ভারতে বাড়ছে স্কুলছুট, আসল কারণ কী? ভয়াবহ ইঙ্গিত সমীক্ষায়

দারিদ্র, স্কুলের দূরত্ব, অভিভাকদের আচরণ- সাধারণত বিশ্বব্যাপী স্কুলছুটের প্রধান কারণ। ভারতের পরিস্থিতি কিন্তু ভয়ানক। অন্তত তেমনই নির্দেশ করছে এনএফএইচএস। তারা উল্লেখ করছে, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ না থাকার জন্য বাচ্চারা স্কুল য...

 

কোভিড বদলে দিয়েছে জীবনযাপন। শিক্ষা, স্বাস্থ‍্য, খাদ্য- সামগ্রিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। ঘরে সিঁধিয়েছে অনলাইন অ্যাপ। খাওয়া-পরা, পড়াশোনা- সব কিছুতে অনলাইনের থাবা। করোনা বিদায় নিলেও এই প্রবণতা পরিবর্তন হয়নি খুব একটা। সম্প্রতি বাচ্চাদের স্কুলছুটের মাত্রা বেড়েছে কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে। এই নিয়ে চিন্তায় কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক। অর্থনৈতিক সাহায্য এবং বিভিন্ন পড়ার সামগ্রী দেওয়ার পরও কেন দেশের আগামী প্রজন্ম স্কুলমুখী হচ্ছে না, তাই নিয়ে উদ্বেগের কারণ আছে। স্বাভাবিকভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে শিক্ষা মন্ত্রক।

স্কুলের দূরত্ব বা পড়ার খরচ যে স্কুলছুটের মূল কারণ নয়, তা সমীক্ষা করে প্রমাণ করেছে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (এনএফএইচএস)-৫। তারা ২০১৯-'২১ সালের মধ্যে সারা দেশে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, পড়ার খরচ নয়, পড়ার প্রতি অনাগ্রহই পড়ুয়াদের স্কুলবিমুখ করছে। এনএফএইচএস-৫ জানাচ্ছে, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ না থাকার জন্য ৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে ২১.৪ শতাংশ মেয়েরা এবং এই একই বয়ঃসীমার মধ্যে ৩৫.৭ শতাংশ ছেলেরা স্কুলছুট। ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের একটি গোষ্ঠীর অধীনে মুম্বইভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন স্টাডিজ এই সমীক্ষা চালায়। ২০,০৮৪ ছাত্র এবং ২১,৮৫১ ছাত্রীর ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষা চালিয়ে চোখ ছানাবড়া সমীক্ষকদের। এই শতকে দাঁড়িয়ে শিক্ষায় এত অনীহা! হাজার সুযোগসুবিধা পেলেও কেন বাচ্চারা স্কুলমুখী হচ্ছে না। মিডডে মিল প্রকল্প কোভিডের সময় ধাক্কা খাওয়ায় কি এই স্কুলছুট? এই নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন, তা মানছেন শিক্ষাবিদরা। কারণ এই প্রবণতা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক।

শিক্ষা মন্ত্রকের বর্তমান পরিসংখ্যান মারাত্মক চিত্র তুলে ধরেছে। উঁচু ক্লাসে সবচেয়ে বেশি শিক্ষাবিমুখতার প্রবণতা। 'ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন' ২০২০-'২১ সালে সমীক্ষা চালিয়ে যে ডেটা প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, এই সময়সীমার মধ্যে প্রাথমিকে স্কুলছুটের হার ০.৮ শতাংশ, ক্লাস ৯ থেকে টেনে মধ্যশিক্ষা পর্যায়ে স্কুলছুটের হার ১৪.৬ শতাংশ।

আরও পড়ুন: ঋণে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গ, কোন ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে বাংলার মানুষকে?

স্কুলছুটের প্রধান কারণ
দারিদ্র, স্কুলের দূরত্ব, অভিভাকদের আচরণ- সাধারণত বিশ্বব্যাপী স্কুলছুটের প্রধান কারণ। ভারতের পরিস্থিতি কিন্তু ভয়ানক। অন্তত তেমনই নির্দেশ করছে এনএফএইচএস। তারা উল্লেখ করছে, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ না থাকার জন্য বাচ্চারা স্কুল যেতে চাইছে না। তারা স্কুল গেলে অনেক সুযোগসুবিধা পাবে জেনেও বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না।

এরপরের কারণ খরচ। ১৬ শতাংশ ছেলে এবং ২০ শতাংশ মেয়ে পড়ার খরচের জন্য স্কুলমুখী হচ্ছে না। এখনও আমাদের দেশে বাচ্চারা দু'বেলা আহার পায় না। তাদের স্কুলে যেতে উৎসাহী করার জন্যই তো মিডডে মিল প্রকল্পের ভাবনা। সম্প্রতি এই প্রকল্প নিয়ে সরকার গড়িমসি দেখাচ্ছে। এখানে-ওখানে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। যাদের পেটে খাবার জোটে না, তারা স্বাভাবিকভাবে মনে করে, পড়াশোনা নেহাতই বিলাসিতা।

পরবর্তী কারণ হল, গৃহকর্মে বাচ্চাদের লাগানো হয়। এই কারণে ১৩ শতাংশ মেয়ে এবং ১০ শতাংশ ছেলে স্কুল বিমুখ হয়। এছাড়া শিশুশ্রমে বাচ্চাদের নিয়োগ। সমাজ-সচেতনরা চেঁচিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না। বদলাচ্ছে না পরিস্থিতি।

স্কুলেছুটের আর একটা বড় কারণ অভিভাকদের আচরণ। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা এখনও তাঁরা বুঝতে পারেন না।

নাবালিকা বিয়ে মেয়েদের স্কুলছুটের বড় কারণ। এনএফএইচএস-৫-এর সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর ৭ শতাংশ মেয়ে এই কারণে মাঝপথে পড়া বন্ধ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়। এটা একটা সামাজিক ব্যাধি।

এই সমীক্ষা বলছে রোজগারের জন্য বাচ্চাদের পড়াশোনায় অকালে ছেদ পড়ে। গ্রামে কৃষিক্ষেত বা খামারে কাজ করার ফলে স্কুলছুটের ঘটনা ঘটে। সমীক্ষা বলছে, এর ফলে ৪.৪ শতাংশ ছেলে এবং ২.৩ শতাংশ মেয়ে পড়া বন্ধ করে মাঝপথে রোজগারে নামে।

স্কুল থেকে বাড়ির দূরত্ব স্কুলছুটের বড় কারণ নয়। খুব কমসংখ্যকই এর জন্য স্কুল ছাড়ে। শতাংশের হিসেবে ছেলেরা ২ এবং মেয়েরা ৬।

মহিলা শিক্ষক এবং নিরাপত্তার কারণে অনেক সময় মেয়েরা স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়। খুব বেশি না হলেও এই কারণটা অবহেলা করার নয়। এবার অন্তত স্কুলগুলোতে মহিলা শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন অনুভব করুক সরকার। সঙ্গে মেয়েদের নিরাপত্তা বাড়ানো হোক।

এক শতাংশর কম ছাত্রছাত্রী জানিয়েছে, ভাইবোনদের দেখার জন্য কিংবা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য তারা স্কুল ছেড়েছে।

কেন এই অনাগ্রহ
পড়ার প্রতি অনাগ্রহের একাধিক কারণ রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্স এবং ফ্যামিলি অ্যান্ড জেনারেশন বিভাগের প্রধান ডক্টর টিভি শেখরের মতে, সাধারণত দুই একটা ক্লাসের পরেই বাচ্চারা শিক্ষার প্রতি বিমুখ হয়। আমাদের দেশে অনেক পরিবার থেকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বাচ্চারা পড়তে আসে। তাই পড়াটা তাদের কাছে হয়ে দাঁড়ায় বিলাসিতা। এদের পক্ষে শিক্ষার মূল্য বোঝা কঠিন। এর প্রভাব পড়ে শিক্ষার প্রতি আগ্রহে। তাঁর মতে, সরকারের পদক্ষেপ বিভিন্ন সময় স্কুলছুটের পরিমাণ কমিয়েছে। তবে শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ- এটা অনেক গভীর রোগ। সারানো কঠিন।

তিনি আরও বলেন, আস্তে আস্তে স্কুলছুটের মাত্রা কমছে। কারণ সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন, বিনামূল্যে শিক্ষা, স্টেশনারি, পোশাক, স্কলারশিপ দেওয়ার ব্যবস্থা। শিক্ষার প্রতি অনীহাকে গুরুত্ব-সহকারে সরকারকে দেখতে হবে। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ টিপস হল অভিভাবকদের কাউন্সিলিং। তাঁদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝানো। এতে পরিস্থিতি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরবে বলে তাঁর বিশ্বাস।

২০১৯ সালে প্রকাশিত এক স্টিডির রিপোর্টেও এই ভয়াবহতাকে নির্দেশ করা হয়। জার্নাল অফ অ্যাপলায়েড লিঙ্গুইস্টিকস অ্যান্ড ল্যাঙ্গোয়েজ রিসার্চ স্কুলছুটের কারণ হিসেবে পড়ার প্রতি অনাগ্রহকেই দায়ী করেছে।

বিভিন্ন সংস্থার স্টাডি, সমীক্ষা, গবেষণার রিপোর্ট শিক্ষার প্রতি অনীহাকে স্কুলছুটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করছে। শুধুই কি কারণ নির্দেশে হবে? সরকার এই রোগের ওষুধ খোঁজার চেষ্টা করবে না?

More Articles