কেন নরেন্দ্র মোদির মুখে ‘আর্বান নকশাল’ প্রসঙ্গ উঠছে ফের?
Urban Naxal: লাদাখের জন্য আন্দোলনরত সোনাম ওয়াংচুকও ‘আর্বান নকশাল’? নর্মদা বাঁচাও অন্দোলনের মুখ মেধা পাটেকরও ‘আর্বান নকশাল’?
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জন্মদিনকে ‘একতা দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বেশ কিছু বছর আগে। সেই বল্লভভাই প্যাটেলের এক আকাশচুম্বী মূর্তির তলে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী একতার বদলে বিভেদের বার্তা দিলেন এবার। তাঁর বক্তব্যের নির্যাস, যে বা যারা আজকের ভারতবর্ষের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করছেন, তাদের কখনই ক্ষমা করা উচিত নয়। আগে যারা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জঙ্গলে আদিবাসী ও দলিত মানুষদের সংগঠিত করতেন, তারা ছিলেন নকশাল আর আজ যারা শহরে বসে সেই সমস্ত মানুষদের দেশের নকল উন্নয়নের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছেন, তারা হচ্ছেন ‘আর্বান নকশাল’। তারাই হচ্ছেন সেই মানুষ, যাদের কলমের জন্য মানুষ নাকি বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং শিল্পের ও উন্নয়নের বিরোধিতা করছেন, ফলে দেশ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। সর্দার বল্লভভাই
প্যাটেল ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে, যে বল্লভভাই প্যাটেলের ঐক্যের কথা নরেন্দ্র মোদি স্মরণ করাতে চান, সেই ঐক্য নরেন্দ্র মোদি নিজেই ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছেন গত দশ বছরে। তাঁর আমলেই ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর আমলেই গত দশ বছরে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বেড়েছে, উঁচু জাতের মানুষদের হাতে আদিবাসী-দলিতরা আক্রান্ত হয়েছেন। মণিপুরে জাতিদাঙ্গায় অসংখ্য মানুষ মারা গেছেন, মহিলারা সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে
হেনস্থার শিকার হয়েছেন।
১৯৩৩ সালে জার্মানিতে রাইসট্যাগে আগুন লাগে। কে বা কারা ওই আগুন লাগিয়েছিল তখন জানা না গেলেও, তার পরে পরেই তৎকালীন চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার এবং তাঁর দল অগ্নিকাণ্ডের দায় চাপায় কমিউনিস্টদের ওপরে। সারা জার্মানি জুড়ে কমিউনিস্টদের খুঁজে বের করে জেলে ঢোকানো হয় এবং হত্যা করা হয়। সেই সময়ে হিটলার বলেছিলেন, "রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে একটা ধারণা তৈরি করা জরুরি।" আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেটা করছেন, সেটাও এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক ধারণা তৈরির চেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু নয়। যারাই
মোদির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদেরকেই কখনও ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ বা কখনও ‘আর্বান নকশাল’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে এক আরটিআইয়ের উত্তরে জানানো হয়েছে, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ বলে কোনও দল বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। তাও এই মৌখিক আক্রমণ বন্ধ হয়নি। হয়নি তার মূল কারণ, নরেন্দ্র মোদি একটা শত্রুপক্ষ খাড়া করতে চান, যাদের দেখিয়ে তিনি বলতে পারেন, এদের জন্যই দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে আছে।
আরও পড়ুন-‘নেতা নয়, কংগ্রেস দল চালাচ্ছে আর্বান নকশালেরা’- কেন বলছেন মোদি?
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অধিকাংশ অংশ জুড়ে ‘আর্বান নকশাল’ প্রসঙ্গ আবারও কেন এল? তাঁর মাথায় যে আরএসএসের নিজস্ব এজেন্ডা ‘এক দেশ এক ভোট’ বা ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ আছে তা তিনি ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি আছে ব্যাঙ্ক এবং রেল বেসরকারিকরণের মতো বিষয়ও। গত লোকসভা নির্বাচনে ব্যক্তিগত ক্যারিশমাতে তিনি বিজেপিকে ৪০০ আসন দিতে পারেননি। এখন তাঁকে আরএসএসের বশংবদ বা তাঁদের প্রধানের কথামতোই চলতে হবে। যেহেতু আরএসএসের নিজস্ব বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে একমাত্র ‘আর্বান নকশাল’-রাই তাত্ত্বিক বিরোধিতা করতে পারে, তাই মোদি উচ্চস্বরে তাঁদের বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলেছেন।
নরেন্দ্র মোদি জানেন, তাঁর বেসরকারিকরণের এজেন্ডা অনেকেই সমর্থন করেন না। তিনি এও জানেন, হিন্দুদের বেশ কিছুটা অংশ আজও বিজেপিকে ভোট দেয় না। তাহলে কি এই গোত্রের সমস্ত মানুষই নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টিতে ‘আর্বান নকশাল’ পঙক্তিতে পড়বেন? লাদাখের জন্য আন্দোলনরত সোনাম ওয়াংচুকও ‘আর্বান নকশাল’? নর্মদা বাঁচাও অন্দোলনের মুখ মেধা পাটেকরও ‘আর্বান নকশাল’? আসলে ‘আর্বান নকশাল’ খুঁজছে ক্রোনি কর্পোরেট পুঁজি। তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী জল, জমি, জঙ্গল কেড়ে নেওয়ার যারাই বিরোধ করছেন, যে পরিবেশকর্মীরা ছত্তিশগড়ের হাঁসদেও বা মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল কেটে সাফ করার বিরোধিতা করছেন তাদেরকে চিহ্নিত করতে
চাইছে আদানি, আম্বানির মতো ক্রোনি কর্পোরেট পুঁজি।
আজকের কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যা করছে, তার শিকড় ছিল কংগ্রেসের আমলেই। তখনও চিদম্বরমের সৌজন্যে আমরা পেয়েছিলাম, অপারেশন 'গ্রিন হান্ট’। বহু নকশালপন্থী মানুষ এবং তাদের সমর্থক সেই সময়ে মারা গিয়েছেন। কংগ্রেস এবং বিজেপির এই বিষয়ক নীতি, সেই সময় অবধি মোটামুটি একইরকমের ছিল। তাহলে এখন বিজেপির বিরোধিতা করার প্রয়োজন কোথায়? একটি সরকারের নিয়ন্ত্রক শাসকদলের মতাদর্শ যদি ফ্যাসিবাদী এবং স্বৈরতান্ত্রিক হয়, তাহলে সেই সরকারের আইনের বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই ফ্যাসিবাদেরও বিরোধিতা হয়। কংগ্রেসের অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে বিজেপির অর্থনৈতিক নীতির বেশ কিছু সাদৃশ্য থাকলেও, একটা সূক্ষ্ম ফারাকও আছে। ফ্যাসিবাদের লক্ষণ তো শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, তার শিকড় আরও গভীরে। ফ্যাসিবাদ সামাজিক বিষয়ও। সামাজিকভাবে একটি জাতির মানুষকে 'অপর' বানানো, একটি ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করতে শেখানো ছাড়াও, সেই অন্য ধর্ম বা জাতির মানুষেরা কী খাচ্ছেন, কী পরছেন, সেইদিকে সংখ্যাগুরু মানুষদের নজরদারির কাজটিও রাষ্ট্র করে। তখনই রাষ্ট্র হয়ে ওঠে নজরদারি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের চোখ কান হয়ে ওঠে এক অংশের নাগরিকরা।
আরও পড়ুন- জি এন সাইবাবাকে যেভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হলো…
প্রযুক্তি যত এগিয়েছে, ততই রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন নীতিও বেড়েছে। রাষ্ট্র চায় না, তার নজরের বাইরে কিছু থাকুক। কোনও মেধাশক্তি বা কোনও প্রযুক্তি যা রাষ্ট্র জানতে পারবে না, তা প্রথমেই রাষ্ট্র কিনে নিতে চায়। না পারলে, তা হস্তগত করার চেষ্টা করে। যে ডিজিটাল ভারতবর্ষে আমরা প্রবেশ করেছি প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যে তা অনেকাংশেই তথ্য নির্ভর। যার কাছে যত তথ্য, সে তত বেশি শক্তিশালী। সেই জন্যই কাশ্মীর থেকে শুরু করে উত্তর পূর্বের কোনও ছোট রাজ্যে যদি রাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতিরেকে একটি ড্রোন ক্যামেরাও ওড়ে, তাহলে রাষ্ট্রে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করছে কিনা, কেউ সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ করতে চাইছে কিনা সব সরকার নখদর্পণে রাখতে চায়। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পরে, সংসদে দাঁড়িয়ে দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী অমিত শাহ, ইউএপিএ অর্থাৎ আনলফুল অ্যাক্টিভিটিস প্রিভেনশন অ্যাক্টকে আরও সংশোধন করার প্রস্তাব আনেন এবং বলেন শুধু কোনও সংগঠন নয়, যে কোনও ব্যক্তিকে যাতে এই আইনে গ্রেফতার করা যায়, তার বন্দোবস্ত করা উচিত। আমরা এতদিন জেনে এসেছি, ‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’। ৭০ দশকে যাঁরা রাজনীতি করেছেন তাঁরা এই স্লোগান বিভিন্ন দেওয়ালে লিখেছেনও কিন্তু অমিত শাহ এক লহমায় গোটা ধারণাটিকে বদলে দিলেন। বললেন, "বন্দুক এখন সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয় না, বন্দুকের নল এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস নয়। বরং যারা এই ধারণাগুলোকে তৈরি করেন এবং ছড়ান তারাই আসল সন্ত্রাসবাদী। তাই তাদের যদি চিহ্নিত করার চেষ্টা এই ইউএপিএ-র সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে হয়, তাহলে নিশ্চিত এই সংসদের সদস্যরা বিরোধিতা করবেন না।" স্বভাবতই কোনও সাংসদই এর বিরোধিতা করেননি। ফাদার স্ট্যান স্বামীকে জামিন না দিয়ে কারাগারে তিল তিল করে মেরে ফেলা হলো, অধ্যাপক জি এন সাইবাবাকে জেলে রেখে, তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনমন ঘটিয়ে তাঁকে মেরে ফেলা হল। এর জন্য এই রাষ্ট্র দায়ী নয়? ভীমা কোরেগাঁও
মামলায় সোমা সেন, আনন্দ তেলটুমডে, রোনা উইলসনদের জামিন দেওয়া হচ্ছে না ইউএপিএ-র সংশোধনীর জন্যেই।
লেখিকা অরুন্ধতী রায়কে সবচেয়ে বড় 'আর্বান নকশাল' হিসেবে ভাবে বিজেপি। তাঁর বক্তব্য, এই মুহূর্তে একটাই কাজ, ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজেপি-আরএসএসকে পরাজিত করা। সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশদের এই জন্যই হত্যা করা হয়, এই জন্যই পেগাসাস প্রোথিত হয় বিভিন্ন স্বাধীন সাংবাদিক, সমাজকর্মীদের কম্পিউটারে। এই জন্যই নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেফতার করা হয়।
আগামীদিনে যাতে আদানিকে সুবিধা দেওয়া হলে কোনও প্রতিরোধ না হয়, কোনও বিল আনলে তার বিরোধ না হয়, সেই জন্যেই মোদি ফের 'আর্বান নকশাল' প্রসঙ্গ তুলছেন। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কি নরেন্দ্র মোদির এই স্বৈরতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ অনুধাবন করতে পারছেন না? এখনও নিজেরা নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয়ে লড়াই করে যাবেন তারা? হঠাৎ কোনও সকালে ফ্যাসিবাদ বিদায় নেবে এই আশায় বিরোধীরা বসে রইবেন? পৃথিবীর ইতিহাস কিন্তু সেই শিক্ষা দেয় না।