নতুন নোট ঘিরে বিতর্ক! কীভাবে বিষিয়ে যেতে পারে নেপাল-ভারত সম্পর্ক?
India Nepal Border Dispute: নেপাল ও ভারতের মধ্যে ১,৭৫০-কিমি দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যা পাঁচটি ভারতীয় রাজ্য - সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড বরাবর বিস্তৃত।
যতই হালফিলে ডিজিটাল লেনদেন হোক না কেন, টাকা তো আখেরে টাকাই! কোনও দেশের অর্থব্যবস্থার শিকড়ে দাঁড়িয়ে আছে টাকা। মুদ্রা হোক বা কাগজের নোট কেনাবেচার ভিত্তি এই দুইয়ে উপরেই। বিশ্বের ১৯৫টি দেশে এই মুহূর্তে মোট ১৮০ ধরনের টাকা ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি দেশের মতো নেপালও নিজস্ব টাকা ছাপায়। তবে এবার সেই টাকা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিচ্ছে। বিতর্কের কেন্দ্রে ভারতবর্ষ। সম্প্রতি নেপাল তাদের ১০০ টাকার নোটকে নতুন করে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এই সিদ্ধান্তে নেপাল ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। কারণ নেপালি নোটে ছাপানো দেশের মানচিত্রে প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে সীমান্তের বিতর্কিত এলাকাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, নেপাল ও ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক ও কৌশলগত পার্থক্য বাড়াতে চিনের পরোক্ষ মদত রয়েছে। এই নতুন নোট ছাপানোর জন্য নেপাল চিনের এক মুদ্রণ সংস্থার সঙ্গেই চুক্তি করেছে। নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, নেপাল রাষ্ট্র ব্যাঙ্ক (NRB) নতুন ১০০ টাকার নোটের ৩০০ মিলিয়ন কপি ডিজাইন, মুদ্রণ এবং বিতরণের জন্য চায়না ব্যাঙ্কনোট প্রিন্টিং অ্যান্ড মিন্টিং কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এত পরিমাণ টাকা ছাপানোর খরচ প্রায় ৮.৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো। নোটপিছু গড় খরচ হবে ৪.০৪ টাকা। এই নয়া নেপালি নোটে নেপালের একটি সংশোধিত রাজনৈতিক মানচিত্র থাকবে, যাতে লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা এবং কালাপানির বিতর্কিত এলাকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই নতুন নোট ছাপানোর বিষয়ে নেপাল সরকারের অবস্থান সম্পর্কে মন্তব্য করে নেপালের যোগাযোগ মন্ত্রী রেখা শর্মা বলেছেন, "সরকার নেপাল রাষ্ট্র ব্যাঙ্ককে নোটের বর্তমান মানচিত্রটিকে সংশোধিত সংস্করণের সঙ্গে প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে।" চলতি বছরের মে মাসে পুষ্প কমল দাহাল সরকারের আমলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক টেন্ডার ডেকেই কাজট করা হয়।
আরও পড়ুন- গোরখনাথের অভিশাপ না ষড়যন্ত্র? নিজের বাবাকে সত্যিই খুন করেন নেপালের যুবরাজ?
কিন্তু এই নোট ঘিরে ভারত-নেপাল সীমান্ত বিরোধ প্রসঙ্গ উঠছে কেন? ১৮১৬ সালে ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধের পর নেপাল ও ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মধ্যে সুগৌলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে নেপাল-ভারত সীমান্ত বিরোধ চলছে। এই চুক্তি অনুসারে, কালী নদীকে নেপালের প্রাকৃতিক পশ্চিম সীমান্ত হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল, যার পূর্বে লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা এবং কালাপানি অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা নেপালের অন্তর্গত।
তা সত্ত্বেও, এই অঞ্চলগুলি ১৯৬০ সাল থেকে ভারতের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই আঞ্চলিক ইস্যুতে উত্তেজনা বাড়ে ২০১৯ সালের নভেম্বরে। ভারত তখন একটি নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করে যাতে এই বিতর্কিত এলাকাগুলিকে ভারতের সীমানার অন্তর্ভুক্ত করে দেখানো হয়। নেপাল পাল্টা ২০২০ সালের মে মাসে তার নিজস্ব সংশোধিত রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করে প্রতিশোধ নেয়, এই এলাকাগুলিকে নেপালের বলে দাবি করা হয় সেই মানচিত্রে।
ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নেপালের একতরফা পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছেন, “আমাদের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। নেপালের সঙ্গে আমরা একটি প্রতিষ্ঠিত ফোরামের মাধ্যমে আমাদের সীমান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। এর মাঝে, তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু একতরফা পদক্ষেপ করেছে…কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বা আমাদের মধ্যকার বাস্তবতা পরিবর্তন হচ্ছে না।"
চিনকেই কেন নোট ছাপার দায়িত্ব দিল নেপাল? ইংরেজি দৈনিক রিপাবলিকা-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চায়না ব্যাঙ্কনোট প্রিন্টিং অ্যান্ড মিন্টিং কর্পোরেশনকে ট্রেন্ডার ডেকেই নির্বাচন করা হয়েছিল। ভারত-চিন-নেপাল ত্রি-সীমান্ত অঞ্চলের কূটনৈতিক অবস্থান এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বেশ কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলছেন, নেপাল সরকার, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহালের অধীনে জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে মাথায় রেখেই নতুন নোটের ব্যবহার করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, নেপালের নতুন নোট ছাপানোর পদক্ষেপ দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
নেপাল ও ভারতের মধ্যে ১,৭৫০-কিমি দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যা পাঁচটি ভারতীয় রাজ্য - সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড বরাবর বিস্তৃত। এই নোট ছাপানোর ইস্যু সীমান্তে পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নেপালের বিদেশমন্ত্রী নারায়ণ কাজী শ্রেষ্ঠা কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেছেন, “আমরা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা সমাধান করতে চাই। আমরা কূটনৈতিক উপায় এবং আলোচনার মাধ্যমেই এটি ঠিক করতে চাই। আমরা এর জন্য উদ্যোগ নিচ্ছি।" তবে, তাতে দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান কমবে কিনা তা সন্দেহের।
আরও পড়ুন- অমৃতপাল সিং থেকে ইয়াসিন ভটকল, ভারতকে এড়াতে কেন নেপালেই আশ্রয় নেয় অপরাধীরা?
নেপালের নোটে লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা এবং কালাপানির অন্তর্ভুক্তি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন?২০২০ সালের মে মাসে, ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যকে তিব্বতের কৈলাশ মানসরোবরের সঙ্গে সংযুক্ত করে লিপুলেখের মধ্য দিয়ে ভারত একটি ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা উদ্বোধন করার পরই নেপাল বিতর্কিত এলাকায় নিজের দাবিকে তীব্র করে তোলে। রাস্তাটিকে বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছিল কারণ এটি ভারত থেকে তিব্বত পর্যন্ত একটি পথ তৈরি করেছে। ভারত বলছে, এই এলাকাগুলিকে নেপাল নিজেদের অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার যে চেষ্টা করছে তা আসলে সীমান্তের 'কৃত্রিম সম্প্রসারণ'।
বিতর্কিত জমির আয়তন প্রায় ৩৩৫ বর্গকিলোমিটার। ভারত-নেপাল-চিন কৌশলগত অবস্থানের কারণে এই এলাকা গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশই কিন্তু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিনিময় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ সবই করে। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ থাকায় ভারত নেপালের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারও। এরই মাঝে মাথাচাড়া দিচ্ছে সীমান্ত সমস্যা। তাই এর কূটনৈতিক সমাধান না হলে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।