কৃষক আন্দোলনকে রুখতে গোদি মিডিয়ার নীরবতাই নয়া 'হাতিয়ার'?
Farmers Protest: আন্দোলন প্রতিরোধ করতে একদিকে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান, লোহার ব্যারিকেড। একই সঙ্গে বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে গোদি মিডিয়ার নীরবতা।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আঁচে হাত সেঁকছে সব রাজনৈতিক দল। একদিকে রামমন্দির, অন্য দিকে রাজ্যে রাজ্যে দুর্নীতির অভিযোগ— জোড়া অস্ত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাইছে বিজেপি। কিন্তু বাধ সাধছে দিল্লির কৃষক আন্দোলন। কৃষকদের 'দিল্লি চলো' অভিযানের জেরে উত্তাল পঞ্জাব থেকে দিল্লি, শম্ভু ও সিঙ্ঘু সীমানা। আন্দোলন প্রতিরোধ করতে একদিকে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান, লোহার ব্যারিকেড। একই সঙ্গে বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে গোদি মিডিয়ার নীরবতা। দিল্লিতে বসে দিল্লির মিডিয়া প্রতিনিধিরা যখন প্রতি সন্ধেয় সন্দেশখালি নিয়ে চিন্তা জাহির করে অথচ একবারের জন্যেও কৃষক আন্দোলন গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরার দায় অনুভব করে না, তখন তাদের অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয় বইকি।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা (এমএসপি), কৃষি ঋণ মকুব এবং স্বামীনাথন কমিশনের সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের মতো একাধিক দাবি নিয়ে পথে নেমেছেন কৃষকেরা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা ও কৃষক নেতাদের মধ্যে চার দফা আলোচনা হওয়ার পরও কোনও সমাধান হয়নি। বরং রাজধানীতে ১৩ মার্চ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা চলবে বলেই প্রশাসনিক সূত্রে খবর। দিল্লি ও তার সংলগ্ন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার নিরাপত্তায় আরও জোর দিচ্ছে প্রশাসন। সাত জেলায় ইন্টারনেট এবং এসএমএস পরিষেবা বন্ধ। কৃষকরা শম্ভু ও খানাউরি বর্ডার পয়েন্টে অস্থায়ী শিবির বানিয়ে অবস্থান করছেন।
আরও পড়ুন: তরুণ কৃষকের মৃত্যুতে আগুনে ঘি! ভোটের আগে যে পথে এগোচ্ছে দেশের কৃষক আন্দোলন
শুধুমাত্র ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারিই আন্দোলনরত কৃষকদের প্রায় ৬০ জন জখম হন। চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন দু'জন এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এক ব্যক্তির। এত কিছু সত্ত্বেও কিন্তু মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে জাতীয় ইস্যু হিসেবে জায়গা করে নিতে পারেনি কৃষক আন্দোলন। কৃষক আন্দোলন নিয়ে কোনও প্রাইম টাইম শো করেননি অর্ণব গোস্বামী, সুধীর চৌধুরীরা। এখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয় নিয়ে একরকম নিশ্চিত বলেই কি রাজধানীতে আন্দোলনকারীদের উপস্থিতিতে অগ্রাহ্য করছে গোদি মিডিয়া? নাকি গলায় কাঁটার খচখচ সত্ত্বেও নির্বিকার ভাবমূর্তি তুলে ধরতেই এই নীরবতা?
সন্দেশখালি এবং কৃষক আন্দোলন বিষয় সংবাদমাধ্যমের ভুমিকার নিয়ে কৃষক নেতা অভীক সাহা জানান, "সন্দেশখালি বিষয়টা রাজনৈতিক। দু-তিনটি দলের মধ্যে রেষারেষি চলছে। সেটায় কোনও মিডিয়া পক্ষ নিচ্ছে, কোনও মিডিয়া অন্যদিকে কথা বলছে। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের একটাই পক্ষ আছে সারা দেশে। সেটা অন্নদাতাদের। সারাদেশে দু'বেলা খেতে পাওয়ার যে অন্ন-ব্যবস্থা রয়েছে, সেই ব্যবস্থা নিয়ে এই আন্দোলন।"
প্রথম কৃষক আন্দোলনের সময়েও একই রকম গা-ছাড়া ভাব দেখিয়েছিল দিল্লির কর্পোরেট মিডিয়া। আন্দোলনকারীদের তরফে কোনও প্রতিনিধির উপস্থিতি ছাড়াই চিৎকার-চেঁচামেচিতে আলোচনা সভা শেষ হয়ে যেত। কৃষক আন্দোলনের প্রচারের বিষয়ে অভীকবলেন, 'আমাদের নিজেদের যে আইটি ব্যাবস্থা আছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে, সেখানে কৃষক আন্দোলনের যে পেজ আছে তাতে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার আছে। সকলের নজর থাকে কৃষক আন্দোলনের উপরে।'
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই, কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রতিবাদকে দেশদ্রোহিতা হিসেবে দাগাতে চেয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছেন কৃষক থেকে সাংসদ, ডাক্তার থেকে আইনজীবী, সাংবাদিক থেকে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, প্রায় সকলেই। আন্দোলনকারী মুসলিম হলেই তিনি পাকিস্তানি, শিখ হলে তিনি খলিস্তানি, আর বাংলার হলে বাংলাদেশি। গোদি মিডিয়া এই স্রোতেই গা ভাসিয়েছে।
২০২১ সালে 'নিউজলন্ড্রি'-র একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে কিসান মোর্চার মিডিয়া টিমের প্রতিনিধি তথা অল ইন্ডিয়ান কিষান সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সদস্য আশুতোষ মিশ্র বলেছিলেন, গোদি মিডিয়ার প্রতিবেদকেরা সাধারণত এমন একজন ব্যক্তিকে নিশানা করেন, যিনি যথেষ্ট জানেন না এবং শেষ পর্যন্ত অজান্তে কিছু ভুল বলে ফেলেন। সংবাদ চ্যানেলগুলি এরপর আন্দোলনের অসারতা তুলে ধরতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে।
২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি, একজন প্রতিবাদী কৃষক তিনটি বিতর্কিত কৃষি বিল আইনের পাস হওয়ার বিরুদ্ধে দিল্লির লালকেল্লার প্রাচীর থেকে শিখ ধর্মের পতাকা উড়িয়েছিল। সেই প্রতিবাদী কৃষককে গোদি মিডিয়া 'খলিস্তানি' বলে আখ্যা দেয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কৃষকদের দেশদ্রোহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী অংশ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ( টুকরে টুকরে গ্যাং) বলে চিহ্নিত করেছিল। আর বিন্দুমাত্র যাচাই না করে সংবাদমাধ্যম বারংবার এই ভাষ্যই প্রচার করে গিয়েছে।
২০২১ সালে মার্চ মাসে 'দ্য ওয়্যার'-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আমরোহার একজন কৃষক সুখদর্শন সিং প্রশ্ন তুলেছিলেন, ২৬ শে জানুয়ারি লালকেল্লা হিংসার ঘটনায় ২৫০ জন কৃষক শহিদ হওয়ার পরও কেন কৃষকদের উদ্দেশ্যে কোনও বার্তা দেয়নি প্রধানমন্ত্রী। তিনি কি নিহতদের বা তাঁদের শোকাহত পরিবারের প্রধানমন্ত্রী নন? কৃষক আন্দোলনের এই দ্বিতীয় স্রোতে যে কৃষকেরা দৃষ্টি হারিয়েছেন, ২২ বছরের যে যুবক-কৃষকের প্রাণ গেল, হৃদরোগে যিনি মারা গেলেন, তাদের তাদের জন্যেও কি এবারেও কিছুই বলার নেই প্রধানমন্ত্রীর? এই প্রশ্নগুলি করার দায়িত্ব কার? সংবাদমাধ্যমের নয় কি?
আরও পড়ুন: কৃষকদের ফের আলোচনায় বসার ডাক! ভোটের মুখে অবস্থান থেকে সরবে বিজেপি সরকার?
অভীকবাবুর মতে, কৃষক আন্দোলনে যে জমায়েতগুলো হয়েছিল ভোটে তার তাৎক্ষণিক ফল দেখা গিয়েছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্রিশগঢ় ভোটে। তিনটে রাজ্যই ছিল বিজেপি-শাসিত এবং সেই তিনটে রাজ্যেই বিজেপি হেরে যায়। মধ্যপ্রদেশে অবশ্য পরে ভোট কারচুপি করে সরকার গঠন করে তারা। মধ্যপ্রদেশে এবং ছত্তিশগঢ়ে বিজেপি তিনটি টার্ম ধরে সরকারে ছিল বিজেপি। মানে ১৫ বছর ধরে তাঁরা শাসন করছিল, অথচ তাঁরা হেরে যায়। আর এ সমস্ত কিছুকেই কৃষক আন্দোলনের অবদান বলে মনে করছেন কৃষকনেতা অভীক। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে এই কৃষক আন্দোলন? ২০২০ সালের নভেম্বরে যে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল তা চলেছিল ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সেই আন্দোলনে জয়ের আরও একটি বড় কারণ কিন্তু ছিল কেন্দ্রে বিজেপি বুঝতে পেরেছিল কৃষক আন্দোলনের জেরে তাঁরা উত্তরপ্রদেশের মত বড় রাজ্যে হেরে যেতে পারে। উত্তরপ্রদেশে ভোট ছিল তারপরের বছর এপ্রিল মাসে। তাই তারা এক বছর আন্দোলনের দিকে তাকায়নি। নভেম্বর মাসে এসে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চেয়ে তিনটি আইন বাতিল করেন এবং কৃষক আন্দোলনের জয় হয়। অভীকের মতে, কৃষকরা রাস্তায় বসে আছে, কৃষকদের জন্য সরকারের দুঃখ হচ্ছে বলে কিন্তু আইন বাতিল করা হয়নি। বাতিল হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে আসন্ন ভোটের কথা ভেবে।
আসলে আমরা এমন একটা সময়ে বসবাস করছি, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রচারকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য মিডিয়াকে একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বারবার তাই বঞ্চিত, লাঞ্ছিত গোষ্ঠীর দিকেই আঙুল তোলা হচ্ছে। রাজ্যগুলির অশান্তিকে কি এ কারণেই বড় করে দেখানো হচ্ছে, যাতে সেখানে বিজেপির প্রবেশপথ উন্মুক্ত হয়? স্বভাবতই কৃষক আন্দোলন নিয়ে কেন্দ্র ও গোদি মিডিয়ার এই নির্লিপ্তি দেখে সেই প্রশ্নগুলি উঠেছেই।