মোদি মূর্তি ছোঁবেন, তাই শঙ্করাচার্যরাই যাবেন না রাম মন্দিরের অনুষ্ঠানে! কেন?
Ram Mandir Shankaracharyas : শঙ্করাচার্যরা জানিয়েছেন তারা রাম মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাবেন না কারণ মন্দিরে গর্ভগৃহে নরেন্দ্র মোদির উপস্থিত থাকবেন।
অযোধ্যায় রাম মন্দিরে রাম লালার 'প্রাণ প্রতিষ্ঠা' যে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মাস্টারস্ট্রোক, তাতে সন্দেহ নেই। বিজেপির মেগা-ইভেন্টে ১০,০০০ জনেরও বেশি বিশেষ অতিথির উপস্থিত থাকার কথা, বিদেশের বিশিষ্ট ১০০ জন ব্যক্তিরও এই ঘটনা চাক্ষুষ করার কথা। তবে, দেশের এই এত বড় ঘটনাতে ভারতের চারজন শঙ্করাচার্যের মধ্যে অন্তত দু'জন রামমন্দিরের বিষয়ে একেবারেই পাশে নেই নরেন্দ্র মোদির। ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু নেতাদের মধ্যে রয়েছেন শঙ্করাচার্যরা। অথচ তাঁদের সঙ্গেই বিজেপির মতবিরোধ? কেন?
ওড়িশার পুরীর গোবর্ধন পীঠের শঙ্করাচার্য এবং উত্তরাখণ্ডের চামোলির জ্যোতির মঠের শঙ্করাচার্যরা জানিয়েছেন তারা রাম মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাবেন না কারণ মন্দিরে গর্ভগৃহে নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন। কর্ণাটকের শৃঙ্গেরির সারদা পীঠ এবং গুজরাতের দ্বারকার সারদা পীঠের শঙ্করাচার্যরা এখনও পর্যন্ত উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করে কিছু জানাননি।
এই চার শঙ্করাচার্যের মধ্যে দু'জন উপস্থিত না থাকার ঘটনাটি বিজেপিকে সামান্য অস্বস্তিতে তো ফেলেছেই। বিরোধীরাও হাতে অস্ত্র পেয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় কৌশল এটিই ছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংস যেমন দেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়েছিল, এই রাম মন্দিরও রাজনৈতিক-ধর্মীয় ঘটনা হিসেবে ভারতের ইতিহাসে এক বড় ঘটনা। হিন্দুরাষ্ট্রের ধুয়ো ওঠা এই দেশে কেন খোদ শঙ্করাচার্যরা বিজেপিকে এবং নরেন্দ্র মোদিকে বিপাকে ফেলছেন? তার আগে জানতে হবে শঙ্করাচার্যরা আসলে কারা? কেনই বা তারা এত গুরুত্বপূর্ণ?
আরও পড়ুন- রাম মন্দির উদ্বোধন নিয়ে মোদির পাশে নেই বহু হিন্দুত্ববাদীই! কেন?
শঙ্করাচার্য কারা?
হিন্দুধর্মের অদ্বৈত বেদান্তে উল্লিখিত আছে, অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চারটি সম্প্রদায়ের নেতাদের 'শঙ্করাচার্য' উপাধি দেওয়া হয়। উত্তরাখণ্ড, গুজরাত, ওড়িশা এবং কর্ণাটক – এই প্রত্যেক অঞ্চলের চারটি বেদের এক একটিকে রক্ষা করার কথা এবং প্রত্যেকটির উল্লেখ রয়েছে শাস্ত্রের শেষ শব্দ হিসাবে।
শঙ্করাচার্যরা কী বলেছেন?
পুরীর শঙ্করাচার্য, স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতী গত সপ্তাহে বলেছিলেন, "রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা অবশ্যই সসম্মানে পবিত্র বিধি মেনে করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী গর্ভগৃহে থাকবেন এবং রামের মূর্তি স্পর্শ করবেন... এটিকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি এর বিরোধিতাও করব না ওখানে উপস্থিতও থাকব না।” স্বামী সরস্বতী আরও বলেছেন যে, তাঁর মতে, পবিত্রতা 'শাস্ত্রীয় নির্দেশিকা' মেনেই করা উচিত... অন্যথায় দেবতার তেজ কমে যায় এবং দৈত্য সত্তা এখানে প্রবেশ করতে পারে।
নিশ্চলানন্দ সরস্বতী জানিয়েছেন আমন্ত্রণ তিনি অবশ্যই পেয়েছেন তবে তিনি যোগ দেবেন না। নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়ে তিনি বলছেন, "এটা আমার আদর্শ এবং নীতি... নাহলে অযোধ্যায় আমি যেতেই থাকি"।
উত্তরাখণ্ডের মঠের শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দও একইভাবে দৃঢ়সংকল্প যে রাম মন্দিরের উদ্বোধনে তিনি যোগ দেবেন। অভিমুক্তেশ্বরানন্দ বলছেন, রাম মন্দির নির্মাণ কোনওভাবেই সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের 'বিজয়' নয়। বিজেপি যা দাবি করছে তা ঠিক নয়। অভিমুক্তেশ্বরানন্দ বলছেন, "অযোধ্যায় আগেও রামমন্দির ছিল। এই মন্দিরটি ধর্মকে 'উপহার' দেওয়া নয় বা ধর্মের 'জয়' নয়।" অভিমুক্তেশ্বরানন্দ ঘোষণা করেছেন, "যখন দেশে গোহত্যা বন্ধ হবে, আমি তখন উদযাপন করব।"
বাকি দুই শঙ্করাচার্য চুপ কেন?
প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য গুজরাতের দ্বারকায় সারদা পীঠের শঙ্করাচার্য সদানন্দ সরস্বতী এবং শৃঙ্গেরি মঠের ভারতী তীর্থের শঙ্করাচার্য এই বিষয়ে চুপ। যদিও শোনা যাচ্ছে, অন্য দুই শঙ্করাচার্যের পথেই হাঁটবেন তারা, যাবেন না রাম মন্দিরের অনুষ্ঠানে। পাশাপাশি তারা আবার ২২ জানুয়ারির এই প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানটিকে 'সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য সুখবর' বলে মনে করছেন। শৃঙ্গেরি মঠ বলছে, রটনা মিথ্যা। দ্বারকার সারদা পীঠও বিষয়টিকে 'বিভ্রান্তিকর' বলে এড়িয়ে গিয়ে স্রেফ জানিয়েছে, "আমরা চাই প্রাণ প্রতিষ্টার সমস্ত অনুষ্ঠান বেদ ও শাস্ত্র অনুসারেই পরিচালিত হোক।"
শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্রের প্রধান পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস বলেছেন "শাস্ত্র অনুযায়ীই সবকিছু করা হচ্ছে।"
আরও পড়ুন- ৩৯২টি স্তম্ভ, ৪৪টি ফটক থেকে এআই নিরাপত্তা! যে ভাবে সেজে উঠেছে অযোধ্যার রামমন্দির
শঙ্করাচার্যদের নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক কোথায়?
কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গে, সনিয়া গান্ধি এবং অধীর রঞ্জন চৌধুরী রাম মন্দিরের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। শঙ্করাচার্যদের বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছেন তারা। শঙ্করাচার্যদের অনুপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে ধর্ম এবং রাজনীতিকে গুলিয়ে দেওয়া অভিযোগ তুলে বিজেপিকেই 'হিন্দু-বিরোধী' হিসাবে আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। বিরোধী দল এবং অন্তত দুইজন শঙ্করাচার্য মূল দু'টি বিষয়ে কথা বলছেন। এক, মন্দিরটি এখনও অসম্পূর্ণ এবং ধর্মীয় নেতাদের মতে, ২২ জানুয়ারি তারিখটি অশুভ।
রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলত বলছেন, রাম মন্দিরে রাম লালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা এমন একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সমস্ত শঙ্করাচার্যরাও তা বয়কট করছেন। খোদ শঙ্করাচার্যরাই যদি এমন বলেন, তবে বিষয়টি ভাবা দরকার। অন্য দলগুলোও কথা বলেছে; আম আদমি পার্টির নেতা এবং দিল্লির মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ বিজেপিকে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করার চেষ্টা করার অভিযোগ করেছেন। "শঙ্করাচার্যরা বলেছেন অসম্পূর্ণ মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এই অনুষ্ঠান যদি ধর্মীয় না হয়, তাহলে তা রাজনৈতিক।" অন্য বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আম আদমি পার্টির নেতা এবং দিল্লির মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ বিজেপির বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করার অভিযোগ করেছেন।
এখনও পর্যন্ত বিজেপির বরিষ্ঠ নেতারা এই বিষয়ে কোনও কথা বলছেন না। তবে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নারায়ণ রানে শনিবার শঙ্করাচার্যদের রাম মন্দির অনুষ্ঠানের সমালোচনা না করে আশীর্বাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, "এখনও পর্যন্ত কেউ রাম মন্দির তৈরি করতে পারেনি। মোদি, বিজেপি তা করেছে, মন্দির তৈরি হচ্ছে। শঙ্করাচার্যদের আশীর্বাদ করা উচিত না কি সমালোচনা? এর অর্থ হচ্ছে শঙ্করাচার্যরা রাজনৈতিক দৃষ্টিতেই মাধ্যমে মোদি ও বিজেপিকে দেখেন। শঙ্করাচার্যদের উচিত হিন্দু ধর্মে তাদের অবদান ব্যাখ্যা করা।"