"প্লিজ হাতি পাঠান না," কেন নেহরুকে হাজার চিঠি লিখেছিল টোকিও, বার্লিনের শিশুরা?
Jawaharlal Nehru Elephants: মহীশূর রাজ্য থেকে আনা হাতিটির নাম নেহেরু তাঁর মেয়ের নামেই রেখেছিলেন, ইন্দিরা। কয়েক মাস পরেই, হাতি ইন্দিরাকে টোকিওতে পাঠানো হয়।
সাল ১৯৪৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টোকিওর মেয়র জানালেন তিনটি হাতিকে মেরে ফেলা হবে। জাপানের প্রাচীনতম চিড়িয়াখানা উয়েনোর তিনটি হাতিকে মেরে ফেলতেই হবে কারণ বিমান হামলার সময় এই হাতিগুলো ছাড়া পেলে স্থানীয় জনগণের বিপদ আরও বাড়বে। এই তিনটি হাতির মধ্যে দু'টিকে ১৯২৪ সালে আনা হয়েছিল ভারত থেকে। একজনের নাম ছিল জোন (পুরুষ) এবং অপরটি টঙ্কি (স্ত্রী)। তৃতীয় হাতি হানাকোকে আনা হয়েছিল থাইল্যান্ড থেকে। উয়েনো চিড়িয়াখানার এই তিন হাতি বাচ্চাদের কাছে ছিল সবচেয়ে আকর্ষণের। কিন্তু প্রাণ আগে, হাতি পরে। তাই বোমা হামলার ভয়ে এই তিন হাতিকে মেরে ফেলার নির্দেশই দেন মেয়র।
প্রথমে, প্রশাসন ভেবেছিল সূঁচ ফুটিয়ে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু হাতির চামড়া বলে কথা, সুঁচ তো ফোটানোই দুষ্কর হয়ে পড়ে। খাবারে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা হলো কিন্তু হাতিরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান! সেই খাবার ছুঁয়েও দেখল না তারা। অবশেষে, সিদ্ধান্ত হলো হাতিদের না খেতে দিয়েই মারা হবে। সে এক মর্মান্তিক ঘটনা! তিনটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেঁচেছিল টঙ্কি। খিদের জ্বালায় ছটফট করত। খাঁচার বাইরে দিয়ে কোনও মানুষ গেলে প্রাণ ঢেলে কত কসরতই না করত যাতে কেউ একটু খাবার দেয়। আস্তে আস্তে হাতিদের কথা বড়রা ভুলেই গেল, শিশুরা ভুলতে পারল না। যুদ্ধের কয়েক বছর পর, জাপান যখন ছন্দে ফিরছে তখন সপ্তম শ্রেণির দু'জন পড়ুয়া জাপানি সংসদের উচ্চকক্ষে একটি পিটিশন জমা দেয়। চিড়িয়াখানায় হাতি দেখতে না পাওয়ার ক্ষোভ জানিয়ে অনুরোধ করে যে নতুন করে ফের প্রাণীদের ফিরিয়ে আনা হোক জাপানে।
আরও পড়ুন- ছোট্ট চালে নেহরুকে একঘরে করেছিলেন, মোদিদের আসল পূর্বসূরি তিনিই
শুধু এই একটা পিটিশনই নয়, টোকিও সরকার শিশুদের কাছ থেকে হাজার খানেকেরও বেশি চিঠি পায়। সবগুলোই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে লেখা। সবেতেই ফের হাতি পাঠানোর অনুরোধ। কলকাতার একজন রপ্তানিকারক তরুণ হিমাংশু নিয়োগী এবার ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়েন হাতির দাবির সঙ্গে। কীভাবে? শহরের স্কুল পরিদর্শনের জন্য ব্যবসায়িক ভ্রমণের সময় কিছুটা বিরতি নিয়েছিলেন হিমাংশু। যখন ভারতে ফেরার সময় আসে তখন জাপানের মানুষ প্রায় হাতে পায়ে ধরে তাঁকে অনুরোধ করেন যাতে তাঁদের ভারতীয় হাতি পাঠানোর কথা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে সুপারিশ করা হয়।
দেশে ফিরে এই বাঙালি তরুণ জওহরলাল নেহরুর কার্যালয়ে যান। জাপানের শিশুদের কাছ থেকে আনা ৮১৫টি চিঠি তিনি নেহেরুকে দেন। প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী সুমিকো কানাতসু ইংরেজিতে চিঠি লিখে বলেছিল, “টোকিও চিড়িয়াখানায় আমরা কেবল শুয়োর আর পাখি দেখতে পাই। এতে আমাদের কোনও আগ্রহই জাগে না। একটা ইয়াব্বড় হাতি দেখার ইচ্ছা জাপানের বাচ্চাদের অনেক দিনের স্বপ্ন! আপনি বুঝতে পারছে আমরা কতটা চাইছি হাতি দেখতে? মাসানোরি ইয়ামাতো আরেকটি চিঠিতে জানিয়েছিল, সেই তিনটি হাতিকে তাঁরা এখনও স্বপ্নে দেখে।
এই চিঠিগুলি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নেহরু বিদেশ মন্ত্রককে একটি হাতি সংগ্রহ করতে এবং তহবিল আর পরিবহন ব্যবস্থার জন্য উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেন। মহীশূর রাজ্য থেকে আনা হাতিটির নাম নেহেরু তাঁর মেয়ের নামেই রেখেছিলেন, ইন্দিরা। নেহরু সেই চিঠিগুলি পাওয়ার কয়েক মাস পরেই, হাতি ইন্দিরাকে টোকিওতে পাঠানো হয়।
১৯৪৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইন্দিরা আসে উয়েনোতে। চিড়িয়াখানা জুড়ে সেদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড়। একটি চিঠিতে নেহরু লিখেছিলেন, "আমি আশা করি, যখন ভারতের শিশুরা এবং জাপানের শিশুরা বড় হবে, তখন তারা কেবল তাদের দেশই নয়, সমগ্র এশিয়া এবং বিশ্বজুড়ে শান্তি ও সহযোগিতার কারণ হয়ে উঠবে। তাই ভারতের সন্তানদের স্নেহ ও শুভেচ্ছার বার্তাবাহক হিসেবে এই ইন্দিরা নামের হাতিটিকে ভালো রেখো। হাতি এক মহৎ প্রাণী। হাতি জ্ঞানী এবং ধৈর্যশীল, শক্তিশালী এবং নরমও। আমি আশা করি আমাদের সকলের মধ্যেও এই গুণাবলীর বিকাশ ঘটবে।”
কিন্তু ইন্দিরা তো সেই সময় কেবল কন্নড় ভাষায় আদেশ অনুসরণ করে শিখেছে। জাপানের দুইজন মানুষ ইন্দিরাকে দেখভালের জন্য দুই ভারতীয় মাহুতের থেকে কন্নড় ভাষা শিখে যান। এর প্রায় আট বছর পর ১৯৫৭ সালে, প্রধানমন্ত্রী নেহেরু এবং তাঁর কন্যা ইন্দিরা জাপান সফরে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে এই হাতির সঙ্গে দেখা করে আসেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাতি ইন্দিরা জাপান ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছিল।
আরও পড়ুন- নেহরু থেকে ইন্দিরা, ডায়েটে যায় নেতা চেনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বার্লিনের চিড়িয়াখানার প্রাণীরাও টোকিওর মতোই সমস্যায় পড়ে। যুদ্ধের কয়েক বছর পর, বার্লিন চিড়িয়াখানায় হাতি না দেখে খুবই ভেঙে পড়ে বার্লিনের শিশুরা। তারাও নেহরুকে চিঠি লিখে হাতি পাঠানোর অনুরোধ করে। সেই চিঠিগুলি পেয়ে ১৯৫১ সালের জুন মাসে শান্তি নামের তিন বছর বয়সী একটি স্ত্রী হাতিকে বার্লিনে পাঠান নেহরু।
এর বছর দুই পরে ১৯৫৩ সালে নেহরু কানাডার পিটার মারমোরেক নামে পাঁচ বছরের এক শিশুর কাছ থেকে আরেকটি চিঠি পান। “প্রিয় মিস্টার নেহেরু, এখানে কানাডার একটি ছোট শহর গ্র্যানবিতে, আমাদের এক সুন্দর চিড়িয়াখানা আছে, কিন্তু আমাদের কোনও হাতি নেই।" আসলে বাচ্চাটি তার বাবার কাছ থেকে শুনেছিল যে নেহেরুর কাছে অনেক হাতি। তিনিই তাঁদের হাতি পাঠাতে পারবেন। ১৯৫৫ সালে গ্র্যানবি চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয় অম্বিকা নামে একটি দুই বছর বয়সী হাতিকে। স্রেফ বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের খাতিরে শিশুদের কোনওদিনই ফেরাননি নেহরু। আন্তর্জাতিক সীমানা পার করে প্রাণী স্থানান্তরের উপর পরিবেশ মন্ত্রক ২০০৫ সালের নিষেধাজ্ঞা জারি করে।