিজেপির হিংসার রাজনীতি, সংখ্যালঘু আক্রমণের নীতি পছন্দ করেন না। এই বক্তব্য সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপিকে লক্ষ্য করেই। বিজেপি জানে, সমাজের উপরতলার কিছু অংশের মানুষের মধ্যে যদি রাহুল গান্ধি তাঁর বক্তব্যের সমর্থক খুঁজে পান, তাহলে বিজেপির রাজনীতির জন্য বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
নীচের তলার মানুষকে বিজেপি মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, একদিন মুসলমানরা হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবে, হিন্দুদের চাকরি না হওয়ার কারণও মুসলমানরা ইত্যাদি ভুয়ো এবং ভ্রান্ত বার্তা দিয়ে ভুল বোঝাতে পারবেন। কিন্তু সমাজের উপরের অংশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ইংরেজিতে জাতীয় স্তরের সংবাদপত্রগুলোর উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ দিয়েই তা করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে বিভাজনের বদলে, ভারতের উন্নয়ন, বিকাশের জন্য নরেন্দ্র মোদিকেই কৃতিত্ব দেওয়া উচিত। রাম মাধব এবং স্বপন দাশগুপ্তকে সেই দায়িত্বই দেওয়া হয়েছিল বিজেপির পক্ষ থেকে। বিজেপি এবং আরএসএস জানে, সমাজের উপরতলার অংশই ধারণা তৈরি করে এবং তাঁদের ধারণাকে একটা দিশায় চালনা করা গেলেই কাজ হাসিল। সেই জায়গা থেকেই তারা ইতিমধ্যেই একটি ধারণা প্রচার করতে সক্ষম হয়েছে যে, বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার সত্যিই হিংসায় বিশ্বাস করে না এবং নরেন্দ্র মোদি সত্যিই দেশের উন্নয়নের জন্য প্রাণপাত করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই অংশের মানুষও কি জানেন যে, খোদ আমেরিকাতে হওয়া ‘ন্যাশানাল কনসারভেটিসম’ নামের ওই সম্মেলনে বিজেপি সঙ্ঘ পরিবারের শুধু নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ, বৌদ্ধিক সেলের উপর তলার ওই দু’জন নেতাকে পাঠানো হয়েছিল? ঘটনাচক্রে তাঁদেরকেই বিজেপির তরফ থেকে রাহুল গান্ধির সংসদের বক্তব্যকে খণ্ডনের যুক্তি সাজাতে বলা হয়েছিল। বিজেপির এই দ্বিচারিতার রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন আশু কর্তব্য।
আরও পড়ুন- কাশ্মীরের শান্তি নষ্টের মূল কারিগর, কাশ্মীর টাইগার আসলে কারা?
বিশ্বের বহু বিশেষজ্ঞই এই বিষয়ে একমত যে, নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারত গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে ক্রমশ নীচে নামছে। ‘ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্রেসি’ নামে একটি সংস্থার পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের একটি ডেমোক্রেসি সার্ভে রিপোর্টে ভারতকে ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ বলা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হচ্ছে,
“South and Central Asia is now the second most autocratic region in the world. More than nine out of ten people, or 93% of the population reside in electoral autocracies like India, Bangladesh, Pakistan, and Kazakhstan. Afghanistan, Turkmenistan, and Uzbekistan are closed autocracies, accounting for 4% of the regional population.”
ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের অন্যতম খারাপ স্বৈরশাসক। বিজেপি ভারতের রাজনীতির মূল স্তম্ভ এবং সংস্থাগুলোকে কব্জা করে ফেলে সেগুলোর রাজনীতিকরণ করেছে, যাতে বিরোধী দল এবং যে কোনও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করা যায়। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সমস্ত স্বশাসিত সংস্থাকে ব্যবহার করে মুসলিম সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তাদের ওপর অত্যাচার করছে বিজেপি। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিদের হুমকি দেওয়া, তাঁদের গ্রেফতার করানো, সমস্ত কিছুই হয়েছে নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে। বিজেপি মূলত হিন্দুত্বের রাজনীতিই করে এবং অন্যান্য ধর্মের থেকে হিন্দুধর্মকেই প্রাধান্য দেয়। আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবার তাদের জন্মলগ্ন থেকেই, ইতালির মুসোলিনির ভাবাদর্শে বিশ্বাস করে এসেছে এবং হিন্দুত্বের রাজনীতিই যে ভারতবর্ষের চালিকাশক্তি তা প্রচার করে এসেছে। আরএসএস এবং বিজেপি প্রতিবেশী দেশ দখল করে হিন্দু সাম্রাজ্য তৈরি করার কথাও বলেছে।
সারা পৃথিবীতে এই অতি দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হচ্ছে। সেই উত্থানে ভারতের বিজেপি এবং আরএসএসের প্রথম সারির নেতারা উপস্থিত থাকছেন। অন্যদিকে বিজেপি এবং আরএসএস দাবি করছে, তাদের সঙ্গে হিংসার দূর দূর পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক নেই। ভারতে নির্বাচনী ফল প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করছে হিন্দুত্ববাদী শক্তিরাই, আর অন্যদিকে তারাই আবার দাবি করছে, হিন্দুরা হিংসাশ্রয়ী নয়! রাই রাহুল গান্ধিকে ক্ষমা চাইতে হবে! এই বৈপরীত্য কীভাবে চলতে পারে? বিরোধী দলগুলোর উচিত সংসদের আসন্ন অধিবেশনে বিজেপির নেতাদের আবার প্রশ্ন করা যে, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ, রাজ্যসভার সদস্য কিংবা আরএসএসের একজন প্রথম সারির সংগঠক কেন বিদেশের মাটিতে এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন? বিজেপিরও কি তবে গণতন্ত্র ধ্বংস করাই উদ্দেশ্য? রাহুল গান্ধি সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপিকে লক্ষ্য করে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা কি সেটাই সঠিক? সামনে হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরোধিতা, পিছনে সেই রাজনীতিকেই মদতের চেষ্টাই কি করছে না বিজেপি?
তথ্যঋণ- https://v-dem.net/publications/democracy-reports/
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত