হাতকাটা দুঃখরা ফুলহাতা হয় শীতেই, খোসা ছেড়ে আসে কমলালেবু, না হওয়া প্রেমরা...

Winter 2022: শীত কাটাতে সোয়েটার হয়তো ভালো, গান আরও ভাল। পশম প্রেমকে হারাতে পেরেছে আর কবে?

এরকম শীতে দূরের শব্দ বেশি শোনা যায়। কুয়াশায় চোখ কথার খেলাপ করে বলে হয়তো কান পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করে। এরকম শীতে রোদের গন্ধ পাওয়া যায় দুপুরের লেপে। সন্ধা থেবড়ে বসে থাকে আমার পিসির উলে। এবার অন্তত একটা সোয়েটার! সকালে আমি উমেদার; রোদের, কখন তার কৃপাদৃষ্টি তেলের অভিমান গলাবে সেই অপেক্ষা স্পর্শ করে বসে থাকি।

রাত্রে নিজেকে কেউকেটা মনে হয়। এদিকে, জেগে পড়ব বলে মার বেশি দুধ দেওয়া কফির স্বাদকে বড় হওয়ার স্বাদ ঠাউরে ঠকি। প্রথমবার না, শেষবার তো নয়ই। নিভে যাওয়া পাড়ায় এল ডোরাডোর মতো জেগে অঠে অশ্রুতপূর্ব প্রতিবেশী স্টেশন, ট্রেন আসা যাওয়ার শব্দে আমি নিজের মনে নিজেই একটা মফসসল হয়ে উঠি ক্রমশ।

আর যার হৃদয় জুড়ে এত অজস্র লেডিস সাইকেল দাঁড় করানো তাকে ক্যালকুলাস বোঝাবে এত ভিটামিন গাজরেরও নেই। কচ্ছপ ধূপের অপারগ গন্ধ সিগারেটে বাসা বেঁধেছে। দেশলাইয়ের সঙ্কেত পাশের ঘরে পৌঁছলে যে ঝক্কি, তার চেয়ে এটুকু অত্যাচার নাক সয়ে নেবে। এসবের মাঝে মায়ের বেশি দুধ দেওয়া কফিতে সর পড়ে, আমি আর পাত্তা দিই না। মার কফির ভুল আমি ধোঁয়া দিয়ে শুধরে দিতে শিখে গেছি তদ্দিনে।

আরও পড়ুন- বাবা বলেছিল, এই দুঃখটা কখনও ভুলবি না

লাউ শোল খেয়ে, মুখে মৌরি দিয়ে বাবা অফিস বেরোচ্ছে। মায়ের অহংকার টবের নাইন ও' ক্লক হয়ে বারান্দায় ফুটে রয়েছে। কারণ মা জানে গলির মুখে গিয়ে বাবা তাকাবে। আর বাবা তাকাত, তাকাতই। সবই এরকম শীতে।

পিকনিক তো আসলে শীতেরই সন্তান। যে রোদ না পুড়িয়ে ভাড়াটে দিদার মুখে শোনা মেলার গল্প বলে তার চেয়ে উর্বর আকাশ আর কী হতে পারে পিকনিকের জন্য। আর এরকম পিকনিকেই পুকুরের পাশে ছবি তুলতে গিয়ে সর্বনাশ! পা পিছলে ডুবল সনাতন, থুড়ি তোর সালওয়ার। ভিজে একশা। কোথায় একটু বিব্রত হবে তা না, দশ মিনিটে কোন সিনিয়ার ছেলের লাল বারমুডা জোগাড় করে হিহি চালু! কোনও লজ্জা আছে?

আগুন জ্বালাব ভেবেছিলাম, কিন্তু পিকনিক স্পট অনেক টাকা চাইল। ওগুলো নাকি আমাদের জন্য না, তাই হাঁটুজলে নৌকা নিলাম। সোয়েটার না আনার জন্য নিজেকে মনে মনে অসাংবিধানিক কিছু কথা বলছিলাম হয়তো, তুই টের পেয়েছিলি কি? নাহলে নৌকো বেসামাল করে পাশে বসলি কেন? বললি কেন, “দাঁড়াও তোমার ঠান্ডা আমি কাটাচ্ছি”?

তারপর হাঁটুজলে প্লাবন এল, সেদিন কোন পক্ষ ছিল আজ আর মনে পড়ে না। শুধু টের পাই জ্যোৎস্না ছিল, কারণ তুই গাইছিলি। দু' হাত ছেড়ে। সেদিন টের পেলাম শীত কাটাতে সোয়েটার হয়তো ভালো, গান আরও ভাল। পশম প্রেমকে হারাতে পেরেছে আর কবে?

এটা কিছু বেওয়ারিশ ধুলোর সময়ও বটে, যারা জমা হয় মেলার কাছেপিঠে, যার কিছুটা জিলিপিতে মেশে; কিছুটা নতুন কবিতায়। কিছু ধুলোমাখা কবিতারা আমাদের নতুন কবিতা হয়, যার দায় কবিতার নয়, জিলিপির তো একদমই নয়। তার মন অত প্যাঁচালো নয়। সে নেহাতই জিলিপি, তার গাঁটে গাঁটে মিষ্টি, সে তঞ্চকতা জানে না।

আরও পড়ুন- ‘ওদিকে তাকালে চোখ খারাপ হয়!’ টুকি ও নব্বইয়ের সেই বৈশাখী বিকেল

পোষা রোদকে পায়ের কাছে নিয়ে খোসা ছাড়ায় পিসি, কমলালেবুর, কড়াইশুঁটির, না হওয়া প্রেমের। দুঃখগুলো আগের মতো নেই আর, বিনা অনুমতিতে বড় হচ্ছে তারা। আগের মরসুমের হাতকাটা দুঃখরা এখন ফুলহাতা।

ছেলে আর মেয়েদের আলাদা সেন্ট এসব আমরা জানতাম না। এজমালি সেন্টের পিছনে আমরা লাইন দিয়েছি। আমি, দাদা, বাবা। মার মাখা হলে আমরাও! বিয়েবাড়িতে একটু সেন্ট না মাখলে চলে?

এরকম শীতে না জানিয়ে চলে আসেন কাশিমবাজারের জেঠু, গুপ্তিপাড়ার সোনাদাদু। রাতের লেপের গল্পে জমা হয় বাবার ছোটবেলার দুষ্টুমি, সোনাদাদুর গলায় ফরিদপুরের গন্ধ লেগে থাকে। বাবার অফিসে এখন পরপর মিটিং হয়। বাবা প্যাকেট পায়, খায়না। আমি আর দাদা মোচ্ছব করি ফ্রিজের সামনে বসে। এরকম শীতেই প্রথমবার টের পাই, ভালোবাসায় নিউটনের তৃতীয় সূত্র কাজ করে না।

ঠকি।

প্রথমবার নয়, শেষবার তো নয়ই।

More Articles