মানুষের জীবনে টাকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ পাখি! কেন এমন বলছেন বিজ্ঞানীরা?
Urban Nature and Mental Health: মেলবোর্নে শহুরে এলাকায় গাছেদের ইমেল ঠিকানা তৈরি করা হয়েছিল। দেখা যায়, বাসিন্দারা তাদের প্রিয় গাছগুলিকে হাজার হাজার প্রেমপত্র লিখেছেন।
সম্প্রতি কানাডার মানুষদের নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ্যে এসেছে। রিপোর্ট কানাডার হলেও, এই বিষয়টি কানাডাতে আবদ্ধ নয় মোটেও। ওই রিপোর্ট বলছে, পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি কানাডিয়ান, অর্থাৎ প্রতি আটজনের মধ্যে প্রায় একজন মেজাজ হারানো, উদ্বেগ বা নেশার কবলে পড়েছেন। মানসিক রোগের প্রকোপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাদের এই ধরনের মানসিক কোনও ব্যাধি রয়েছে তাদের এক তৃতীয়াংশের আবার মানসিক স্বাস্থ্য-যত্ন পরিষেবার অত্যন্ত প্রয়োজন। আর এই ঘটনা বাড়ছে শহরেই, যেখানে ৭০%-এরও বেশি কানাডিয়ানের বাস। সাধারণত এই ধরনের ব্যাধির ক্ষেত্রে, কানাডা হোক বা উগান্ডা, ভারত হোক বা গ্রিনল্যান্ড, মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া বলতে আরও ব্যায়াম করা, আরও ঘুমানো এবং স্বাস্থ্যকর খাওয়া দাওয়ার বিষয়েই কথা বলেন। অথচ গবেষণা দেখা গেছে, গাছপালা এবং বন্যপ্রাণী বেষ্টিত প্রকৃতিতে সময় কাটানো মানসিক অসুস্থতা প্রতিরোধ ও চিকিত্সার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
মানসিক সুস্থতার জন্য শহুরে পাড়ায় পাখি এবং গাছের গুরুত্বের উপর জোর দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কেন গাছ আর পাখি এত গুরুত্বপূর্ণ? কীভাবে তারা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে? আমাদের সংস্কৃতি এবং সমাজ জুড়ে, পাখিদের সঙ্গে মানুষের এক অদ্ভুত দৃঢ় সংযোগ রয়েছে। পাখির ডাক, পাখির উজ্জ্বল রঙ চিরকালই শিল্প, সঙ্গীত ও কবিতার রসদ হয়ে এসেছে। যারা পাখি নিয়ে চর্চা করেন তাঁদের কথা বাদই রইল, পাখির ঝাঁক দেখে, বা হঠাৎ রঙিন কোনও পাখি দেখে, পাখির কলতান শুনে ম্যাজিকের মতো স্তব্ধ হয়ে যান অধিকাংশ মানুষই। শহুরে মানুষদের কাছে কিন্তু পাখিরাই মূলত বন্যপ্রাণীর সঙ্গে দৈনন্দিন সংযোগ রাখার একমাত্র উপায়। প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার অন্যতম প্রবেশদ্বার। আসলে, আমরা বুঝতে না পারলেও, মানুষ এবং পাখি একে অপরের সঙ্গে জড়িত। পাখিরা আমাদের এমন অনেক প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেয় যা আমরা চট করে বুঝতেও পারি না। পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা, বীজ ছড়িয়ে দেওয়া এবং ফসলের পরাগা এক জায়গা থেকে অন্যত্র ছড়িয়ে দেওয়া পাখি ছাড়া সম্ভবই না।
আরও পড়ুন- ছাদ থেকে রোগীর মরণঝাঁপ, কী অবস্থা রাজ্যের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির? আসল তথ্য জানুন
গাছের সঙ্গেও মানুষেরও একইরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ট্রি অফ লাইফ, ফ্যামিলি ট্রি, এমনকী গাছকে জড়িয়ে ধরার রীতি বিশ্বের অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যেই আছে। যা গাছের সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতির এক সেতু গড়ে দেয়। শহরগুলিতে গাছ মূলত সৌন্দর্য এবং প্রশান্তি আনার প্রচেষ্টার এক প্রধান উপাদান।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে শহুরে এলাকায় গাছেদের ইমেল ঠিকানা তৈরি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, মানুষ নিজেদের সমস্যার কথা গাছেদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। দেখা যায়, বাসিন্দারা তাদের প্রিয় গাছগুলিকে হাজার হাজার প্রেমপত্র লিখেছেন। বনের মধ্যে স্নান, গাছের মধ্যে শান্তিতeে চুপ করে বসে থাকার অভ্যাস সুস্থ থাকার দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়।
প্রাকৃতিক জায়গা মানসিক চাপ কমায়। শহুরে বাসিন্দাদের জন্য বিনোদন এবং বিশ্রামের জায়গা হয়ে ওঠে পার্ক। পার্ক মানে তার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যই এখানে মুখ্য। মানুষের মানসিক অস্থিরতা কমানো যে যত গবেষণা হয়েছে, সবক'টিই বলেছে প্রকৃতিই সমাধান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক। যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বৈচিত্র্য আছে, সেখানে মেজাজ এবং উদ্বেগজনিত ব্যাধির কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রবণতাও কম। সেখানে মানুষের আয়ু স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ। ইউরোপের একটি গবেষণায়, গবেষকরা দেখেছেন যে, আয়ের মতোই জীবনের সন্তুষ্টির জন্য পাখির বৈচিত্র্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন- হু হু করে বাড়ছে মানসিক রোগ, নতুন মহামারীর সামনে ভারত?
পাখি এবং গাছের একটি বৃহত্তর বৈচিত্র্যের সঙ্গে আরও একটি বিষয় জড়িয়ে আছে। পাখি সেখানেই বেশি থাকে যেখানে তারা নিরাপদ পরিবেশ পায়, আরও বেশি খাবার এবং আরও বেশি আশ্রয় পায়৷ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ মানুষের মস্তিষ্কের পক্ষে উপকারী। শহুরে কানাডায় জীববৈচিত্র্য এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে গবেষনা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা পাখির তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। বনদফতরের থেকেও গাছের বৈচিত্র্যের তথ্য সংগ্রহ করেন তারা। দুই তথ্যের তুলনা করে অবশেষে, সেই তথ্যকে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করে দেখেন তারা। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতি বছর প্রায় ৬৫,০০০ কানাডিয়ানদের স্বাস্থ্য বিষয়েটি খতিয়ে দেখেছেন গবেষকরা।
গবেষকরা দেখেছেন, পাখি বেশি রয়েছে এমন পরিবেশে বসবাস করা মানসিক সুস্বাস্থ্যের হার প্রায় ৭% বেশি। গাছের পরিমাণ সাধারণের থেকে বেশি এমন এলাকায় বসবাস করার ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের মান প্রায় ৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ শহুরে পাখি এবং গাছের বৈচিত্র্য, স্বাস্থ্যকর বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের মানসিক সুস্থতার মধ্যে সংযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার অংশ হিসাবে শহুরে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ তাই কাম্য। পার্কে বন্য এলাকা রক্ষা করা, কীটনাশকের ব্যবহার কমানো সবই শহুরে বন্যপ্রাণী রক্ষা এবং মানুষের মঙ্গল প্রচারের মূল কৌশল হতে পারে। এই বিষয়টিই নগর পরিকল্পনাবিদদের খেয়াল রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে দ্রুত হারে হারিয়ে যাচ্ছে গাছ ও বন্য নানা প্রজাতিই। ১৯৭০-এর দশকের তুলনায় উত্তর আমেরিকায় তিন বিলিয়ন কম পাখি রয়েছে এখন। আক্রমণাত্মক কীটপতঙ্গ আগামী ৩০ বছরে ১.৪ মিলিয়ন রাস্তার ধারের গাছকে শেষ করে ফেলবে বলেও আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।