মিথ্যে অপবাদের জেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল এই প্রতিভাবান কবিকে
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। না, প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে রোদ্দুর হওয়া হয়নি তার। ইঁদুর দৌড়ের পৃথিবী তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল একটা অন্ধকুপের দিকে। টমাস চ্যাটার্টনের গল্পটাও অনেকটা সেরকমই। রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে তিনিও একদিন হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে। ক্ষান্ত বর্ষণ, কাকডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুরও তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল টমাসের থেকে। তখন একদম একা তিনি, একাকিত্বের অন্ধকার যেন গ্রাস করেছিল তাঁকে।
সালটা ১৭৫২। সময়টা শীতকাল। গোটা ব্রিস্টল শহর পাড়ি দিয়েছে ঘুমের দেশে।বছরের অন্যান্য সময় যে ব্রিস্টল সামান্য নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুরসত পায় না, সেই ব্রিস্টল যেন সেদিন তার সমস্ত ব্যস্ততা জমা রেখেছে শীতঘুমের জন্য। এমনই এক দিনে টমাসের জন্ম ব্রিস্টল শহরের একপ্রান্তে। জন্মের পরে বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি টমাসের। মা সামান্য সেলাই করে সংসার-সীমান্তে এক অসম লড়াই চালাতেন প্রতিনিয়ত, আর এই দারিদ্রের মাঝেই বেড়ে ওঠা টমাসের। কৈশোরে পা দিচ্ছেন যখন টমাস, তখনও লড়াই শেষ হয়নি টমাসের মায়ের। পরিবর্তন হয়নি নুন আনতে পান্তা ফুরয় অবস্থারও। ফলে, কিশোর টমাস রাস্তায় নেমেছিলেন, কাজের তাগিদে। তখনও ভাগ্যের চাকা ততটা বিরূপ নয় তাঁর, কাজ জুটে গেল একটা। স্থানীয় সেন্ট মেরি চার্চে পেজ বয়ের কাজ। তাতে সংসারের অবস্থা যতটা না ফিরেছিল, তার থেকেও টমাসের লাভ হয়েছিল বিস্তর। ফাদারের সাহচর্যেই অক্ষর পরিচয় তাঁর। যার ফলে সম্পূর্ণ অজানা এক জগতের দরজা এক নিমেষে উন্মুক্ত হয়ে যায় টমাসের কাছে। আর রহস্যময় সেই জগতের রহস্য ভেদ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে টমাসও।
অক্ষর পরিচয় তো হল, এরপরেই নিজের উৎসাহে চার্চের সমস্ত বইপত্র পড়তে থাকল ছোট্ট টমাস। নেপথ্যে ছিলেন চার্চের সেই ফাদার। তবে এই ফাদারের কাছেও অজানা ছিল টমাসের একটি প্রতিভা। সাত বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতেন টমাস। তিনি যে অন্যান্য আর পাঁচজনের মতো হতে চাননি, তাঁর প্রতিভার জোর ছিল বলেই চাননি স্রোতে ভেসে যেতে। দশ বছর বয়সে টমাস অভূতপূর্ব এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। সেই কাঁচা বয়সেই লিখে ফেলল গোটা একখানা গীতিকাব্য। কাঁচা হিরে টমাস, ততদিনে তাঁকে চিনে ফেলেছেন চার্চের সেই ফাদার। এবার শুরু হল টমাসের আর এক জীবনযুদ্ধ। ফাদার বোধহয় অন্ধকারের শেষে আলোর বিন্দুটা দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর পরামর্শেই টমাস তাঁর পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রতিটি প্রকাশকের দরজায় কড়া নাড়তে থাকলেন, আর ক্রমাগত জুটতে থাকল ঘাড়ধাক্কা। কেউ পড়েই দেখেননি সেই পাণ্ডুলিপি।
কিন্তু ওই যে টমাস নতুন সকালের বার্তাবাহক, মেঘ ফুঁড়ে বেরবেন বলে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। তাই এবার বড় বেশি দুঃসাহসিক এক কাজ করে ফেললেন কিশোর টমাস, যা পরবর্তীকালে তাঁকে ঠেলে দেবে আরও একক যাত্রার দিকে। পৃথিবীর কাছে তিনি পরিচিত হবেন এক দুর্ধর্ষ প্রতারকরূপে।
টমাসের ছিল ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা। প্রতিটি প্রকাশকের অপমানের জবাব দিতে তিনি তিনশো বছর পূর্বের ইংরেজি সাহিত্যের ভাব, ছন্দ নকল করে লিখে ফেললেন একখানি দীর্ঘ গীতিকবিতা। না এখানেই থেমে থাকলেন না, প্রাচীন তুলোট কাগজকে জলে ভিজিয়ে রোদে শুকিয়ে আরও প্রাচীন করে তুললেন। তারপর সেই পাণ্ডুলিপি পাঠালেন হোরেস ওয়ালপলের কাছে। ওয়ালপল তখন একজন সাহিত্য-বোদ্ধা। তিনি পর্যন্ত স্তম্ভিত। তৎকালীন একটি পত্রিকায় তিনি লিখলেন, সেন্ট মেরি চার্চ থেকে আবিষ্কৃত এই পাণ্ডুলিপি পঞ্চদশ শতকের এক প্রতিভাধর কবির পাণ্ডুলিপি।
সমগ্র সাহিত্য সমাজ যখন উদ্বেল এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে, তখন কিশোর কবি টমাস দেখালেন তাঁর তুরুপের তাস। আবার চিঠি গেল সেই ওয়ালপলের কাছে। যে ওয়ালপল বলেছিলেন, এই পাণ্ডুলিপির কবি জিওফ্রি ও শেক্সপিয়রের মধ্যবর্তী সময়ের। টমাস এবার দাবি করলেন, আদতে এই পাণ্ডুলিপি তাঁর। এমনকী, কীভাবে তিনি তা লিখেছেন, তাও বিস্তারিতভাবে জানালেন সমালোচকদের। কিন্তু না, যে সমালোচকরা এতদিন এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে নানা গালভরা কথা বলেছিলেন, তারা যদি আজ মেনে নেন, এই অমর পাণ্ডুলিপির সৃষ্টিকর্তা এক কিশোর, যে কিনা চার্চে মালীর কাজ করে– তাহলে তো তাঁদের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। ফলে টমাসের কপালে আবার জুটল ধিক্কার আর অপমান। টমাসকে দাগিয়ে দেওয়া হলো শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবঞ্চকরূপে।সমালোচকরা দাবি করলেন টমাসের দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যে। এই পাণ্ডুলিপির লেখক নিঃসন্দেহে পঞ্চদশ শতাব্দীর কোনও এক কবি।
টমাসের বয়স তখন ১৮। স্বপ্ন পূরণ আর হল না তাঁর। একাকিত্ব, মিথ্যে অভিযোগ, অপমান, অপবাদ আর স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা অনেক আগেই তাঁকে শেষ করে ফেলেছিল। এবার চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলেন টমাস নামের সেই অসীম প্রতিভাময় কবি। আত্মহত্যা করলেন তিনি। সুইসাইড নোটে সে লিখে গিয়েছিল একটি লাইন– “আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী ইংরেজি সাহিত্যের বর্তমান যুগের তথাকথিত মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতেরা!”
কিন্তু সময় থেমে থাকেনি। ১৮৭১ সালে স্ফিট নামের এক পণ্ডিত গবেষণা করে জানালেন, এই পাণ্ডুলিপি পঞ্চদশ শতকের কোনও কবির নয়, এর লেখক সেই টমাস।যে আত্মহত্যা করেছিল একরাশ বঞ্চনা মাথায় নিয়ে।
টমাস তো শুধু একজন লেখক বা কবি নয়, সে যেন জগতের প্রতিটা অপমানিত লাঞ্ছিত কবির প্রতিভূ। শেষ পর্যন্ত রোদ্দুর হওয়া হয়নি তাঁর, কিন্তু সেইসব পণ্ডিত বা প্রকাশকদের মোক্ষম জবাব দিয়েছিল ইতিহাস।
তথ্যসূত্র: ‘প্রবঞ্চক’. নারায়ণ সান্যাল