খিদে-যন্ত্রণা সয়ে নেবে বাংলাদেশের আমজনতা, শুধু হাসিনাকে গদি ছাড়তে হবে

Bangladesh Quota Protest: প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হাসিনা মরিয়া হয়ে এমনভাবে আসন আঁকড়ে আছেন যাতে তাঁর বৈধভাবে অধিকারই নেই।

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সপ্তাহখানেকের বেশিই পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের বিপুল সংরক্ষণের অন্যায্য নীতির বিরুদ্ধে সারাদেশে ছাত্র এবং যুবরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভেই নেমেছিল কিন্তু হাসিনা সরকার তা দমনে নজিরবিহীন হিংসা চালানোর পর কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ সীমা ছাড়িয়ে যায়। নির্বিচারে হত্যা করা হয় ছাত্রছাত্রীদের। সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়। হাসিনা সরকারের এই দমনপীড়ন, কোটা সংস্কার নিয়ে সারা বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে উঠলে পড়ুয়ারা সুষ্পষ্টভাবে নিজেদের ৯ দফা দাবি পেশ করে বাংলাদেশ সরকারের সামনে। পড়ুয়াদের দাবি কী ছিল? বাংলাদেশের এই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল-

১) প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রদের গণহত্যার দায় স্বীকার করতে হবে এবং প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।

২) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে (আওয়ামী লীগের মহাসচিব) মন্ত্রিসভা এবং দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে।

৩) যেসব স্থানে ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে সেখানে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করতে হবে।

৪) ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদত্যাগ করতে হবে।

৫) ছাত্রদের উপর হামলাকারী পুলিশ ও গুন্ডা এবং যারা হামলায় প্ররোচনা দিয়েছে তাদের গ্রেফতার করতে হবে।

৬) নিহত ও আহতদের পরিবারকে অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৭) বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে (সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠন, যা আদতে সরকারের পেটোয়া বাহিনী] ছাত্র রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং একটি ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৮) সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক হল আবার খুলতে হবে।

৯) সরকারকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে প্রতিবাদকারীদের কোনওরকম আকাডেমিক বা প্রশাসনিক হয়রানি ঘটবে না।

আরও পড়ুন- আবু সাঈদের স্বপ্নের মৃত্যু, একবার, আবার, বারবার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিক্ষোভকারীদের 'রাজাকার'-দের’ সঙ্গে তুলনা করার মতো কাজ করেছেন। সেই শেখ হাসিনা কি ক্ষমা চাইবেন? এই প্রধানমন্ত্রী অন্তত ক্ষমাপ্রার্থী নন। তিনি যাই করুন না কেন, যাই বলুন না কেন, ক্ষমা চাইবেন না। হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আছে। হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েছে। তাঁর গুন্ডা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ২০০ জনের কাছাকাছি ছাত্র ও অন্যান্য বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। অথচ হাসিনা ক্ষমা চাননি। হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধমতের সকলকেই 'রাজাকার' মনে করেছেন। কার ঘাড়ে ক'টা মাথা যে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে বলার মতো 'ধৃষ্টতা' দেখাবে?

মন্ত্রীদের পদত্যাগ বিষয়টিও সহজ না। মন্ত্রীরাই বাহুবল নিয়ন্ত্রণ করেন। যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ তৈরি হয় তখন সবটা সামলানোর কাজটা তাঁরাই করেন। মন্ত্রীরা দলের উচ্চপদস্থ, ক্ষমতাশালী। কোনও মন্ত্রীর উপযুক্ত বদলি খুঁজে পাওয়াও অসুবিধার। যে কোনও মন্ত্রীকে বরখাস্ত করলে দলের মধ্যে ভুল বার্তাও যাবে।

উপাচার্য এবং প্রক্টরদের পদত্যাগ করা সহজ। শূন্যপদ পূরণও তুলনামূলক সহজ। তবে পুলিশদের বরখাস্ত করা ততটা সহজ নয়। আর ক্ষতিপূরণ দেওয়াটা কোনও সমস্যাই নয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটপাট করা, দলের ইশারায় সরকারি তহবিল বিলিয়ে দেওয়া বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়।

ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ এবং এর সঙ্গে যুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করার দাবিটিও কঠিন কারণ এরাই ছাত্র সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কোনও লক্ষণ দেখা দিলে এরাই দলীয় ক্যাডারদের ডাক দেয়। এই ছাত্রলীগ এমন এক গোষ্ঠী যারা দলীয় নির্দেশে হত্যা, অপহরণ বা গুম করতে পারে। যে সরকারের বৈধতা নেই, সেই সরকারের কাছে এরাই দলদাস, অনুগত সৈনিক।

এই মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবার চালু করাও কঠিন। যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি রয়েছে, তাতে আবার অসন্তোষ দেখা দিলে তা মাত্রাতিরিক্ত বিপজ্জনক হবে। মুক্তচিন্তাকে সব অত্যাচারী শাসকই ভয় পায়। আন্দোলনকারীদের হেনস্থা বন্ধ করা কাগজে-কলমে সম্ভব হলেও বাস্তবে কঠিন। সমাজে, জীবনে, বিভিন্ন স্তরেই অনন্তকাল বিক্ষোভে শামিল হওয়া ছাত্রছাত্রীদের হেনস্থা করা যেতে পারে।

এই সমস্ত দাবির মধ্যে, একমাত্র ক্ষমা চাওয়াই সবচেয়ে কঠিন, তবে সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। অত্যাচারী শাসক হাসিনা, যিনি কখনও কোনও কিছুর জন্য ক্ষমা চাননি, তাঁর সত্ত্বায় আঘাত আসবে ক্ষমা চাইলে, গভীর ক্ষত হবে। যে ক্ষত শুকনো কঠিন।

মনে রাখতে হবে, হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান রক্ষী বাহিনী গঠন করেছিলেন। এই সেই আধাসামরিক বাহিনী যা বাংলাদেশ জুড়ে সন্ত্রাস চালিয়েছিল। মুজিবুরই একদলীয় ব্যবস্থা চালু করেছিলেন যেখানে অন্য সব দল এবং চারটি অনুমোদিত কাগজ ছাড়া সমস্ত সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর নিজের শাসনামলে মুজিবুরেরই পৃষ্ঠপোষকতায় অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম এবং দুর্নীতির কাহিনি ভুলে যাব না আমরা। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৭১ সালের গণহত্যার সময় হাসিনার বাবা এবং আওয়ামী লীগই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর কন্যা হাসিনার কাছে প্রতিবাদী ছাত্রদের কাছে ক্ষমা চাওয়াই সবচেয়ে সহজ, আবার সবচেয়ে কঠিনও। বাংলাদেশের এই নব্যবিপ্লবীরা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, বাংলাদেশ এখনও একটি 'গণতান্ত্রিক’ দেশ, বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনও ফুরিয়ে যায়নি।

এখনও পর্যন্ত যা খবর পাওয়া গেছে তা বাস্তবে কত মানুষের প্রাণ গেছে তা নিশ্চিত নয়। ২০০ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। খবর পেয়েছি যে, অনেকের দেহেই একটিই, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যযুক্ত বুলেটের গর্ত রয়েছে। গুলি চোখের দিকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছিল। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে বহির্বিশ্বকে বাংলাদেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলি বলল ১০০ জনেরও বেশি মৃত। আমরা তো জানি, ১০০ জনের কত বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সরকার কখনই সঠিক হিসেব দেয় না।

শহরের হাসপাতালের কর্মীরা জানেন, কত লাশ এসেছে এই ক'দিনে। ক'জন আহত হয়ে এসেছিলেন আর লাশ হয়ে ঢুকে গেছেন মর্গে। তবে সমস্ত মৃতদেহই হাসপাতালের মর্গে যায় না। ঢাকার একটি পুরনো হাসপাতাল বলছে, ২০০ টিরও বেশি মৃতদেহ আনা হয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে যারা মারা যায়, তাঁদের আর সাধারণত ভর্তি করা হয় না। পরিবারের লোকজন লাশ নিয়ে যায় বাড়ি। সেই লাশও গুম করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন- ভাঙছে হাসিনা-মমতার সম্পর্ক! মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে দিল্লিকে কেন নালিশ বাংলাদেশের?

কিছু পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যখন হাতে এল, দেখলাম সেখানে বুলেটের ক্ষত বিষয়টি উল্লেখই করা হয়নি। নিখোঁজদের মধ্যে আমার প্রাক্তন ছাত্র প্রিয়র মৃতদেহ ছিল। আমরা শনাক্ত করি তাঁকে। এক বন্ধু তাঁকে দাফনের জন্য রংপুরে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। বারবার বলে বলে, ক্রমাগত ক্রস চেকিংয়ের ফলে প্রিয়র ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বুলেটের ক্ষত উল্লেখ করা হয়। যদিও হাসপাতালের ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে তাঁর নামে ইচ্ছাকৃত ভুল রেখে দেওয়া হয়েছিল। পরে তা আবার বলে বলে সংশোধন করানো হয়।

বাংলাদেশের আকাশে হেলিকপ্টার উড়ছে খুব নীচ দিয়ে। সার্চলাইট ফেলা হচ্ছে রাস্তায়, বাড়িতে, অলি-গলিতে। মানুষজনকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর খবর পাওয়া গেছে। অনেক উঁচু থেকে ছুঁড়লে টিয়ার গ্যাস এবং স্টান গ্রেনেডের শেলও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। ফাঁকা ফ্লাইওভারে পড়ে থাকা লাশের টেনে নিয়ে গেছে পুলিশ। দ্রুতগতির গাড়িতে চেপে ভিড়ের দিকে গুলিবর্ষণ করতে করতে পেরিয়ে গেছে কারা! তিন বছরের শিশুকে গুলিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে মা।

সাঁজোয়া গাড়ি ঘুরেছে রাস্তায় রাস্তায়। দেখামাত্র গুলি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, তাও আন্দোলনকারীদের রাগ প্রশমিত হয়নি। কার্ফিউ জারি হয়েছে, তা সত্ত্বেও মানুষ বেরিয়েছে রাস্তায়। এই ঘটনা পরম্পরার উল্টোদিকটাও বলা উচিত। সরকারের নেতৃত্বাধীন বর্বরতার হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়ায় পুলিশদের পিটিয়ে মারার খবর এসেছে, বিভিন্ন কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়েছে। এই বাংলাদেশে বেশিরভাগ শ্রমজীবী শ্রেণির বাস। প্রতিদিনের উপার্জনে প্রতিদিনের সংসার চলে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হাসিনা মরিয়া হয়ে এমনভাবে আসন আঁকড়ে আছেন যাতে তাঁর বৈধভাবে অধিকারই নেই। সাধারণ মানুষ লড়ছে, মরছে। হাসিনা অটুট। সাধারণ খেটে খাওয়া যতজন মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তিনি রিকশাচালক হন, বা ফল বিক্রেতা ছাত্রদের পাশেই দাঁড়িয়েছেন তারা। সাময়িক কষ্ট, ক্ষতি, অনিশ্চিত জীবন, খিদে সব মেনে নিতে ইচ্ছুক তারা। তারা শুধু চান, হাসিনা গদি ছাড়ুন।

More Articles