টুইটারে 'ভোট' চেয়ে নিজেকে বড় বিপদের মুখে ফেললেন এলন মাস্ক?

Elon Musk Twitter: মাত্র দু'মাসেই মোহভঙ্গ হয়েছে এলন মাস্কের। বিপুল পরিমাণ টাকায় কেনা টুইটার কি ফের বিক্রি করতে চলেছেন তিনি?

ধনকুবের এলন মাস্ক। বিশ্বজুড়ে ধনসম্পদের প্রাচুর্য তাঁকে ঘিরেই। একের পর রেকর্ড আর মাত্র ৫১ বছর বয়সেই চূড়ান্ত সাফল্যের কথা প্রচারিত হয় তাঁকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আজ? এলন মাস্ক (Elon Musk) কি বদলেছেন? মুখোশ খুলে আসল চেহারা প্রকাশ করছেন তিনি? গত অক্টোবর মাসের পর থেকে এমন প্রশ্নেই অবাক হয়েছে বিশ্ব। তুখোড় ব্যবসায়ী আর কঠিন বুদ্ধিমত্তার লড়াইয়ের দিশারী হয়েও এই মাস্ককে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। বিলাসবহুল চার চাকার টেসলা (Tesla) নির্মাণ সংস্থার প্রধান ধনকুবেরের সঙ্গেই তিনি হয়ে উঠেছেন, আতঙ্ক আর আশঙ্কার আর এক নাম! টুইটারকে (Twitter) কেন্দ্র করে বিতর্ক বেড়েছে নিরন্তর। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় সোশ্যাল-মাধ্যমের মালিকানা, ধনকুবের এলনের কাছে যেতেই একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটেছে সোশ্যাল-দুনিয়ায়। আলোচনায় এসেছেন টুইটারের বর্তমানের প্রধান কর্তা।

কিন্তু তিনি কি ফের বদলেছেন? আচমকাই 'মাস্ক' ছেড়ে পুরনো এলনে ফিরছেন টুইটার-কর্তা! হঠাৎ মারকাটারি মনোভাব ছেড়ে মাত্র ১ সপ্তাহের তর্জন-গর্জন সরিয়ে রেখে ফের বদলে গিয়েছেন এই ধনকুবের? রবিবারের বিশ্বকাপ ফাইনালের উত্তাপ ছড়িয়ে সোমবার সকাল হতেই এই জল্পনায় ফের উত্তাল হয়েছে সোশ্যাল-দুনিয়া। কেন?

এলন মাস্ক তাঁর জীবন-বিতর্কের হাতিয়ার টুইটারকে ব্যবহার করেই ভোট চেয়েছেন হঠাৎ। নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে মতামত জানার জন্য 'পোল' তৈরি করেছেন এলন। তাতে তিনি জানতে চেয়েছেন, টুইটারের কর্তা হিসেবে তাঁর আর থাকা উচিৎ কিনা! মাস্ক লিখেছেন, "আমার কি টুইটার প্রধানের পদ থেকে সরে যাওয়া উচিৎ? এই নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে চাই।" এই মতামত চাওয়ার ওই পোস্টে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষই বলেছেন, "হ্যাঁ সরে যাওয়া উচিৎ মাস্কের"। আবার ৪৩ শতাংশ জনতা বলছেন, "টুইটার প্রধান হিসেবে থাকুন এলন মাস্কই"।

এখানেই উঠেছে প্রশ্ন। মাত্র কয়েকদিন আগেও একাধিপত্য বিস্তারের মোক্ষম অস্ত্র নিক্ষেপের কারিগর এলন মাস্ক কেন উল্টোপথে হাঁটতে চাইছেন! অনেকেই বলছেন, টুইটারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর সিদ্ধান্তে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে এই ধনকুবেকে। তাঁর মালিকানাধীন টুইটারেও ট্রেন্ড করেছে তাঁরই বিরুদ্ধাচরণ। এই সমস্ত দিক বিচার করে খুব শীঘ্রই টুইটারের দায়িত্ব ছাড়তে পারেন মাস্ক, কিন্তু মালিকানা রাখতে পারেন আগামী দিনেও, বলছেন কেউ কেউ। আবার সংশ্লিষ্টদের অন্য এক অংশের দাবি, নয়া কৌশল গ্রহণের পথে হাঁটছেন মাস্ক। নিজের সম্পর্কে বদনামের মায়াজালে বন্দি হয়েই তিনিই জল মাপছেন, আদতে তাঁর বিরুদ্ধে কী কী রয়েছে, এমনও বলছেন অনেকেই। যদিও টুইটার প্রধান হিসেবে কার্যত জোর করে বসার পরেও পদ ছাড়তে গিয়ে কেন প্রকাশ্যে মানুষের মত চাইছেন এলন? এই প্রশ্নে শোরগোল পড়েছে রাজনৈতিক মহলেও। আর এখানেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে নয়া জল্পনা।

আরও পড়ুন- টুইটারের সাজানো বাগান কীভাবে তছনছ করলেন এলন মাস্ক

কেউ কেউ বলছেন, মাত্র দু'মাসেই মোহভঙ্গ হয়েছে এলন মাস্কের। বিপুল পরিমাণ টাকায় কেনা টুইটার কি ফের বিক্রি করতে চলেছেন তিনি? এখানেও তৈরি হয়েছে এমন সম্ভাবনা। একাধিক ফতোয়া আর সিদ্ধান্তের সমালোচনায় বারবার ফ্যাসাদে পড়েছেন এলন। একাধিক দেশের তরফেও তাঁর প্রশংসার পরিবর্তে নিন্দা করা হয়েছে বারবার। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশের শীর্ষনেতাদের কাছে বিরাগভাজন হয়েছেন টেসলার প্রধান। এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে টুইটার এই মুহূর্তে বিক্রি না করলেও সংস্থার প্রধান হিসেবে, তাঁর এগোনোর সম্ভাবনাই বেশি। যা টুইটারের আগামীর গতিপথের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেই মত অনেকের।

প্রসঙ্গত, ইরান থেকে তালিবানের আফগানিস্তান- একের পর এক ফতোয়া-বিড়ম্বনার মধ্যেই নবতম সংযোজন ঘটান এলন মাস্ক। বরাবর মৌলিক স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করলেও গত অক্টোবরের ২৭ তারিখের পর থেকে যেন আমূল পরিবর্তন ঘটে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির মালিক এলন মাস্কের। টুইটারের ১০০ শতাংশ শেয়ার নিজের দিকে নিতেই প্রথম কোপ পড়ে টুইটার কর্মীদের উপর। তৎকালীন টুইটার প্রধান ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরাগ আগরওয়ালকে মুহূর্তেই সরিয়ে দেন মাস্ক।

একাধারে মালিক অন্যদিকে সংস্থার প্রশাসনিক প্রধান। জোড়া ফলায় মাস্ককে তখন পায় কে! হলও তাই। হঠাৎ বদলে গেলেন মাস্ক। নভেম্বর মাস পড়তেই প্রায় সমস্ত কর্মীর কাছেই মেইল পাঠাল তাঁর সংস্থা। কর্মীদের কাজ, কোম্পানির প্রতি অবদান থেকে ভুরি-ভুরি প্রশংসার বন্যা ছিল ওই আনুষ্ঠানিক মেইলে। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিকতার অভ্যন্তরেই কি লুকিয়ে ছিল ভয়ঙ্কর বক্তব্যের শিকড়। ছিল মাইনে কমানো থেকে শুরু করে টুইটার নিয়ে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার ইঙ্গিত!

এরপরে যতই নভেম্বর এগিয়েছে, মাস্কের শাসন বেড়েছে দ্রুত গতিতে। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন তিনি! নির্দেশ দিয়েছেন, আর বাড়ি থেকে নয় বিশ্বের সব প্রান্ত থেকেই হাজির হতে হবে নির্দিষ্ট অফিসে। সপ্তাহে কমপক্ষে ৮০ ঘণ্টা কাজের নিদানও দেন তিনি। শোনা যায়, রাতারাতি মেইল পাঠিয়ে একাধিক কর্মীর, উচ্চপদস্থ কর্তার চাকরিও নিয়ে নিচ্ছেন মাস্ক! তাঁর তরফে নির্দেশ আসে, "দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ না করতে পারলে পদত্যাগপত্র তৈরি রাখুন। কোম্পানি তা নিতে প্রস্তুত।"

এখানেই শেষ হয়নি গল্প। এলন মাস্কের ছোঁয়ায় কর্মহীন হন বহু টুইটার কর্মী। বাদ যায়নি ভারতীয়রাও। শোরগোল পড়ে বিশ্বজুড়ে। দেখা হয়, একাধিক কর্মীকে বিনা নোটিশে সরিয়ে দিয়েছে টুইটার কর্তৃপক্ষ। কেউ কেউ নিজে থেকেই পদত্যাগ করেন তখন। খানিকটা ডামাডোল সৃষ্টি হয় এই সংস্থাকে কেন্দ্র করে। তবুও অনড় থাকেন মাস্ক। কয়েকজন আধিকারিকের পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ তাঁর তরফে এলেও তাঁর দয়ায় কর্মহীন হন বহু কর্মী।

জানা যায়, চুক্তিভিত্তিক প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মী এবং মোট স্থায়ী টুইটার কর্মীর ২৫ শতাংশের উপরে অচিরেই নেমে আসে আশঙ্কার কালো মেঘ। এর সঙ্গেই বেঁচে থাকা কর্মীদের একাধিক সুযোগ সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয় মুহূর্তেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রের অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার দিকও আটকে দেন মাস্ক। কারণ হিসেবে বলা হয়, ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে টুইটার। তাই এই সিদ্ধান্ত। যদিও বিতর্ক বাড়ায় টুইটার সংক্রান্ত একাধিক সিদ্ধান্তও। নিয়মনীতিতে পরিবর্তন থেকে শুরু করে তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়, এমনকী 'ব্লু টিক' দেওয়া ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীদের জন্য মাসিক টাকা নেওয়ার বন্দোবস্ত, একের পর এক বিস্ফোরক পদক্ষেপের কথা প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে। বিড়ম্বনা বাড়ে মাস্কের।

আরও পড়ুন- এক নম্বর ধনকুবের এলন মাস্ককে টেনে নামিয়েছেন ইনি, এই ফরাসি ব্যবসায়ীকে চেনেন?

সম্পত্তি বিশ্বের জনপ্রিয় সাত সাংবাদিকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে টুইটার। তা নিয়েও তৈরি হয় বিতর্ক। অবশেষে পিছু হটে কর্তৃপক্ষ। তোলা হয় নিষেধ। কিন্তু তারপরেও অস্বস্তি বজায় থাকে মাস্কের। সেই সমস্যার মধ্যেই পদ ছাড়ার এই নয়া জল্পনা উস্কে দিলেন মাস্ক।

টেসলা-সহ একাধিক সংস্থার মালিকের ঝড়ের গতিতে উত্থান হয় ২০১১ সালের পর থেকে। একাধিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি, সেই সংস্থার মালিকানা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমশ বাড়ে মাস্ক-সম্পত্তি। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে টুইটারে নিজের অ্যাকাউন্ট খোলেন এলন। মুহূর্তেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই নিবাসী। বিশ্বের ১০০ মিলিয়ন মানুষের পছন্দের তালিকায় উঠে আসেন মাস্ক।

২০১৭ সালে টুইটার ব্যবহার করেই টুইটারের মালিক হওয়ার স্বপ্নের কথা বলেন তিনি। সেই শুরু। মাস্কের সঙ্গে টুইটারের যোগাযোগ স্থাপিত হয় তখন থেকেই। ২০১৯, ২০২০, ২০২১ -র করোনা ছাড়িয়ে এই অবস্থান আরও স্পষ্ট হয় ২০২২-এ গিয়ে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসে মাস্ক অল্প অল্প করে কিনতে শুরু করেন টুইটারের শেয়ার। প্রথম থেকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সেই শেয়ারের অবস্থান গিয়ে দাঁড়ায় ৯.২ শতাংশে। যদিও এই বছরের এপ্রিল থেকেই মাস্কের সঙ্গে কথা চলছিল টুইটার কর্তৃপক্ষের। কয়েক বিলিয়নের বিনিময়ে টুইটার কেনার প্রস্তাব আসে মাস্কের তরফে। এরপর টুইটারের প্রত্যেক শেয়ারের মূল্য দেওয়া হয় ৫৪ ডলারের বেশি। এরপর ক্রমে ক্রমে টুইটারের ১০০ শতাংশ শেয়ার নিজের দিকে নেন এলন। অক্টোবর পড়তেই হয়ে যান টুইটারের একা মালিক। অক্টোবর থেকেই নিজের সাফল্যের মুকুটে যোগ করেন নয়া খেতাব। হয়ে যান টুইটারের সর্বেসর্বা। আর এই সময় থেকে শুরু হয় মাস্ক-রাজ। টুইটার প্রধানের আসনে বসতেই বিতাড়িত হন টুইটারের তৎকালীন প্রধান পরাগ আগরওয়াল, অর্থ বিভাগের প্রধান নেড সেগাল। বরখাস্ত করা হয় কোম্পানির নিরাপত্তা বিষয়ক বিভাগের প্রধান বিজয়া গাদ্দেকেও। এখানেই শুরু হয় বিতর্ক।

বরাবর স্বাধীনতার প্রতিভূ হয়েও কেন স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বশবর্তী হচ্ছেন এলন মাস্ক! টুইটার প্রধানের কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন বহু মানুষ। ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে 'কু' এবং অন্যান্য একাধিক কোম্পানি। ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের নতুন চাকরি দেওয়ার পথে এগিয়ে যান তাঁরা। খানিকটা চাপে পড়ে মাস্কের টুইটার। ঠিক এইরকম এক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই মাস্কের এই নয়া 'চাল' জল্পনা বাড়িয়েছে ফের! তাহলে কি সত্যিই...

More Articles