পেপারব্যাকের ভাঁজে ভাঁজে গহন কস্তুরী

Paperback Books and Bengali Readers: সত্যিই তো মাথা থেকে কর্তার ভূত ঝেড়ে না ফেলতে পারলে, কীভাবেই বা নতুন লেখা পাঠকের সামনে আসবে। আমার বিশ্বাস সমান্তরাল প্রকাশনার অক্সিজেন পেপারব্যাক।

বছর চল্লিশ আগের এক সন্ধেবেলা কলকাতা থেকে ১৮৬ কিলোমিটার দূরের মফস্‌সলে বাবা অফিস থেকে ফিরে সাইকেল রাখছিল দরজার পাশের গলিটায়। তারপর ঘরে ঢুকে প্রথমেই ব্যাগ থেকে বের করল লাল মলাটের চওড়া একখানা বই, সুকুমার রায়ের সমগ্র শিশুসাহিত্য। তখনও জানি না এই ধরনের বইকেই পেপারব্যাক বলে। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার দেখা প্রথম পেপারব্যাক ওটাই। সেদিন আমরা দু-ভাই বইটা নিয়ে এমন কাড়াকাড়ি করছিলাম যে বাবা শেষমেশ মলাট উলটে প্রথম পাতায় নিজেরই নাম সই করে আমাদের পড়তে দিয়েছিল। এর আগে সব বাঙালি শিশুই যেমন পড়ে 'ধারাপাত', 'বর্ণপরিচয়'- ঘুড়ির কাগজের মতো পাতলা মলাটের এসব প্রাইমারকে আজকে পেপারব্যাক বলতেই চাই। বাংলার প্রত্ন-পেপারব্যাক। যদিও সচেতন পেপারব্যাক হয়তো সেগুলো ছিল না। আবার, আমার স্কুলের বইয়ের বাইরে পেপারব্যাক ছিল 'সহজপাঠ'। কোনো কোনো বিপ্লবীর তখন মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আদ্যিকালের এই বই বাচ্চাদের পড়ানোর কোনো দরকারই নেই। অগত্যা 'সহজপাঠ' তখন আমাদের পড়ার বইয়ের বাইরে পড়া। 

আমাদের বাড়িতে 'সঞ্চয়িতা' ছিল, নজরুলের গানের স্বরলিপি ছিল সব পেপারব্যাক। বইয়ের দাম কম হওয়াটা হয়তো জরুরি ছিল বাবার কাছে। কিন্তু যেদিন থেকে রবীন্দ্রনাথের বই আলাদা করে দেখতে থাকলাম, সব সময়েই দেখেছি নরম মলাটের বই। আমার ছোটোবেলার এমন একটা কাছের বই 'শিশু'।  পালকিতে মা আর পাশে ঘোড়ায় আমি টগবগিয়ে, এ-ও বোধহয় বাঙালি শিশুর প্রাচীন আর্কেটাইপ। 

পেপারব্যাক যে গুটেনবার্গ গ্যালাক্সির একটা লম্বা ঝাঁপ সেটা বুঝতে ঢের সময় লেগেছে আমার। বিশ্বভারতীর বই দেখেছি ছিমছাম গেরুয়া কাগজের নরম মলাটে রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখায় নাম (পরে বুঝেছি সব বইয়ের নাম রবীন্দ্রনাথের লেখা নয়, রাবীন্দ্রিক ছাঁদে অন্য কারুর হাতের লেখা) আর তাঁর সই ছাপা। শুনেছি তিন বন্ধু গাস্তঁ গালিমার, আঁদ্রে জিদ আর জঁ স্লামবারজে প্রতিষ্ঠিত গালিমার সংস্করণের বইগুলি বিশ্বভারতীর গ্রন্থনির্মাণের নিরাভরণ পারিপাট্যের পিছনে বড়ো প্রেরণা ছিল। পুলিনবিহারী সেনের মতো গ্রন্থনির্মাতারা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন যে কোনো বইয়ের সৌন্দর্য তার ভেতর থেকে ফুটে বেরোয়। বাইরের চাকচিক্য? এহ বাহ্য।   

আরও পড়ুন: লেখক কম, প্রকাশকে গিজগিজ করছে বাংলার বইবাজার : সুমন চট্টোপাধ্যায়

এবার পেপারব্যাক বই নিয়ে বেশ চলতি একটা মজার গল্প বলি। মার্কিন দেশে পেপারব্যাকের পহেলা ঘোড়সওয়ার ‘পকেট বুকস’ ১৯৩৯ সালে প্রথম যে দশখানা বই নিয়ে বাজারে নামে তাঁর মধ্যে এমিলি ব্রন্টির  উদারিং হাইটস-ও ছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে ছিল আজকের ভাষায় ‘বিশেষ অফার’ সে-বই পড়ে মুগ্ধ কোনো ক্রেতা যদি ওই বইটি আরও কয়েকপুরুষ ধরে বাড়িতে রাখার কায়েমি সিদ্ধান্ত নেন, তবে পঁচিশ সেন্টের বইখানা পকেট বুকসের বিপণীতে ফিরিয়ে দিয়ে অতিরিক্ত সত্তর সেন্ট জমা দিলে তাঁকে বাড়ির ঠিকানায় মডার্ন লাইব্রেরির পঁচানব্বই সেন্টের কাপড়ে বাঁধাই জবরদস্ত সংস্করণ পাঠিয়ে দেওয়া হবে! গল্পটা বলার কারণ একটাই যে পেপারব্যাকের শুরুর দিনগুলোতে পেপারব্যাক নির্মাতারাও এর আয়ু এবং গুণগত উৎকর্ষ নিয়ে খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না। 
           
 কিন্তু শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে পেপারব্যাকের রথ ছুটেছে দুনিয়া জুড়ে। আমার মতো অনেক মানুষের আবার পেপারব্যাকপ্রীতি খানিক বেশিই। বুঝতেই পারছেন বিদেশি বইয়ের ক্ষেত্রে দাম একটা বড়ো ব্যাপার। কিন্তু আজকাল পেপারব্যাকের গুণগত মান যেখানে পৌঁছেছে তা কিন্তু বোর্ড বাঁধাই প্রথাসিদ্ধ বইয়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়। পুরোনো দিনে পুথির পাটার মতো ভারী একখানা বাঁধাই করা মলাট দেওয়া বইয়ের অনেক ঝক্কি। দুর্বল অর্থনীতির ব্যাপারটা ছাড়াও, আরেকটা সংকট হল বইয়ের পোকা। সমঝদার লোকেদের মুখে শুনেছি ওই রুপোলি পোকাদের জন্ম ও শ্রীবৃদ্ধি না কি বাঁধাইয়ের জন্য ব্যবহার করা বোর্ড আর আঠার কল্যাণেই। আমার বন্ধু একবার গল্পচ্ছলে বলেছিলেন গ্রন্থরসিক, অধ্যাপক স্বপন মজুমদার না কি সারা বছরের সংগৃহীত বইপত্তর পাতলা কালো কাপড়ে বাঁধিয়ে মলাটে সাদা কালি দিয়ে নাম লিখে নিতেন।

প্রশ্নটা ঠিক এখানেও নয়। ধরুন যে-বই হাত থেকে হাতে গোপনে পাচার করার, তা কি মোটা বোর্ড দিয়ে বাঁধাই হবে ? এইখানে সংস্কৃতির ঢাক ফেঁসে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। দুনিয়া বদলে দেওয়া অনেক বই ধরা যাক, 'ম্যানিফেস্টো অফ দ্য কমিউনিস্ট পার্টি' কিংবা এককালে বাঙালির প্রিয় বৈপ্লবিক 'বচনসমুচ্চয়', 'রেড বুক' এসব পেপারব্যাক হবে এটাই স্বাভাবিক। এই তো সেদিন কানহাইয়া কুমার যখন বেশ বিপ্লবের আগুনে হাত সেঁকছিলেন জেএনইউ ক্যাম্পাসে, তখন কিনলাম 'ফ্রম বিহার টু তিহাড়', আবার রানা আইয়ুবের 'গুজরাট ফাইলস'- সে-ও পেপারব্যাক।

আমার সংগ্রহে গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের 'মেমোরিজ অফ মাই মেলাংকলি হোরস' আর 'স্ক্যান্ডাল অফ দ্য সেঞ্চুরি'  ছাড়া আর সব বই-ই পেপারব্যাক। এই তালিকা ক্রমেই বাড়তে পারে, গান্ধীজির 'মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ', নেহরুর  'অ্যান অটোবায়োগ্রাফি', কল্পনা জোশী (দত্ত)-র 'চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান' থেকে শুরু করে নগুগি ওয়া থিয়াংগোর 'ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড' এদোয়ার্দো গালেয়ানোর 'আপ সাইড ডাউন', শ্বেতলানা আলেক্সিভিচের 'সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইম', জোন বায়েজের 'অ্যান্ড আ ভয়েস টু সিং উইথ'- বাড়িতে সবই দেখছি নরম মলাটের বই। আর যে তিনখানা বই আমার বুক শেলফে জায়গা পাল্টালেও আমি টের পাই সিএলআর জেমসের 'বিয়ন্ড আ বাউন্ডারি',  আলবের্তো মাঙ্গেলের 'আ হিস্ট্রি অফ রিডিং', আন্দ্রেই তারকোভস্কির 'ডায়েরি টাইম উইদিন টাইম' সে-ও তো পেপারব্যাকই। এই সব দেখি আর মনে মনে ভাবি, আহা, অরুণ নাগ সম্পাদিত 'সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা'-র একখানা পেপারব্যাক হয় না !

আসলে পেপারব্যাক আমার আদরের ধন। এখন দেখছি যা পড়েছি তার অনেকটাই তো পেপারব্যাক ছিল। যার সঙ্গে নিভৃতে একটা আস্ত দুপুর কাটিয়ে ফের বিশ্বাসহন্তার মতো সন্ধেতে অন্য কারুর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটানো যায়। নরম, স্পর্শকাতর। যাকে তোয়াজে রাখতে হয় নইলে স্পাইন ভেঙে সারাদিনের যত কথা প্রকাশ্যে উগড়ে দেবে। যার সঙ্গে সম্পর্কটা পোশাকি নয়, ব্যক্তিগত। সুতরাং পবিত্র। দেবদাস আচার্যর ঠুঁটো জগন্নাথ বইতে ‘কবি’ নাম যে কবিতাটা আছে তাঁর শেষ তিন লাইন ‘জলের প্রাণীরা জলে থাকে/ ডাঙার প্রাণীরা থাকে ডাঙায়/ শুধু স্বপ্নের প্রাণীরা কষ্ট পায়’। আমারও বুঝি সেই দশা। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে থাকবে দেবদাসের জীবনপ্রভাতের মতো এই কবিতা বইখানিও পেপারব্যাক।

With Paperback edition of Bengali books new horizon of reader will extend By Srikumar Chattopadhyay Robibarer Royak
 
শঙ্খ ঘোষের 'কবির বর্ম', নিকোলাস গ্যিয়েনের অনুবাদ 'চিড়িয়াখানা ও অন্যান্য কবিতা', হ্বাল্‌টের হাসেনক্লেভারের 'মানুষ' কিংবা গিরিশ কারনাডের 'হয়বদন'-এর অনুবাদ, সংবেদী বক্তৃতার মুদ্রিত রূপ 'অন্ধের স্পর্শের মতো'  কিংবা 'হওয়ার দুঃখ' সবই পেপারব্যাক।       

কিন্তু বাংলা বইয়ের আঁতুড়ঘরে খোঁজ নিলে শুনবেন বাঙালি না কি পেপারব্যাক পড়ে না। তাই বাংলা বাজারে পেপারব্যাক হাতে গোনা। কথাটায় একেবারে ছিটেফোঁটাও সত্যি নেই এমন নয়। গত শতকের নয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলার এক দাপুটে প্রকাশন সংস্থা পেপারব্যাক এডিশনে অনেকগুলি উপন্যাস প্রকাশ করে। কিন্তু খুব অল্প দিনের মধ্যেই আমরা দেখেছিলাম রবীন্দ্রসদন চত্বরে তখনকার বইবাজারে অস্বাভাবিক কম দামে সেসব বই বিক্রি করা হল। দামের ক্ষেত্রে তাদের এমন উদারতা দেখে বেশ চমকিতই হয়েছিলাম। কেননা সেই সিরিজে বাংলা সাহিত্যে সেসময়ের নামকরা লেখকদেরই বই ছিল। কিন্তু হায়, বাঙালির বড়ো প্রিয় বোর্ড বাঁধানো বই।     

যদিও কয়েকজন প্রকাশকের পেপারব্যাক বেশ চালু বই। থীমা-র অসংখ্য পেপারব্যাক বই আছে। রসিক পাঠকের কাছে সে বইয়ের কদর অনেক। আর অবভাস তো পেপারব্যাকে চমকে দেবার মতো বই করে চলেছে। পরিমল ভট্টাচার্যের আশ্চর্য সব বই, অজয় গুপ্তর বই, সর্বোপরি মণীন্দ্র গুপ্তর দু-খণ্ড গদ্যসংগ্রহ, উপন্যাসসংগ্রহ এবং বাংলার স্মৃতিসাহিত্যে সম্ভবত গত পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে উজ্জ্বল সংযোজন অখণ্ড 'অক্ষয় মালবেরি'।  

আরও পড়ুন: পেপারব্যাক : বিদেশে ও স্বদেশে

মণীন্দ্রবাবু অবিশ্যি সারাজীবন মিনিমালিস্ট অ্যাপ্রোচেই বাঁচতে চেয়েছেন। হেমন্ত ১৩৭৮-এ কবিতা ও কবিতাসংক্রান্ত সংকলন 'পরমা'-র ষষ্ঠ সংকলনে তিনি শৌখিন মলাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল খুব সহজ এবং সাদা “ ‘আমাদের গরিব দেশে, ততোধিক গরিব কবিতা-পাঠকদের এই সৌখিন রমণীয়তার প্রতি এত দুর্বলতা কেন ?’ যাঁরা দুই মলাটের মধ্যেকার নিভৃত আভার চেয়ে মলাটের চটককেই বেশি মূল্য দেন, তাঁরা কখনোই যথার্থ কাব্যপাঠক নন। তাঁদের অন্তঃসারহীন সৌখিনতার দাবি আমরা বইতে রাজী নই।… আমাদের সকলেই [সকলেরই] মনে রাখা দরকার : আধুনিকতা মানে, বাহুল্যবর্জন। রম্য পেলবতার বদলে প্রাণময় পারুষ্য, বহিঃসজ্জার বদলে অন্তরতম উন্মোচন, চমৎকারী ভঙ্গির বদলে নিরলঙ্কার সৎভাষণই আধুনিক কবিতার অন্বিষ্ট। এই আদর্শ বাইরে ভিতরে সবদিক থেকেই মান্য। সুতরাং আমরা সৌখিন মলাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম। আধুনিক কবিতার মননশীল তন্ময় মুখশ্রীর সঙ্গে ঐ মূর্খ গৃধ্নু প্রচ্ছদ একেবারেই বেমানান।”

সত্যিই তো মাথা থেকে কর্তার ভূত ঝেড়ে না ফেলতে পারলে, কীভাবেই বা নতুন লেখা পাঠকের সামনে আসবে। আমার বিশ্বাস সমান্তরাল প্রকাশনার অক্সিজেন পেপারব্যাক। কম দাম, ছিপছিপে, নতুন ভাবনায় মাত করে দেবে  কিংবা অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে গড়ে তুলবে মহাজগৎকথা। আমরা অনেক কাল আগেই ফেলে এসেছি বসুমতীর পেপারব্যাকের যুগ। আজকালকার ডেস্কটপ পাবলিশিংয়ের দুনিয়ায়, ইনডিজাইনের কৃৎকৌশল আয়ত্ত করে চলুক পেপারব্যাক। তবেই না বাঙালি পেপারব্যাক পড়ে না এই দুর্মর কুসংস্কার ভাঙবে। হার্ড বাউন্ড আভিজাত্যের পাশে আন্তরিক পেপারব্যাকের ভাঁজে ভাঁজে আমরা খুঁজে নেব গহন কস্তুরী। বাড়ির বইয়ের তাকে উপচে পড়বে পেপারব্যাক মানে আমরা নতুন আলোর রেখা যেমন পাব, তেমনই নতুন পাঠকসমাজও গড়ে উঠবে। কান্দি কিংবা ক্যানিং থেকে আসা ছেলেটির হাতে নতুন একখানা বই তুলে দেবে বোলপুরের মেয়েটি। ধরা যাক, দু-জনেই হস্টেলে থেকে পড়ে। রেস্ত কম। তাদের বই পড়তে দেবে না বাংলা ভাষা?   

 

More Articles