জানেন সপ্তমীর সকালে কেন করানো হয় নবপত্রিকা স্নান?
মহাসপ্তমীর সকাল মানেই ঘরের দরজার উপরে গিরি মাটি, চন্দন ও সিদুরের ফোঁটা দিয়ে মাকে আহ্বান করার পালা। সপ্তমী মানেই প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় দুর্গাপুজো। সকাল থেকেই যেনো সাজো সাজো রব। রাস্তার এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। আর কলকাতা হলে তো কোনো কথাই নেই। দুর্গাপুজোর আমেজ আর ঢাকের বাদ্যি মিলে সপ্তমীর সকালটায় পুরো কলকাতা যেনো নতুন করে সেজে ওঠে। মহাসপ্তমীর সকাল, রাস্তা দিয়ে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ। জানান দিচ্ছে মা এসে গেছেন। জানালার গ্রিল থেকে মুখ বাড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত একটি বালক। হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ল রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একদল মানুষ। তাদের মধ্যে একজনের কাঁধের ওপরে রাখা আছে একটি কলাগাছ। সেই ব্যক্তির পিছু পিছু ঢাক বাজাতে বাজাতে এগিয়ে যাচ্ছে একদল ঢাকি।
তাঁদের সঙ্গেই আছেন লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা একদল মহিলা যারা শঙ্খ এবং উলুধ্বনি দিতে দিতে চলেছেন ঘাটের দিকে। অবাক দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখছে সেই বালকটি। সেই সময়ের মধ্যেই সেই বালকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তার ঠাকুমা। কলাবৌকে প্রণাম করে ঠাকুমাও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া ওই মানুষগুলির দিকে তাকালেন। ঠাকুমাকে পাশে দেখে, সেই বালক জিজ্ঞাসা করলো, "ওরা ঘাটে কেনো যাচ্ছে?" "ওদের হাতে এরকম একটা কলাগাছ কেনো?"
ঠাকুমা নাতির প্রশ্নের উত্তরে বললেন, "ওরা কলাবউকে স্নান করানোর জন্য ঘাটের দিকে যাচ্ছে। আর তার সাথে যাচ্ছে তাদের পুরো পরিবার।" তখন এই ছোট্ট ছেলেটির মনে প্রশ্নের একটা ঝড় বইতে শুরু করেছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রত্যেক দুর্গা মন্ডপে ছেলেটি দেখে এসেছে গণেশের পাশে একটি কলাগাছকে একটি লাল পাড় সাদা শাড়ী পরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সে সব জায়গায় জেনে এসেছে মা দুর্গার সাথে আসে তার ৪ ছেলে মেয়ে এবং তাদের বাহন। কিন্তু এই কলাগাছটিকে কেনো রাখা থাকে এরকম বউ বেশে সেটা তার এখনও অজানা।
ঠাকুমাকে ছেলেটি আরো প্রশ্ন করে, "তাহলে ঐ কলাগাছটাকে ওভাবে রাখা থাকে কেনো? তাহলে কি গণেশের বউ হচ্ছে কলাবৌ?" নাতির মনে এত প্রশ্ন দেখে ঠাকুমা রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারপরে নাতিকে বলেন, "চল তোকে আজকে পুরো ব্যাপারটা বলি। কলা বউ কে? সে গণেশের বউ কিনা, একটা কলাগাছকে এভাবে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয় কেনো? তাকে এভাবে মন্ডপে বউয়ের মত করে সাজিয়ে রাখা হয় কেনো, তোর সব প্রশ্নের উত্তর দেব আজকে। ঠাকুমা বলতে শুরু করলেন....
দুর্গাপুজোর সমস্ত বিধির মধ্যে একটি অন্যতম বিধি হলো নবপত্রিকা স্নান। এই নবপত্রিকা কথার অর্থ নয়টি পাতার সমাহার, বা নটি ভিন্ন ভিন্ন গাছের অংশ। আমরা প্রায় সকলেই নবপত্রিকা হিসেবে শুধুমাত্র এই কলা গাছটিকে দেখে থাকি। কিন্তু সেরকম না, এই নবপত্রিকা স্নানের জন্য আলাদা আলাদা নয়টি গাছের অংশ দরকার পড়ে। এই গাছগুলি হল - কলাগাছ, হলুদ গাছ, বেল গাছ, কালো কচু গাছ, জয়ন্তী গাছ, ডালিম গাছ, মান কচু গাছ, অশোক গাছ এবং ধান গাছ। প্রত্যেকটি গাছের অংশের মধ্যে মা দুর্গার আলাদা আলাদা নয়টি রূপ প্রকাশ পায়।
শাস্ত্রে লেখা, রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুন্ডা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরোহিতা , ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী। অর্থাৎ প্রত্যেকটি গাছের মাধ্যমে মায়ের আলাদা আলাদা ৯টি রূপের বর্ণনা আমরা পেয়ে থাকি। এরমধ্যে কলাগাছ হলো দেবী ব্রহ্মাণীর প্রতীক, হলুদ গাছ হল উমার প্রতীক, বেল গাছ দেবী শিবানীর প্রতীক, কালো কচু গাছ দেবী কালিকার প্রতীক, জয়ন্তী গাছ দেবী কার্তিকীর প্রতীক, ডালিম গাছ দেবী রক্তদন্তিকার প্রতীক, মানকচু গাছ দেবী চামুণ্ডার প্রতীক, অশোক গাছ দেবী শোকরহিতার প্রতীক এবং ধান গাছ দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক।
তবে, দেবীর এই নবপত্রিকা পূজা কিন্তু আসলে দেবীকে পূজা করা নয় বরং শস্যদেবীর আরাধনা। এই নয়টি শস্যের মাধ্যমে দেবীর নয়টি রূপ আমরা দেখতে পাই। আর সেই নয়টি রূপকে পুজো করার মাধ্যমে আমরা একসাথে শস্য দেবীর পূজা করে থাকি। সাধারণত যে কোন জলাশয় কিংবা গঙ্গার ঘাটে প্রতিবছর মহাসপ্তমীর সকালে এই নবপত্রিকাকে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। সমস্ত শাস্ত্রবিধি মেনে এই নয়টি গাছকে একসাথে স্নান করান পুরোহিত। তারপরে প্রথমে কলাগাছকে, এবং তার চারপাশে বাকি আটটি গাছ এবং দুটি বেলকে সাদা অপরাজিতার লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়।
তারপরে ওই কলাগাছের গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় একটি লাল পাড় সাদা শাড়ি। কলা গাছের পাতার দিকে থাকা শাড়ির অংশটাকে অনেকটা ঘোমটার মত করে টেনে সামনের দিকে নিয়ে এসে এই কলা গাছটিকে একটি বধূর রূপ দেওয়া হয়। এভাবেই সাজানোর ফলে একটি কলাগাছ হয়ে ওঠে কলাবউ। তবে, এই নবপত্রিকা স্নানের সময় শুধুমাত্র যে এই নয়টি গাছকে স্নান করানো হয়, তা নয়। এই নবপত্রিকা স্নানের সময় আরো একাধিক সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে রয়েছে দশ মৃত্তিকা, সপ্ত সমুদ্রের জল, পঞ্চ অমৃত, পঞ্চগব্য, পঞ্চ শস্য, সপ্ত তীর্থের জল, সহস্রধারা জল, পঞ্চশস্য চূর্ণ জল, পঞ্চ কষায়, পঞ্চরত্নের জল, সরস্বতী নদীর জল, ডাবের জল, বৃষ্টির জল, শিশির, আখের রস, দন্তকাষ্ঠ, তেল হলুদ, অষ্ট কলস, সর্ব ঔষধি, মহৌষধি, চন্দন, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, দুধ, পদ্ম রেনু, মধু, অগুরু এবং কর্পূর।
সমস্ত রীতি-রেওয়াজ মেনে এই নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়। কলাগাছকে কলা বউয়ের রূপদান করার পরে আবার কাঁসরঘন্টা এবং ঢাকের আওয়াজ শুরু হয়। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা মহিলারা উলুধ্বনি দিতে শুরু করেন। পুরোহিতমশাই কাঁধে করে কলা বউকে নিয়ে মণ্ডপের দিকে রওনা দেন। মণ্ডপে এই কলা বউকে প্রবেশ করানোর আগে দেবী চামুণ্ডার আবাহন এবং পূজা করা হয়। দেবী চামুণ্ডার আবাহনের পরে দেবী দুর্গার ডানদিকে গণেশের পাশে একটি জলচৌকির উপরে স্থাপন করা হয় কলাবৌটিকে। নবপত্রিকা স্নান হয়ে যাওয়া মানেই শুরু হয়ে যায় আসল দুর্গাপুজো। কলাবউ স্নান হয়ে যাবার পর শুরু হয় দেবী দুর্গার মহাস্নান। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে দেবী দুর্গা এবং তার চার ছেলে মেয়ের মতোই কলা বউকেও পুজো করা হয়।
কিন্তু ঠাকুমা বুঝতে পারেন, তার নাতির মনে এখনও একটা প্রশ্ন বাকি আছে। তার দিকে তাকাতেই নাতি তার ঠাকুমাকে প্রশ্ন করে, "একটা প্রশ্নের উত্তর দিলেনা তো, কলাবৌ কি গণেশের বউ নাকি?" সেই প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুমা হাসতে হাসতে বলেন, "না না কলাবউ গণেশের বউ হতে যাবে কেন? ও তো গণেশের মা। কলাবউ যে মা দুর্গার নয়টি রূপের সমাহার রে!"