কাঁটাতারের বিভেদ মুছে দিচ্ছে সিরিয়াল! ভারতীয়রা কেন মজছে পাকিস্তানের বিনোদনে
Pakistani Serial: বিনোদন কোথাও গিয়ে দুই দেশকে এক করেছে এবং করে চলেছে।
ভারত-পাকিস্তানের যে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক তা কে না জানে? সে জমি নিয়ে হোক বা ক্রিকেট নিয়ে, উত্তেজনার পারদ কিন্তু কখনওই কমে না। সবক্ষেত্রেই দুই প্রতিবেশী দেশ পরস্পরকে টেক্কা দিতে যেন সর্বদা প্রস্তুত। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে এক টুকরোও জমি ছাড়তে রাজি নয় কখনওই। তবে এই সমীকরণ কিন্তু পাকিস্তানি বিনোদনের ক্ষেত্রে খাটে না। পাকিস্তানি সিরিয়াল ভারতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করছে ধীরে ধীরে। বিনোদনের ক্ষেত্রে ভারতের বিশ্বজোড়া নাম থাকলেও স্বয়ং ভারতীয় বাজারই ধীরে ধীরে দখল করছে পাক বিনোদন।
ভারতের বিনোদনের সুনাম পৃথিবীজোড়া। এমনকী, বাংলাদেশ, পাকিস্তানেও ভারতীয় সিরিয়াল-সিনেমার চাহিদা আকাশছোঁয়া। তবে এই চাহিদা কি সত্যি আগের মতো আছে? বাংলাদেশও স্বতন্ত্র ওয়েব সিরিজ বানানো শুরু করেছে ও যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। এবার একই পথে হাঁটছে পাকিস্তানও। পাকিস্তানের সিরিয়ালগুলো ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর থেকে গুণগত মানে অনেকাংশেই যথেষ্ট এগিয়ে বলে মনে করছে দর্শক। ভারতের সিরিয়াল অধোগামী হতে হতে যেন ধীরে ধীরে মিম মেটেরিয়ালে বদলে যাচ্ছে। ভারতীয়দের সিরিয়াল ও সিনেমার প্রতি টান বরাবরই বেশি, তাই এই দেশের দর্শকরাও প্রকৃত সিনেমা-সিরিজ বা সিরিয়ালকে সঠিক মর্যাদাও দিতে জানে। এবং সেই কারণেই ধীরে ধীরে সীমান্ত টপকে পাক সিরিয়াল বা নাটক আজ ভারতে এতটা সমাদৃত হচ্ছে।
কেন এই জনপ্রিয়তা? যেখানে ভারতের সিরিয়াল শুধু শাশুড়ি-বউমার ঘোরপ্যাঁচে আটকে গেছে, সেখানে ওপারের সিরিয়াল অনেকটাই খোলা বাতাস। তাই অনেকেই একটু ভিন্নধারার অথচ যুক্তিসংগত ও সাবলীল সিরিয়াল দেখতে পাক সিরিয়াল বেছে নিচ্ছে।
আরও পড়ুন: হলিউড-বলিউড নয়, কোন জাদুতে তরুণ প্রজন্ম মজছে কোরিয়ান সংস্কৃতিতে?
কেন পাক সিরিয়াল এতটা জনপ্রিয়
বাস্তবসম্মত গল্প, অতি-নাটকীয়তাহীন, সাবলীল পরিবেশনা ও পরিমিত সময় পাক সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার অন্যতম চাবিকাঠি। যেখানে ভারতীয় সিরিয়াল বিগত চার-পাঁচ বছর ধরে চলে, সেখানে পাক সিরিয়ালের আয়ু মাত্র তিন কি চারমাস। এখানকার সিরিয়ালগুলো প্রতিদিন আধঘণ্টা করে হয়, যার ফলে চার-পাঁচ বছর ধরে সিরিয়াল চালানোর জন্য যেনতেন প্রকারে কনটেন্ট ভরে তা দর্শকদের সামনে পরিবেশন করা হয়, একেকটি সিরিয়ালের পর্বসংখ্যা দু'হাজার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। অন্যদিকে ওপারের সিরিয়ালের পর্বসংখ্যা থাকে মাত্র পঁচিশ থেকে তিরিশ। প্রতি সপ্তাহে একটি করে এপিসোড সম্প্রচারিত হয়ে থাকে। ফলে দর্শকের মধ্যেও পরের এপিসোড দেখার চরম উত্তেজনা কাজ করে।
বিখ্যাত হিন্দি সিরিয়াল ‘কিঁউকি সাস ভি কভি বহু থি’, ‘কাহানি ঘর ঘর কি’ ইত্যাদি প্রায় আড়াই হাজারের বেশি পর্বসংখ্যা ছিল, কিন্তু গল্প বা পরিবেশনার নামে তা অনেকের কাছেই 'নির্যাতন' হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে বিখ্যাত পাক সিরিয়াল ‘জিন্দেগি গুলজার হ্যায়'-এর পর্বসংখ্যা ছিল মাত্র ২১টি। ওই একুশ পর্বের মধ্য দিয়েই সিরিয়ালটি আপামর দর্শকদের মন জয় করেছিল। তা দর্শকদের মন জয় করেছিল শুধুমাত্র গল্পের প্রেক্ষাপট ও পরিবেশনার গুণে। কিন্তু অনেকেই ভাববেন যে, ভারতীয় সিরিয়াল-সিরিজও তো কম যায় না, এত ঝকঝকে পরিবেশনা, এত সুন্দর প্রেক্ষাপট এবং এত বড় বিনোদনের বাজারকে পাকিস্তান কী করে টেক্কা দিচ্ছে? যেখানে পাকিস্তান বিনোদনের বাজারে এতটাও প্রতিষ্ঠিত নয়? এর উত্তর আছে। পাকিস্তান এবং ভারতীয় সিরিয়ালের মধ্যে তুলনা করলেই স্পষ্ট যে, ভারতীয় সিরিয়াল যেখানে দেখনদারিতে , সেখানে পাকিস্তানের সিরিয়ালগুলো বাস্তবসম্মত পরিবেশনে ভারতের থেকেও এগিয়ে অনেক। এবং এর জন্যই এত বিপুল সংখ্যক দর্শক পাক সিরিয়ালকে এতটা আপন করে নিচ্ছে।
বাস্তবের সঙ্গে মেলবন্ধন
ভারতীয় বিনোদনের মতো লার্জার দ্যান লাইফ করে সবকিছু দেখানোর প্রয়োজন পাকিস্তানের নেই। ভারতীয় সিরিয়ালে সাজপোশাক দেখলে মনে হতে পারে, বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই যেন উৎসব লেগে, রোজকারের সিনেও এত পরিমাণ মেক আপ বা বিয়েবাড়ির মতো পোশাক-পরিধান করানো এদেশের সিরিয়ালকে বাস্তবের আম আদমির থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি সিরিয়ালগুলোতে চরিত্রদের ঠিক ততটাই মেক আপ করানো হয়, যতটা সিরিয়ালের জন্য প্রয়োজন। পাক সিরিয়ালে যে কোনও সমস্যার সমাধান খুব সুচারুভাবে দেখানো হয়, অযাচিত কোনও ঘোরপ্যাঁচ থাকে না, যা দর্শকদের মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
অতি-নাটকীয়তার পরিসর নেই
কথায় কথায় ধুমতানানা মিউজিক বা একজনেরই মুখ সবরকম অ্যাঙ্গেল থেকে বারবার জুম আউট বা জুম ইন করা পাক সিরিয়ালের ধাতে নেই। অথবা সামান্য থাপ্পড় খেয়ে সেখান থেকে উড়ে গিয়ে পাশের পর্দায় গলা জড়িয়ে ফাঁস লেগে যাওয়ার মতো অস্বাভাবিক, যুক্তিহীন ঘটনা এই সিরিয়ালগুলোতে থাকে না। সাধারণ ও সরল প্রেক্ষাপটকে তারা সরল করেই দেখায়। পাক সিরিয়ালের সবথেকে বড় গুণ, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক তারে বাঁধা চিত্রনাট্য বজায় রাখে। শুরু যে গল্প নিয়ে হয়, শেষে গিয়ে তারই উপসংহার স্পষ্ট হয়। সিরিয়ালগুলো যেমন খেই হারিয়ে ফেলে না, দর্শকদেরও তেমন খেই হারাতে দেয় না। এখানকার সিরিয়ালের আর একটি দোষ, এরা যে কোনও বিয়ের বা অনুষ্ঠানকে মাসের পর মাস ধরে টানে। অন্যদিকে পাক সিরিয়ালগুলো কোনও বিয়ের অনুষ্ঠানকে বা যে-কোনও অনুষ্ঠানকে সুন্দরভাবে প্রদর্শন করতে মাত্র ১০-১৫ মিনিটের বেশি স্ক্রিন টাইম নেয় না।
চিত্রনাট্য সমাজের গল্প বলে
পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পাক সিরিয়ালগুলো নারীদের নিয়ে খুব সুন্দর গল্প বলে। ‘বাদশা-বেগম’, ‘মেরে হামসফর’, ‘বান্দ-খিরকিয়া’ ইত্যাদি শো-গুলি যেমন জনপ্রিয়, তেমনই দুর্দান্ত। সামাজিক সমস্যা, যেমন অবসাদ, নারীদের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি নিয়েও যেমন সিরিয়াল আছে, তেমনই হাসির বা মিষ্টি প্রেমের সিরিয়ালও রয়েছে। কিন্তু কোনও শো-ই বাস্তবতার থেকে এক চুলও এদিক থেকে ওদিকে নড়ে না বা পরবর্তীতে গিয়ে তা সাস-বহুর মেলোড্রামা বা একজন হিরোর পিছনে দশ জন মেয়ে ছুটছে, এরকম কিছু দেখানো হয় না। এতটা বাস্তববাদী বা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার জন্যই পাক সিরিজগুলিকে আজ সবাই স্বীকৃতি দিচ্ছে।
এছাড়াও পাক সিরিয়ালের উপরি পাওনা হলো সুদর্শন নায়ক-নায়িকা, যাঁরা অভিনয়েও পিছিয়ে নেই, যা তরুণ প্রজন্মকে আরও বেশি আকৃষ্ট করছে। ফাওয়াদ খান, ফারহান সাইদ, হানিয়া আমির, মাহিরা খান, সারা আলি, হিরা মানি, সজল আলি প্রমুখ তারকা এখন ভারতীয়দেরও পছন্দের তালিকায় রয়েছে। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, নেপালেও পাক সিরিয়াল ভীষণ জনপ্রিয়। এবং ধীরে ধীরে এই দেশেও পাক সিরিয়ালের অনুরাগীদের সংখ্যার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে দিনকে দিন।
ভালো লাগার বিষয় এটাই যে, দুই দেশের মধ্যে এত বিবাদ-দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও বিনোদন কোথাও গিয়ে দুই দেশকে এক করেছে এবং করে চলেছে। বিখ্যাত বিখ্যাত পাক শিল্পীর ছোঁয়ায় ভারতের সংগীত ও চলচ্চিত্র আরও পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। ভারতীয়রা আজীবন ভালো সিনেমা বা সিরিজের ভক্ত; আর সেই জন্যই এত বিবাদ সত্ত্বেও পাক বিনোদনকে আপন করতে পিছপা হচ্ছে না এদেশের দর্শকও। পাক সিরিজও ধীরে ধীরে নিজেদের গুণে মন জয় করছে আপামর ভারতবাসীর।