বিজেপির সব হিসেব ঘেঁটে দিচ্ছেন রাহুল! কোন কৌশলে মোদিকে ঘাবড়ে দিচ্ছেন 'পাপ্পু'?
Rahul Gandhi: নরেন্দ্র মোদি পরের নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিজেপিতে নেতৃত্বের সাময়িক শূন্যতা তৈরি হবেই
গান্ধিজির অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন সফল হওয়া নিয়ে একটি তত্ত্ব রয়েছে। যুদ্ধপ্রিয় ইংরেজদের কাছে এমন অহিংস আন্দোলন সিলেবাসের বাইরে ছিল। আপনি যখনই প্রতিপক্ষকে চেনা ছকের বাইরে নিয়ে যাবেন, তখনই সেই প্রতিপক্ষ খানিকটা হকচকিয়ে যাবে। গান্ধিজি ঠিক এটাই করেছিলেন। এমন অসহযোগ, সত্যাগ্রহ আন্দোলন ইংরেজরা প্রত্যাশা করেনি। ফলে তারা প্রথমে ঘাবড়েই গিয়েছিল। গান্ধি সাফল্য পেয়েছেন।
রাহুল গান্ধি অবশ্যই মহাত্মা গান্ধি নন কিন্তু সম্প্রতি তিনি শাসক শিবিরকে বার বার চেনা ছকের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলছেন। সিলেবাসের বাইরে গিয়ে বিজেপির পক্ষে রাহুলের মোকাবিলা করা অনেক সময়েই মুশকিল হচ্ছে, অন্তত এখনও পর্যন্ত।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাহুল গান্ধি কংগ্রেস বা ইন্ডিয়া জোটকে সরকারে আনতে পারেননি। এ কথাও ঠিক যে রাহুলের দলের কাছে লোকসভায় মাত্র ৯৯টি আসন, যেখানে শুধু বিজেপির কাছেই ২৪০জন সাংসদ। বিজেপি একাই যেখানে প্রায় ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে এবারের নির্বাচনে, সেখানে কংগ্রেসের ভোট মাত্র ২১ শতাংশ। সুতরাং সংখ্যার বিচারে বিজেপি কংগ্রেসের থেকে এগিয়ে রয়েছে। ৫৪৩-এর মধ্যে ৯৯ পাওয়া কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধিকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি সংসদের মধ্যেই উপহাস করেছেন। মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন আগের নির্বাচনের থেকে ২০২৪ সালে তিনি ৬০টির মতো কম আসন পেলেও, চালকের আসনে তিনিই আসীন।
ঠিক। কিন্তু তিনি স্বীকার করুন বা না করুন, এই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির এবং বিজেপির যে নৈতিক পরাজয় হয়েছে, তা উপহাসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এই নৈতিক পরাজয়ে বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির মতোই রাহুল গান্ধির ভূমিকা রয়েছে। ছক ভাঙা খেলাতেই নৈতিক জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন রাহুল। আর ছক ভাঙা খেলাতেই বিজেপিকে বিপাকে ফেলছেন তিনি। 'আপ ক্রনোলজি সামঝিয়ে'!
আরও পড়ুন- কোন পথে মণিপুর সমস্যার সমাধান? দিনভর সফর শেষে উপায় বাতলালেন রাহুল
২০১৪ এবং ২০১৯-এ রাহুল বনাম মোদির লড়াইয়ে গোহারা হেরেছিলেন রাহুল গান্ধি। নিজের দোষেই তিনি 'পাপ্পু' তকমা জুটিয়েছিলেন নিজের জন্য। মাঝেমাঝেই ছুটি কাটাতে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য 'যাযাবর রাজনীতিক' হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন রাহুল। আর কংগ্রেসের সভাপতির পদ ছাড়ার পরে দলের কোনও দায়িত্বে না থাকতে চাওয়া বা সংসদেও দলের নেতার পদ না নেওয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি যেন দায়িত্ব থেকে দূরে থাকতে চান বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বারেবারে। বিজেপি কেন, বিজেপি-বিরোধী দলগুলিও রাহুলকে গুরুত্ব দিতে নারাজ ছিল।
যাঁর বা যাঁদের পরামর্শেই হোক রাহুল গান্ধি নিজেকে বদলেছেন ধীরে ধীরে। তাঁর প্রথম পদক্ষেপ যদি দু'টি ভারত-জোড়ো যাত্রা হয়, তবে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সরাসরি ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে না গিয়ে পুরো আলেখ্য আদর্শগত এবং ইস্যুভিত্তিক লড়াইয়ে নিয়ে যাওয়া।
রাহুল নিজেও জানতেন, গোটা ভারত জুড়ে জনপ্রিয়তার বিচারে তিনি নরেন্দ্র মোদির ধারে কাছে আসতে পারবেন না। এবারের নির্বাচনে প্রথম ছক তিনি এটাই ভেঙেছিলেন। নিজের ইমেজ তৈরি করে, রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে তিনি রাজনীতির বাইরে গিয়ে তাঁর আদর্শগত লড়াইয়ের কথা বলেছেন। হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক বহুত্ববাদের কথা বলেছেন। মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ভালো থাকার বিষয়কে সামনে এনেছেন। ঘূণার রাজনীতির বিরুদ্ধে ভালোবাসার রাজনীতির কথা বলেছেন। সেখানে নিজের দলের সবাইকে পাশে পাননি। অনেক সতীর্থ দল ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি তাঁদের আটকানোর চেষ্টাও করেননি। নিজের পথে অটল থেকেছেন।
নির্বাচনের আগে ইন্ডিয়া জোট নিয়েও একইরকম অবস্থান নিয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উত্তরপ্রদেশে ও তামিলনাড়ুতে শক্তপোক্ত জোট করলেও তৃণমূলের সঙ্গে জোট করেননি। নিজের শর্তে ও পথে অনড় না থাকলে রাহুল যেনতেন প্রকারেণ তৃণমূলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে জোট করেই ফেলতেন।
নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে পড়া জাতির মানুষের সামনে আনার চেষ্টা, দেশের সম্পদের সুষম বণ্টন, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির মতো ইস্যুগুলিকে সামনে এনেছেন। নিজেকে নরেন্দ্র মোদির সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরেননি। ফলে মোদির '৫৬-ইঞ্চি ছাতির' ইমেজ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের চেনা ছক উল্টে গেছে। মোদির হিন্দুত্বের বার্তা শুধু কিছু পকেটেই কাজ করেছে, সারা ভারত জুড়ে করেনি। এমনকী, উত্তরপ্রদেশেও হিন্দু-জাতীয়তাবাদের আলেখ্য কাজ করেনি।
আরও পড়ুন- রাহুলের চাপে দিশেহারা মোদির একমাত্র হাতিয়ার অম্বেদকর, এমারজেন্সি?
যে মূলধারার মিডিয়া রাহুলকে গত দশ বছর শুধু আক্রমণই করে গেছে, সেই মূলধারার মিডিয়ার উপর রাহুল ভরসাই করেননি। বিকল্প মিডিয়া বেছে নিয়েছেন মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছনোর জন্য। গোটা নির্বাচন পর্বে যখন নরেন্দ্র মোদি একের পর এক টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে চলেছেন, তখন রাহুল কিন্তু নিজেকে প্রচারের আলোয় রেখেছেন শুধু বিকল্প ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এখানেও তিনি ছক ভেঙেছেন।
নবনির্বাচিত লোকসভায় রাহুল গান্ধি দায়িত্ব নিতে পিছপা হননি। নির্বাচন শেষ হতে না হতেই রাহুল ইতালিতে ছুটি কাটাতে চলে যাবেন বলে যখন প্রচার হচ্ছিল, তখন তিনি বিরোধী জোটকে এক করা এবং নিজের দলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছেন। অনেকে যখন মনে করছিলেন যে রাহুল গান্ধি দায়িত্ব ছাড়াই ক্ষমতা ভোগ করতে ভালবাসেন, তিনি তখন লোকসভায় বিরোধী দলনেতার পদটি গ্রহণ করে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছেন। নতুন লোকসভার প্রথম ভাষণে তিনি নিজের মতো করে সব ধর্মের অহিংস ভাবটি নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর বক্তৃতার মাঝে প্রধানমন্ত্রী-সহ দুই প্রবীণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকেও দাঁড় করিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদিও এখনও তাঁর চেনা ছকেই খেলার চেষ্টা করছেন। নিজেকে শক্তিশালী নেতা ও রাহুলকে 'বালকবুদ্ধি' বলে লড়াইয়ের সুর বাঁধতে চাইছেন কিন্তু সেই চেনা ছক বিশেষ কাজে লাগছে না।
রাহুল গান্ধি এর আগেও মণিপুর গেছেন, কৃষক-ক্ষেতমজুরদের মাঝে গেছেন, বাজারে গিয়ে মুটে-মজদুরদের সঙ্গে কথা বলেছেন কিন্তু এখন লোকসভার বিরোধী দলনেতা হিসেবে তাঁর এই ছোট ছোট সফর বড় হয়ে উঠছে। আরও বড় হবে। বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে মণিপুর নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য করেছে। এবার প্রধানমন্ত্রীকেও রাহুলের আলেখ্যর সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। যদিও এখনও পর্যন্ত তিনি 'ভাঙব কিন্তু মচকাব না' অবস্থানই নিয়ে রেখেছেন।
তবে এখনই রাহুলকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী বা তিনি নরেন্দ্র মোদিকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছেন — এমন বলার মতো জায়গা আসেনি। তিনি খুব সরু দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছেন।
আরও পড়ুন- ইন্দিরার জরুরি অবস্থার বিরোধিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন RSS পরিচালক
প্রথমত তিনি বিরোধী দলনেতা হিসেবে নিজেকে যতটা প্রচারের আলোয় রাখবেন ততই 'মোদি বনাম রাহুল' — এই চেনা আলেখ্য ফিরে আসবে। তুল্যমূল্য বিচারে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে জনপ্রিয়তায় পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করার সময় আসেনি। কিন্তু বিরোধী দলনেতা হওয়ার পর তাঁর যেখানে সেখানে ছুটে যাওয়ার মাধ্যমে তিনি 'জনগণেরই নেতা' প্রমাণ করার চেষ্টায় থাকবেন রাহুল। অন্তত তাঁর ম্যানেজারেরা সেই চেষ্টাই করবেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি সাংবিধানিক জাতীয়তাবাদকে পিছনে রেখে হিন্দুত্বের এক অন্য আলেখ্য তৈরির চেষ্টা করেছেন সংসদে দাঁড়িয়ে। বিজেপি যে সব হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করে না এবং হিন্দুত্ব যে অহিংস, তা বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন। বিজেপি-আরএসএসের কাছে এটি একটি প্রিয় বিষয়। তিনি তাঁর গড়া হিন্দুত্বের ব্যাখ্যা দিয়ে সংঘ পরিবারের কঠিন আদর্শগত হিন্দুত্বের মোকাবিলা কীভাবে করবেন সেটা দেখতে হবে। কাজটি সহজ নয়।
তবে যেটা অনুমেয় তা হলো, নরেন্দ্র মোদি পরের নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে এমন একজন শীর্ষ ও শক্তিশালী নেতার অনুপস্থিতিতে বিজেপিতে নেতৃত্বের সাময়িক শূন্যতা তৈরি হবেই। অমিত শাহ বা যোগী আদিত্যনাথকে দিয়ে বা হঠাৎই অন্য কাউকে সামনে এনে সেই শূন্যস্থান পূরণ করা বেশ কঠিন কাজ। অটলবিহারী বাজপেয়ীর পরে লালকৃষ্ণ আডবানিও সেই কাজটি ঠিক মতো করতে পারেননি। সেক্ষেত্রে রাহুল গান্ধির কাজটি সহজ হতে পারে।
কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, রাহুল গান্ধি এখনও কংগ্রেসের একক শক্তিতে বিজেপিকে ছাপিয়ে যাওয়ার অবস্থায় নেই। সুতরাং তাঁকে ইন্ডিয়া জোটের ছায়াতেই থাকতে হবে। অবশ্যই যদি তিনি সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখেন। সুতরাং শরিকদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে জোটধর্ম পালন তাঁকে করতেই হবে। সেখানে তাঁর 'কে থাকল বা কে গেল কুছ পরোয়া করি না' মনোভাব কাজে দেবে না।
তবে ১০ বছর পরে ভারতে বিরোধী জোট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। আশা করা যায় রাহুল গান্ধিও ভারতের রাজনীতিকে চেনা ছকের বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন। তবেই জমবে রাজনৈতিক খেলা। আপাতত বিজেপি রাহুল গান্ধিকে গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না।