দেশের মহিলারা বাদ! কেমন ছিল ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচন?
First Election of India 1952: স্বাধীনতার পর এই পুরো নির্বাচন শক্ত হাতে সামলে ছিলেন একজন বাঙালি, সুকুমার সেন।
"নয়া হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ", ঔপনিবেশিকতার শিকল থেকে বেরিয়ে স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে এটাই ছিল পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নির্বাচনী স্লোগান। উপনিবেশের নিয়ম থেকে বেরিয়ে সবেমাত্র নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে ভারতের। ১ কোটি ৭৫ লক্ষ ভোটার নিয়ে সেই সময় ভারত ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম গণতন্ত্র। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের ভোটাধিকারের ব্যাপারে কোনও ধারণাই নেই তখনও। ফলে, নির্বাচন কমিশনের জন্যও প্রথম নির্বাচন ছিল বেশ শক্ত। নানা প্রান্তে মুখোমুখি হতে হচ্ছিল নানা সমস্যার। তবে, স্বাধীনতার পর এই পুরো নির্বাচন শক্ত হাতে সামলে ছিলেন একজন বাঙালি, সুকুমার সেন। বজ্র কঠিন হাতে ভারতের প্রথম নির্বাচন পরিচালনা দেখে রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল গোটা দুনিয়াও। ততদিন পর্যন্ত মাত্র দু'বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে, তাও আবার ইংরেজ আমলেই। ১৯৩৭ এবং ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ভারতীয়দের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করতে দিয়েছিল ইংরেজরা। মাত্র ১৪ শতাংশ ভারতীয়ই নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন সেই নির্বাচনে। সেই নির্বাচনের পর সরাসরি স্বাধীন ভারতের লোকসভা নির্বাচন! ফলে বিষয়টা সকলের কাছেই ছিল কৌতূহলের।
সুকুমার সেনের কঠিন চ্যালেঞ্জ
স্বাধীনতার পরপর দেশে তখন একাধিক সমস্যা। ১ লক্ষ ২০ হাজার উদ্বাস্তুদের চাপ, নাগরিকদের সীমাহীন দারিদ্র, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, জাতপাতের ভেদাভেদ, প্রিন্সলি স্টেটের সমস্যা, কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ভারত রীতিমতো জেরবার। এসবের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা ছিল বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ভোট পরিচালনা করার জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন করার দরকার ছিল। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর সেই সময় খুব ভালো সম্পর্ক। এই বন্ধুত্বের কারণেই, একদিন নেহেরু বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত সুকুমার সেন। তাঁকেই সবথেকে উপযুক্ত বলে মনে করেছিলেন বিধানচন্দ্র।
নেহরুকে সে কথা জানালেই, রাজি হয়ে যান তিনিও। ১৯৫১ সালে গঠিত হয় ভারতের নির্বাচন কমিশন। সেই কমিশনের প্রথম নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হন সুকুমার সেন। নির্বাচন কমিশনার পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেই, নেহরুকে সুকুমার প্রথমেই জানিয়ে দেন, তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। বিশাল এই দেশের ৮৫% মানুষ তখনও নিরক্ষর। ১৪ শতাংশের বেশি মানুষ তখনও ব্যালট বাক্স বা পেপার চোখে দেখেননি। যাতে তারাও ভোট দিতে পারেন, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। সারা ভারতে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বন্দোবস্ত করতে হবে। লোকসভার পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। মানুষকে নির্বাচনের ব্যাপারে অবগত করতে হবে। আর এই বিষয়টা একেবারেই সহজ হবে না।
১৯৫০ সালের নির্বাচনী নিয়মবিধি অনুযায়ী সেই সময় নিয়ম ছিল, ভারতের ভোটার হতে হলে, ন্যূনতম তাকে ১৮০ দিনের জন্য ভারতের বাসিন্দা হতে হবে এবং তার বয়স হতে হবে ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি অনুযায়ী ২১ বছর। ভারতে আসা উদ্বাস্তু এবং মহিলাদের এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলেন নেহরু। কিন্তু ভোটার তালিকা বানাতে গিয়ে দেখা গেল আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। গ্রামের অনেক মহিলাই নিজেদের নাম বলতে চাইছেন না। চিরাচরিতকাল ধরেই তারা 'মহেন্দ্রর বউ', 'সুরিন্দরের মা'। নিজের নামও অনেকেই জানেন না, অথবা তাদের তেমনভাবে নামকরণ কোনওদিন করাই হয়নি। এভাবে তো আর নির্বাচনী তালিকা তৈরি করা যায় না। তাই ২৮ লাখ নাম বাতিল করেই তৈরি করা হলো ভারতের প্রথম ভোটার তালিকা। কিন্তু কীভাবে ভোট দেবেন মানুষ? তা শেখাতে প্রত্যেক নির্বাচন কেন্দ্রে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমার মতো করে বোঝানো হলো কীভাবে ভোট দিতে হয়। রেডিওতে চলল তুমুল প্রচার। নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন নিজে পুরো বিষয়টার তদারকি করলেন দেশের কোণে কোণে গিয়ে।
আরও পড়ুন- কেন চাইলেও মোছা যায় না আঙুলের ভোটের কালি? জানেন, নির্বাচনী কালির ইতিহাস?
ব্যালট বুথ এবং ভোটের কালি
১৯৫২ সালে একসঙ্গে ৪৫০০ টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। এর মধ্যে ৪৮৯টি আসন ছিল লোকসভা নির্বাচনের জন্য এবং ৪,০০০ টি আসন ছিল একাধিক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য। সম্পূর্ণ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সারা দেশে ২ লক্ষ ২৪ হাজার পোলিং বুথ স্থাপন করা হয়। সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন ভবনে পরিচালিত হয় এই বিশাল কার্যক্রম। যেখানে এই ধরনের কংক্রিটের তৈরি বাড়ি পাওয়া যায়নি, সেখানে অস্থায়ী কাঠামো তৈরি করেই বানানো হয়েছিল পোলিং বুথ। একটা বিশাল ক্ষেত্র জুড়ে প্রচুর হিসাব-নিকাশের পর নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
তবে অনেকেই তখনও পর্যন্ত জানেন না ব্যালট বাক্স কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। সেই কারণে এক সহজ পদ্ধতি নেয় নির্বাচন কমিশন। একাধিক ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা হয় প্রতিটি নির্বাচনী বুথে। মানুষজনের যাতে বুঝতে সুবিধা হয়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য ছিল আলাদা আলাদা রঙের বাক্স। এই পুরো ব্যালট বাক্স তৈরি হয়েছিল ৮,২০০ টন ইস্পাত দিয়ে। বিষয়টা নিয়ে বিরোধীরা সরব হলেও, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আর কিছু করার ছিল না নির্বাচন কমিশনের। তাই কিছুটা বিতর্কও থেকেই গিয়েছিল।
নয়া রাজনৈতিক ঝড়
১৯৫২ সালের নির্বাচনে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছিল সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। তৎকালীন ভারতে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের প্রভাব ছিল না বললেই চলে। তবে একাধিক আদর্শের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিল সেই নির্বাচনের সময় থেকেই। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া, অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা সহ আরও অনেক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল সেই নির্বাচনে। সর্বভারতীয় দল হিসেবে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল ১৪ টি রাজনৈতিক দল। আর বিধানসভা নির্বাচন মেলালে, সব মিলিয়ে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল ৫৩।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রচার ছিল প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী জওহরলাল নেহরুকে ঘিরেই। ১৯৪৯ সালে, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যুর পর, কংগ্রেসের সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেছিলেন নেহরু। সারা ভারতে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার জন্য ২৫ হাজার মাইল সফর করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ১৮০০০ মাইল হেলিকপ্টারে, ৫২০০ মাইল গাড়িতে, ১৬০০ মাইল ট্রেনে এবং ৯০ মাইল সমুদ্রযাত্রাও করেছিলেন নেহরু। আর নেহরুর এই প্রচারের মূল মন্ত্র ছিল, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই। অস্পৃশ্যতা, জমিদারিত্ব এবং জাতিভেদ দূর করার লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনে নেমেছিলেন পণ্ডিত নেহেরু।
কংগ্রেস ছাড়াও, ১৯৫২ নির্বাচনের সময় অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া। ইংরেজ আমলে ভারতীয় বামপন্থার চর্চা পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে গোপনে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের বামপন্থীরা। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ না করার বিষয়টা ভারতের জনসমাজে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। তাই নিজেদের ভাবমূর্তি আবারও তুলে ধরতে আন্দোলনের পন্থা বদল করেছিলেন বামপন্থীরা। সশস্ত্র আন্দোলনের পরিবর্তে সংসদীয় সাম্যবাদকে নিয়ে সামনে আসে ভারতের বাম দলগুলি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া। ১৯৫১ সালে নতুন সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষের নেতৃত্বে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সিপিআই।
সিপিআই এবং কংগ্রেস ছাড়া এই নির্বাচনের তৃতীয় সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল ভারতীয় জনসংঘ। ভারতের হিন্দুদের একজোট করে একটা বড় ভোটিং ব্লক তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ভারতীয় জনসংঘ ওরফে BJS তৈরি করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর, আরএসএস-এর সঙ্গে যোগ দিয়ে BJS স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৫১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নতুন দিল্লিতে এই দলের স্থাপন সমারোহ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অখণ্ড ভারতের ধারণাকে সামনে রেখে নিজের রাজনৈতিক দলের ঘোষণা করেন। আর পাকিস্তান, কংগ্রেস, জহরলাল নেহরু কিংবা ভারতকে নিজের মাটি বলে মেনে নিতে না পারা মুসলিম সম্প্রদায়, সবার বিরুদ্ধেই ছিল শ্যামাপ্রসাদের লড়াই।
নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল কিষাণ মজদুর প্রজা পার্টি (KMPP), সোশ্যালিস্ট পার্টি, অল ইন্ডিয়া সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন এবং আরও অনেক রাজনৈতিক দল। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অন্যতম মুখ জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং রাম মনোহর লোহিয়ার সোশ্যালিস্ট পার্টি সেই সময় নতুন এক রাজনৈতিক ঝড় নিয়ে এসেছিল। গান্ধীবাদী কংগ্রেসের ধারণাকে সামনে রেখেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল কিষাণ মজদুর প্রজা পার্টি এবং সোশ্যালিস্ট পার্টি। অন্যদিকে, নিম্নবর্গের মানুষদের দুর্দশা ঘোচাতে, তাদের কথা সংসদে তুলে ধরতে নির্বাচনী ময়দানে নেমেছিল অল ইন্ডিয়া সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন।
প্রতীকের লড়াই
প্রতীক নির্বাচন ছিল আরেক সমস্যর বিষয়। নির্বাচনের অংশগ্রহণের জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি নির্দিষ্ট প্রতীকের প্রয়োজন হয়। সেই সময় ভারতে নির্বাচনী প্রচারের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল কৃষিকাজ। সেই কারণেই সিংহভাগ দলের পছন্দের প্রতীক ছিল লাঙল। কিন্তু সকলকে তো আর লাঙল চিহ্ন দেওয়া যাবে না। সেই কারণে নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন ঠিক করলেন, কাউকেই লাঙল চিহ্ন দেওয়া হবে না। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে নিজেদের দ্বিতীয় পছন্দের প্রতীক জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। সেই মতো কংগ্রেসের কাছে গেল দু'টি বলদ, সোশ্যালিস্ট পার্টির হাতে এল গাছ, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া বেছে নেয় কাস্তে-ধানের শিষ, বি আর আম্বেদকরের SCF প্রতীক হিসেবে পায় হাতি, ফরওয়ার্ড ব্লকের কাছে যায় সিংহ, রেভলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতীক হয় মশাল। কংগ্রেসের কাছে হাত চিহ্নটি প্রথমে ছিল না, পরে ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে কংগ্রেসের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয় 'হাত'।
ভারতীয়দের প্রথম নির্বাচন
প্রাথমিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার নির্বাচনী প্রচার শোনা যেত মস্কো রেডিওতে। রাশিয়ার ধারণা হয়েছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। সেই কারণেই তাসখন্দের রেডিও স্টেশন থেকে মস্কো রেডিও তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়ে প্রচার করতে শুরু করে। সেই সময় এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হলেও, জওহরলাল নেহরু বিষয়টাকে খুব একটা বেশি গুরুত্ব দিতে চাননি।
আবহাওয়াও ছিল সেই সময় বড় সমস্যার বিষয়। ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের মার্চ মাসের মধ্যে সারা ভারতে ৬৮ দফায় ভোট নেওয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র হিমাচল প্রদেশ এবং জম্মু-কাশ্মীর অংশগ্রহণ করেনি। ১৯৬৭ সালের আগে কাশ্মীরে লোকসভা আসনের জন্য কোনও নির্বাচন করা যায়নি। অন্যদিকে যাতায়াতে দুর্গমতা এবং প্রবল ঠান্ডার কারণে সমস্ত রাজ্যের থেকে প্রায় পাঁচ মাস আগে অক্টোবর মাসে হিমাচল প্রদেশে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ করা হয়েছিল। সেই সময় স্বাধীন ভারতের প্রথম ভোট দিয়েছিলেন শ্যামসরণ নেগী।
কেরলে ৮০.৫ শতাংশ মানুষ নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন এবং সবথেকে কম ভোটগ্রহণ হয়েছিল মধ্যপ্রদেশে, মাত্র ১৮%। সারা দেশের নিরিখে, ৬০ শতাংশ মানুষ প্রথম নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। ওড়িশার জঙ্গলঘেরা কিছু জায়গাতেও ভালো ভোট পড়েছিল। তপশিলি জাতি, উপজাতি অধ্যুষিত এলাকাতেও মানুষ ভোট দিতে গিয়েছিলেন। সেই সব জায়গায় প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। তবে, কিছু বুথ এমনও ছিল যেখানে শুধু চিতা আর হাতি ছাড়া কিছু দেখতে পাওয়া যায়নি। কোনও মানুষই ভোট দিতে আসেননি সেই সব বুথে।
আরও পড়ুন- নির্বাচনী বন্ডের চেয়েও ভয়াবহ! ১২০০০ কোটি টাকার দুর্নীতি PM CARES ফান্ডে?
কংগ্রেসের বড় জয়
নির্বাচনে একাধিক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেও, প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস যে জয়লাভ করবে, তা মোটামুটি স্পষ্ট ছিলই। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, দারুণ ব্যবধানে বিরোধীদের পিছনে ফেলে দিয়েছেন জওহরলাল নেহরু। ৪৮৯ টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৩৬৪ টিতে জয়লাভ করেছিল কংগ্রেস। অন্যদিকে, ২২৪৭টি বিধানসভা আসনেও জয়লাভ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। তবে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, ৫০ শতাংশের বেশি ভারতীয় কিন্তু অ-কংগ্রেসি দলগুলিকেই ভোট দিয়েছিলেন। ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৭৪.৪ শতাংশ আসনে জয়লাভ করেছিল কংগ্রেস।
দ্বিতীয় স্থানে থেকে প্রথম নির্বাচন শেষ করে সিপিআই। ৪৯ টি আসনে লড়াই করে ১৬টি আসনে জয়লাভ করেন বামপন্থীরা। তারা পান ৩.২৯ শতাংশ ভোট। এরপরেই ছিল সোশ্যালিস্ট পার্টি। ২৫৪টি আসনে লড়াই করে ১২টি আসনে জয় পায় সোশ্যালিস্ট পার্টি। জে বি কৃপালিনীর KMPP জয় লাভ করে মাত্র ৯টি আসনে। BJS লড়াই করেছিল ৪৯ টি আসনে এবং জিতেছিল মাত্র তিনটি আসন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজে দক্ষিণ পূর্ব কলকাতা আসন থেকে লড়াই করে জয়লাভ করেছিলেন। ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের SCF তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি ১৯৫২ নির্বাচনে। ৩৫ টি আসনে লড়াই করে মাত্র ২টি আসনে জয়লাভ করেছিল SCF। আশ্চর্যজনকভাবে, বি আর আম্বেদকর নিজেও কিন্তু এই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী নারায়ণ সাদোবা কাজরোলকারের কাছে। যদিও পরে তিনি রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন।
বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তৎকালীন কলকাতা উত্তর পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র থেকে (বর্তমানে কলকাতা উত্তর) দাঁড়িয়ে বাম-সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে সাংসদ হয়েছিলেন। তাঁর প্রতীক ছিল বেলচা কোদাল। তিনিই ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম বিজ্ঞানী যিনি রাজনীতিতে যোগদান করেন।
এই দুরন্ত জয়ের ফলে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু নিজের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা স্থাপনে সম্পূর্ণভাবে সফল হন। দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা তৈরি হয়েছিল শুধুমাত্র কংগ্রেসের নেতাদের নিয়েই। প্রধানমন্ত্রিত্বের পাশাপাশি, প্রতিরক্ষা দপ্তর এবং বিদেশ দপ্তর নিজের হাতে রেখে বাকি দপ্তরগুলি অন্য কংগ্রেস নেতাদের হাতে তুলে দেন নেহরু। সেই মন্ত্রিসভায় অন্যতম মুখ ছিলেন কৈলাসনাথ কাটজু, রফি আহমেদ কিদওয়াই, সিডি দেশমুখ, এন গোপালাস্বামী আয়াঙ্গার, অমৃত কৌর এবং সত্যনারায়ণ সিনহা।
স্বাধীনতার পরে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বেশ কিছু ত্রুটি ছিলই। ব্যালট বাক্স নিয়ে সমস্যা থেকে শুরু করে, ভোটাধিকার প্রয়োগে কিছু কিছু রাজ্যের মানুষের অনীহা, সব নিয়েই মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল ভারতীয় জনমানসে। তবে সুকুমার সেনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তেমনভাবে ওঠেনি। বরং সেই সময় যারা ব্যালটের মাধ্যমে ভোট করার কথা শুনে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছিলেন, তারাও পরবর্তীতে স্বীকার করেছিলেন, সেই সময় ভারতীয় গণতন্ত্রে ব্যালটই ছিল নির্বাচন সংঘটিত করার একমাত্র উপায়। ফলে সব মিলিয়ে বড় পরীক্ষা ভালোভাবেই পাশ করে গিয়েছিল ভারতের নির্বাচন কমিশন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের স্ত্রী ইলিনর সেই সময় ভারত সফরে এসে আকাশবাণীর এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন, "ভারত এক নিদারুণ পরীক্ষা দিয়েছে এবং সেই পরীক্ষায় সম্পূর্ণ সফল।"