নিজেরই মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ধর্না-অনশনে বসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এই মুখ্যমন্ত্রী! কেন?
CM Ajoy Mukherjee: অজয় মুখোপাধ্যায়ের রাগের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বামদলগুলি। সমস্ত গণ্ডগোল করছে সিপিএম এবং নকশাল, কিন্তু তার দায় গিয়ে পড়ছে মুখ্যমন্ত্রীর উপর!
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যই একাধিক সময় রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর সংঘাত প্রত্যক্ষ করেছে। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের দ্বৈরথ। বর্তমানে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এবং রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক সকলেই জানে। কয়েক বছর আগে নাগরিকরা দেখেছিলেন দিল্লির প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর অনিল বৈজলের বাড়িতে ধর্না দিয়েছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আজকাল মহারাষ্ট্রের বিজেপি সমর্থিত সরকারের অনেকেও সেখানকার রাজ্যপাল ভগৎ সিং কোশিয়ারির পদত্যাগ চাইছেন। তবে এই ঘটনা মোটেই নতুন নয়, অতীতেও এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। তবে এসবের শুরুটা কোথায় হয়েছিল? রাজ্যপালের বাড়িতে ধর্না দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে। সেবারও ‘সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে’ সরকার ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদে রাজ্যপালের বাড়িতে ধর্না দেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এর বছর দুয়েক পর, সেই মুখ্যমন্ত্রী আবার ধর্না দেন। তবে এবার রাজ্যপাল নয়, নিজের ক্যাবিনেটের বিরুদ্ধে। কথা হচ্ছে বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে। তিনি খুব সম্ভবত ভারতের একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী, যিনি নিজের ক্যাবিনেটের বিরুদ্ধে প্রথমে ধর্না এবং তারপর অনশনে বসেছেন।
অজয় মুখোপাধ্যায় নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে। কিন্তু ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ কংগ্রেস পার্টি দুই ভাগ হয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধী নিজের অনুগামীদের নিয়ে তৈরি করেন কংগ্রেস (ইন্দিরা) বা, INCA। অপরপক্ষে কংগ্রেসের ওল্ড গার্ডস, অর্থাৎ কামরাজ এবং নিজলিঙ্গাপার নেতৃত্বে তৈরি হয় কংগ্রেস অর্গানাইজেশন বা কংগ্রেস (ও)। তবে বাংলায় যে কংগ্রেসের অংশ ছিল, তারা INCA বা কংগ্রেস (ও) কোনওটাতেই যায়নি। বদলে ১৯৬৬ সালে অজয় মুখোপাধ্যায় এবং সুশীল ধারার নেতৃত্বে বাংলায় তৈরি হয় বাংলা কংগ্রেস। এই বাংলা কংগ্রেসের হাত ধরেই নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৭ সালে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি কংগ্রেস। এই সময় বাংলার রাজনীতি নিজের টার্নিং পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিল। মনে করা হয়, এই সময় বাংলায় শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক হিংসার প্রচলন, যা আজও বর্তমান। যাইহোক, কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায়, রাজ্যের অন্যান্য পার্টিগুলি মিলে ঠিক করে একটি যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ে তোলার। আসল উদ্দেশ্য, কোনওভাবেই কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। ফলত, বাংলা কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিএম, প্রজা সোশালিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি-সহ অন্যান্য দলগুলি এবং ৩১ জন নির্দল বিধায়ক নিয়ে তৈরি হয় বাংলার প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। ১ মার্চ ১৯৬৭, বাংলার প্রথম অকংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন অজয় মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন- বাদ পড়ল জাতীয় সঙ্গীতও, যেভাবে ‘একদিনের মুখ্যমন্ত্রী’ হয়েছিলেন জগদম্বিকা পাল
কিন্তু অন্যান্য জোট সরকারের যা অবস্থা, যুক্তফ্রন্টের অবস্থাও তাই হল। যুক্তফ্রন্ট আদতে ছিল, ক্ষমতা দখলের জন্য নির্মিত আলাদা আলাদা ভাবধারায় বিশ্বাসী দলের সমন্বয়। স্বাভাবিকভাবেই দলগুলির মধ্যে সংঘাত লাগত। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে অজয় মুখোপাধ্যায় বুঝতে পারলেন তিনি স্বাস্থ্য এবং কৃষিক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি নীতি লাগু করতে পারছেন না দলীয় অন্তর্বিরোধের কারণে। অপরপক্ষে বামদলগুলি নিজেদের কাছে ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকগুলি রেখেছিল। যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বেশি আসন ছিল বামফ্রন্টের কাছেই। সংঘাত এতটাই বেড়ে যায় যে, অজয় মুখোপাধ্যায় ঠিক করেন যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়বেন। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেল এক ঘটনা। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, রাজ্যপাল ধর্মবীরের কাছে গিয়ে দাবি করলেন যে অজয় মুখোপাধ্যায় সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তিনি এও জানান তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের এবং ১৭ জন নির্দলীয় বিধায়কদের সমর্থন আছে। সুতরাং অজয় মুখোপাধ্যায়ের সরকারকে যেন বরখাস্ত করে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করে দেওয়া হয়। কংগ্রেসও রাজ্যপালের কাছে গিয়ে জানায়, তাদের সমর্থন রয়েছে প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষের দিকে।
রাজ্যপাল অজয় মুখোপাধ্যায়কে নির্দেশ দিলেন বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে সদনে নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে। অজয় মুখোপাধ্যায় বিধানসভা অধিবেশন না ডাকায় তাঁর সরকারকে বরখাস্ত করে দেন রাজ্যপাল। ফলত সদলবলে গিয়ে রাজভবনের বাইরে ধর্নায় বসেন অজয় মুখোপাধ্যায়। রাজ্যের জায়গায় জায়গায় শুরু হয় হিংসাত্মক বিক্ষোভ প্রদর্শন। বাংলা কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের নেতারা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। ইতিমধ্যেই দ্বিতীয়বারের জন্য বাংলার মসনদে বসেছেন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ। জানিয়ে রাখি, বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রীও (১৯৪৭-৪৮) ছিলেন তিনি। এইরকম ডামাডোল পরিস্থিতির মধ্যে, ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় বিধানসভার বাজেট অধিবেশন। সেই অধিবেশনে রাজ্যপালকে বিধানসভায় ঢুকতে দেননি যুক্তফ্রন্টের নেতারা। পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকলেও রাজ্যপাল দেখেন, বিধানসভায় তাঁর আসনের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন যুক্তফ্রন্টের বিধায়করা। স্পিকার বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, এই অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে বিধানসভার অধিবেশন চলতে পারে না। ফলত অনির্দিষ্টকালের জন্য বিধানসভা স্থগিত করে দেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গে এমন রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে রাজ্যপাল একটি রিপোর্ট দিলেন কেন্দ্রকে। তার ভিত্তিতে বিধানসভা ভঙ্গ করে, পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে দিল কেন্দ্রীয় সরকার।
আরও পড়ুন- বারবার সুযোগ পেয়েও ‘ঐতিহাসিক ভুল’, জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে অন্যভাবে লেখা হত ভারতের ইতিহাস
রাষ্ট্রপতি শাসন উঠে যাওয়ার পর ১৯৬৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বিধানসভা নির্বাচন হল পশ্চিমবঙ্গে। সবচেয়ে বেশি আসন পেল সিপিএম (৮০)। কিন্তু কোনও দলই স্পষ্ট বহুমত না পাওয়ায় ফের তৈরি হলো জোট সরকার। সিপিএম সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়ায় বামদলগুলি চেয়েছিল জ্যোতি বসুকে মুখ্যমন্ত্রী করতে। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের অন্যান্য নেতারা রাজি না হওয়ায় অজয় মুখোপাধ্যায়কেই ফের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। জ্যোতি বসু হলেন উপমুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল হওয়ায় সিপিএম নিজেদের কাছে রেখে দেয় সবচেয়ে শক্তিশালী মন্ত্রক অর্থাৎ গৃহমন্ত্রক। এছাড়াও শ্রমমন্ত্রক তাদের হাতে ছিল। এর আগে বিভিন্ন কারখানায় কর্মীরা বিক্ষোভ দেখালে তাঁদের পুলিশ ডেকে কাজে ফেরত পাঠানো হতো। কিন্তু যখন সিপিএমের হাতে গৃহ এবং শ্রমমন্ত্রক এল, খুব স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকদের পক্ষে যাবে সিদ্ধান্ত। ফলত শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখিয়ে কারখানায় কাজ বন্ধ করলে, তাঁদের আর পুলিশকে ভয় পাওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। ফলত সেই সময় রাজ্যে কারখানাগুলিতে কাজ কম, বিক্ষোভ বেশি হতে লাগল। জানা যায়, নতুন সরকার তৈরি হওয়ার প্রথম ছয় মাসে বারোশোর বেশি বিক্ষোভ এবং ঘেরাও হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারখানাগুলিতে। ফলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্পপতিরা ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন। এর মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভব হয় নকশালদের। নকশালদের নিশানায় শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত জমিদাররাই নন, ছিলেন সিপিএমের ক্যাডাররাও। ফলত নকশাল এবং সিপিএমের মধ্যে সংঘর্ষ চরমে উঠল। রাজ্যের আইন ব্যবস্থা ক্রমে ভেঙে পড়তে লাগল এবং এইসবের মাঝে পড়ে পিষতে থাকলেন অজয় মুখোপাধ্যায়।
অজয় মুখোপাধ্যায়ের রাগের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বামদলগুলি। সমস্ত গণ্ডগোল করছে সিপিএম এবং নকশাল, কিন্তু তার দায় গিয়ে পড়ছে মুখ্যমন্ত্রীর উপর! যেহেতু জোট সরকার, তাই সরকার বাঁচাতে হলে বিনা দোষেও দোষী হতে হবে। তবে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেই গেল। নিজের দলের বিরুদ্ধেই, নিজের ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেই রাজ্যের জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভ সভা শুরু করলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। এরপর ১ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে এমন এক কাণ্ড ঘটল যা ভারতবর্ষে এর আগে কখনও হয়নি। সেদিন সকালবেলা দক্ষিণ কলকাতার কার্জন পার্কে নিজেরই সরকারের বিরুদ্ধে ধর্নায় বসে গেলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। প্রথমে ধর্না এবং বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনশন। এই অনশন ৭২ ঘণ্টা চলে এবং কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গে আবার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে দেয়। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার নির্বাচন হয় পশ্চিমবঙ্গে। এবার আরও শক্তিশালী দল হিসেবে উঠে আসে সিপিএম (১১৩)। কিন্তু পূর্ণ বহুমত না থাকায় সরকার গড়তে পারে না বামফ্রন্ট। তবে এবার ফের অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস (ও) এবং বাংলা কংগ্রেস মিলে সরকার তৈরি করে। সেবার তাদের বাইরে থেকে সমর্থন দেয় বামেরা। সেই সরকার মাস চারেক চলার পর, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মধ্যস্থতায় বাংলা কংগ্রেসের বিলয় হয়ে যায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের সঙ্গে। ফলত বাংলায় বিধানসভা ভঙ্গ করে দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের জুন মাসে, তৃতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন।
১৯৭২ সালে আবার নির্বাচন হয়। এবার নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় কংগ্রেস। সেবারও ইন্দিরা গান্ধী অজয় মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রিত্ব সামলাতে। কিন্তু খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে তিনি রাজি হন না। ফলত সিদ্ধার্থ শংকর রায়কে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। ১৯৭২-৭৭ কংগ্রেসের সরকার চলে পশ্চিমবঙ্গে। এরপর ২০১১ পর্যন্ত বামেদের ৩৪ বছরের শাসন এবং ২০১১ থেকে বর্তমানে তৃণমূলের শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু এই সুদীর্ঘ ৫ দশকে, বোধহয় আর কখনও দেখা যায়নি যে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তাঁর ক্যাবিনেটের বিরুদ্ধে ধর্নায় বসছেন।