এটাই শেষ নয়, পরের বিশ্বকাপও খেলবেন বিশ্বজয়ী মেসি?

Lionel Messi: সব ফুটবলাররা মেসি হতে চায়, কিন্তু মেসি হয় মাত্র একজন! আর মৌলিকতার বিদায়-ঘণ্টা না বাজার আবহে আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের আনন্দ দ্বিগুণ হয়েছে ক্রমশ।

এ যে গল্প হলেও পারত! রূপকথাকে ছুঁয়ে গিয়েও আকাশ ছুঁতে পারত! তিনি পেরেছেন। অবশেষে আকাশ ছুঁয়েছেন! চাঁদের দেশে যেন লিখে দিয়েছেন এক পাথুরে-ইতিহাস। ম্যাজিক আর আবেগকে সঙ্গী করেই ফের অসাধারণ হয়ে উঠেছেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি (Lionel Messi)। রবিবারের রাতে প্রতিভার উল্কাপাতে তিনিও হয়ে উঠেছেন অভিনব। মার্টিনেজ (Elimiano Martinez) আর ডি মারিয়া-ছোঁয়ায় জয়ের নায়ক হয়ে উঠেছেন তিনিও। কিন্তু...

৩৬ বছর পর ইতিহাস গড়ার কারিগর, ২০১৪ সালের স্বপ্নভঙ্গের প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়েছেন যিনি, তিনিই কি শেষ করছেন আরও এগিয়ে যাওয়ার পথ? মাত্র ৪ বছর বয়স থেকে ফুটবলের সঙ্গে বাস করা, ফুটবলের নবীন ঈশ্বরের অস্তিত্ব কি মলিন হতে চলেছে এবার? বালির দেশের বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষে যখন 'ভামোস আর্জেন্টিনা' আর 'মেসি-মেসি' চিৎকারে কাঁপছে লুসেইল স্টেডিয়াম, যখন মেসির সঙ্গেই আনন্দাশ্রুতে ভাসছে বিশ্বের আপামর নীলসাদা ভক্তরা, ঠিক তখনই ফের আশঙ্কা দানা বাঁধছিল এই বিদায়-প্রশ্নেই। কেউ কেউ বলছিলেন এই বুঝি হল শেষ!

নাহ্! শেষ হয়েও হল না শেষ! বিশ্বকাপের (Qatar World Cup Football) অধরা শিরোপার হাতছানি পেতেই সমস্ত গুজব সরিয়ে মেসি নিজেই জানিয়ে দিলেন, বিদায় নয় থাকছি বন্ধু! দেখা হবে আবার! এই প্রসঙ্গে এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক লিওনেল মেসি জানিয়েছেন,

"আমার সম্পর্কে যে রটনা রয়েছে আর জাতীয় দলের সঙ্গে না থাকার বা না খেলার কথা বলা হয়েছে, সেটি সঠিক নয়। আমি আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলা এখনই বন্ধ করছি না।"

যদিও ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে এই বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচের পরেই খবর ছড়ায়, কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালের পর আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের সঙ্গে আর খেলবেন না মেসি। এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ! তবে রবিবারের মেসি সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এখনই শেষ বিশ্বকাপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। আর মেসির এই বক্তব্যের পরেই ফের আশায় বুক বেঁধেছেন লাতিন আমেরিকার দেশের ফুটবল-ভক্তরা। মেসি-বিদায়ের বিমর্ষতা ফের কেটেছে নিমেষেই।

প্রসঙ্গত, আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের কোচ স্কালোনিকে একবার প্রশ্ন করা হয় মেসি সম্পর্কে। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, "মেসি সেরা। বিশ্বের সেরা ফুটবলার তিনি। বিশ্বকাপ না পেলেও তিনিই সেরা।" একাধিক সমালোচনা আর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরে যাওয়ার বিড়ম্বনায় 'মেসি কোথায়'-এর কটাক্ষের উত্তরও দিয়েছেন ৩৫ বছরের মেসি। প্রতিমুহূর্তে 'ওস্তাদের মার শেষ রাতে' প্রবাদকে সত্যি করে তুলেছেন তিনি। দেখিয়ে দিয়েছেন তিনিই সেরা, তিনিই আসলে অভিনব এবং মৌলিক।

আরও পড়ুন- আজ থেকে মেসি মারাদোনা সমার্থক, ২০২২ বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার

উল্লেখ্য, রবিবার বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে বিপক্ষ ফ্রান্সকে প্রথম থেকে চাপে ফেলেছিল আর্জেন্টিনা। মাত্র ২৩ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। পরপর তিনবার এই সুযোগেই বিপক্ষকে বিপদে ফেলেন মেসি। ১-০ এগিয়ে যায় নীলসাদা দল। আবার গোল! মাত্র ১০ মিনিট পরেই ডি মারিয়ার পায়ের ছোঁয়া আর মেসি ম্যাজিকে আবারও পিছিয়ে পড়ে ফ্রান্স। কিন্তু! ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের মতো ফের তিরে এসে তরী ডোবার পরিস্থিতি তৈরি হয় আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের। ৭৯ মিনিটের মাথায় কিলিয়ান এমবাপে-জাদুতে লড়াইয়ে ফেরে ফ্রান্স। এই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই মাত্র ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে ফের ম্যাজিক দেখান এমবাপে। গোল হয় আবার। সমতা ফেরায় ফ্রান্স। শেষ মুহূর্তে নাস্তানাবুদ হয় আর্জেন্টিনা।

৯০ মিনিটের খেলা যখন প্রায় ১০৮ মিনিট ছাড়িয়েছে তখন আবার ম্যাজিক দেখান মেসি! আবারও মেসি গোল করায় এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু ভাগ্য! ফের সেই এমবাপের তীব্র লড়াইয়ে পিছু হটে আর্জেন্টিনা। গোল করে সমান-সমান হয় ফ্রান্স। কিন্তু টাইব্রেকারে মেসি আবার! একের পর গোলে এগিয়ে যায় নীলসাদা ব্রিগেড।

আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজের চমকে ধূলিসাৎ হয় ফ্রান্স। চূড়ান্ত লড়াইয়ের মঞ্চেও অধিনায়ক মেসি সকলের চেয়ে এগিয়ে নিয়ে যান নিজেকে। যাঁর জন্য রাত জাগে বিশ্বের একটা বড় অংশ, যাঁর পায়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে একটা বড় গোষ্ঠী! যাঁকে ঘিরেই তৈরি হয় ইতিহাস, সেই মেসিই রাজকীয় ছাপে যেন চিৎকার করে বলে দেন, দেখিয়ে দিয়েছেন সব ফুটবলাররা মেসি হতে চায়, কিন্তু মেসি হয় মাত্র একজন! আর মৌলিকতার বিদায়-ঘণ্টা না বাজার আবহে আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের আনন্দ দ্বিগুণ হয়েছে ক্রমশ।

মেসির শুরু

রোজারিওর এক গ্রীষ্মের ২৪ জুন জন্ম নেন মেসি। ১৯৮৭ সালে স্টিল কারখানার ম্যানেজার বাবা জর্জ মেসি এবং দিনমজুর মা সেলিয়ার ঘরে জন্ম হয় তাঁদের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় জনের। সকাল থেকে রাত কাজে যেতেন তাঁদের বাবা-মা। সংসারে ৪ ভাইয়ের লড়াই চলত তখন থেকেই। এর সঙ্গেই ক্রমেই বড় হয়ে ওঠা। মাত্র ৪ বছরেই বন্ধু-ভাইদের সঙ্গে ফুটবলে পা লাগানো শুরু। ফুটবল ঈশ্বরের আবির্ভাবের দিননামচার সূচনা হয় তখন থেকেই। মেসির সুবিধা ছিল, তাঁর বাবাও ফুটবল ভালোবাসতেন। মারাদোনা-ভক্ত এই পরিবারের বাকিরাও ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন সর্বদা। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। ছোট্ট মেসির স্বপ্নের শুরু তখন থেকেই।

কিন্তু পথ! সোনার চামচ মুখে না নিয়ে জন্মানো আর খাওয়ার জন্য লড়াইয়ের মধ্যেও এগিয়ে যেতে শুরু করেন শিশু মেসি। বাবার প্রশিক্ষণ নিতে নিতেই স্থানীয় ক্লাব 'গণ্ডলি'তে শুরু করেন খেলা। তারপর রোজারিওর 'ওল্ড বয়েজে' যোগ দেন মাত্র মেসি। ১০ বছর বয়সে যখন খানিকটা বুঝতে শিখছেন মেসি। ঠিক সেই সময়েই নামল মারাত্মক বিপদ!

বিরল রোগে আক্রান্ত লিও

১০ বছরের শিশু আক্রান্ত হলেন 'গ্রোথ হরমোনে'র ঘাটটিতে। যে রোগের চিকিৎসায় তখন প্রত্যেক মাসে প্রয়োজন ১ হাজার ডলার! শুরু হল বেঁচে থাকার লড়াই। নিজের জীবনে ফুটবল বাঁচিয়ে রাখার লড়াই শুরু হল অন্যভাবে। তিনি এবারও পারলেন। একরত্তি শিশুও তীব্র মানসিক জেদ আর লড়াইয়ে জিতলেন এবারও।

ফুটবলে রাজকীয়-প্রবেশ

এরপর একাধিক ক্লাবে খেলার সঙ্গেই ছোট বয়সেই মেসির ডাক পড়ল বার্সেলোনা থেকে। ২০০০-০৩ পর্যন্ত যুব দলের হয়ে খেলতে শুরু করলেন মেসি। ততদিনে চলছে রোগের সঙ্গে লড়াইও। এরপর আর পিছনে ফিরতে হয়নি তাঁকে। ২০০৩-০৪ পর্যন্ত বার্সেলোনার সি দলের হয়ে খেলা। তারপরের এক বছর বি দল। এরপর ২০০৪ নাগাদ বার্সেলোনার মূল দলে প্রবেশ। এই ক্লাবের হয়ে মেসি এখনও পর্যন্ত ৫২০টি ম্যাচে গোল করেছেন ৪৭৪টি। বারবার শিরোনামে এসেছেন তিনি। রেকর্ড গড়েছেন একই ক্লাবে দীর্ঘ ১৭ বছর কাটানোর। মেসিকে মেসি তৈরি করেছে এই বার্সেলোনাও!

মারাদোনার অপমান থেকে দিয়েগো-ভক্ত মেসি, আর্জেন্টিনার জাতীয় দল থেকে শুরু করে বার্সেলোনা-যাপন- একের পর এক ক্ষেত্রে তারকা হয়ে উঠেছেন লিওনেল। ২০২১-এ প্যারিস সেন্ট জার্মেইন ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেন মেসি। সেখানেই চূড়ান্ত সফল হন। ৩৯ ম্যাচে ১৩ গোলের মালিক তিনি ইতিমধ্যেই।

আরও পড়ুন- প্রথম ম্যাচে হেরেও বিশ্বজয়! কেন রূপকথাকেও হার মানাবে মেসিদের এই যাত্রা?

জাতীয় দলের মেসি

আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব ২০ দলের হয়ে ২০০৪ সালেই খেলা শুরু করেন মেসি। মাত্র এক বছরেই ১৮টি জাতীয় ম্যাচে ১৪ গোল আসে তাঁর পায়ে। ২০০৮ নাগাদ মাত্র কয়েকটা ম্যাচ খেলেন অনূর্ধ্ব ২৩ দলের হয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় দলে সুযোগ পাননি মেসি। যেখানে মারাদোনা থেকে শুরু করে একাধিক আর্জেন্টিনীয় ফুটবলারের ইন্ধন ছিল বলেও দাবি করা হয়।

যদিও ২০০৫ সাল নাগাদ লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার মূল দলে সুযোগ পান। তাঁর পায়ের কেরামতিতে সেই রেকর্ডই একের পর কাণ্ডে ভাঙতে শুরু করেন তিনি নিজেই। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৭২ আন্তর্জাতিক ম্যাচে মেসির গোলের সংখ্যা ৯৮।

খেতাব জয়ে মেসি-কৃতিত্ব

২০০৫। ফিফার অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। বিপক্ষের নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে জয় পায় এই দল। একই বছরে দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় স্থান দখল করে মেসিদের দল। ২০০৮ -এ মেসির আর্জেন্টিনা ফুটবলে সোনার পদক জেতে বেজিং অলিম্পিকের মঞ্চে।

কোপা আমেরিকায় ২০০৭, ২০১৫, ২০১৬ সালে দ্বিতীয় স্থান দখল। ২০২১ -এ ব্রাজিলকে হারিয়ে মেসির নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।

২০১৪-র বিশ্বকাপে স্বপ্নভঙ্গ হয় মেসিদের। ব্রাজিলের সামনে বিশ্বকাপের ফাইনালে হারে আর্জেন্টিনা, যে স্বপ্নপূরণ হয়েছে রবিবার। ২০২২-র বিশ্বকাপে সেরার সেরা হয়েছে মেসির দল।

সম্পর্কে মেসি

বার্সেলোনায় সুযোগের পর থেকে মেসির জন্য ঢল নামে তাঁর মহিলা ভক্তদের। কিন্তু জানা যায়, ২০০৮ নাগাদ বাল্যবন্ধুর বোনের সঙ্গে প্রেমে মজেছেন মেসি। একসঙ্গেও নাকি থাকছেন অবিবাহিত সেই জুটি। রোজারিওর বাসিন্দা অ্যান্টনিলা রকুজ্জর সঙ্গে প্রেমের কথা ২০০৯ নাগাদ স্বীকার করেন মেসি নিজেও। ২০১২ সালে অ্যান্টনিলা জন্ম দেয় তাঁদের প্রথম সন্তান থিয়াগোর। এরপর ২০১৫ নাগাদ জন্ম হয় মেসির দ্বিতীয়পুত্র মাতেওর। অ্যান্টনিলা ২০১৮ নাগাদ তৃতীয় সন্তান সিরোর জন্ম দেন। বরাবর পারিবারিক মেসি। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবনের এগিয়ে চলা। সব ক্ষেত্রেই মেসির প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর পরিবার। রবিবারের ফাইনাল যুদ্ধ জয়ের পরেও ইশারায় সন্তানের মাঠে পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছেন মেসি।

ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ থেকে শুরু করে বিরল রোগাক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালানো, একাধিক সামাজিক কাজেও অনন্য হয়ে উঠেছেন মেসি। বারবার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথাও বলেছেন এই খেলোয়াড়।

কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই তাঁর জীবনের পথে কাঁটা হয়েছিল বিশ্বকাপ। একাধিক চেষ্টাতেও বারবার বিশ্বকাপের মঞ্চে এলেও হাতছাড়া হয় খেতাব। প্রত্যেক মুহূর্তের লড়াইয়ের পরেও হারতে হয় মেসিদের। এবার আর না। শেষ হাসি হাসলেন মেসিই। যাওয়া না যাওয়ার দাবানলেও রেখে গেলেন ইতিহাস। এক কঠিন পাথরে খোদাই করা ফুটবল অবদান।

More Articles