জন্মই হতো না মোবাইল, কম্পিউটারের! যে জাদু লুকিয়ে আছে ছোট্ট মেশিনে
Transistor : প্রযুক্তির দুর্নিবার জয়যাত্রা সম্ভব হতো না, যদি না ছোট্ট পুঁচকে একটি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস তৈরি হতো আজ থেকে ৭৫ বছর আগে
ধরা যাক, বাসে বা ট্রেনে যেতে যেতে হাতে থাকা সর্বক্ষণের সঙ্গী মোবাইলটি গেল হারিয়ে! এই ছোট্ট ঘটনা আমার-আপনার জীবনে কত বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্যিই তো, ল্যাপটপ, মোবাইল, কম্পিউটার ছাড়া জীবনযাত্রার কথা ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়। কিন্তু, অত্যাধুনিক ট্যাব থেকে মঙ্গল অভিযান- প্রযুক্তির এহেন দুর্নিবার জয়যাত্রা সম্ভব হতো না, যদি না ছোট্ট পুঁচকে একটি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস তৈরি হতো আজ থেকে ৭৫ বছর আগে। ১৯৪৭ সালে তৈরি হওয়া ছোট্ট ডিভাইসটির নাম হলো ট্রানজিস্টার।
১৯৪০ এর দশকে আমেরিকার নিউ জার্সি শহরের বেল ল্যাব হয়ে উঠেছিল তৎকালীন প্রযুক্তির আঁতুর ঘর। রেডিও, টেলিস্কোপ, লেসার, সোলার সেলের মতো যুগান্তকারী উদ্ভাবন ঘটছিল সেখানে। ১৯৪৭-এর শেষের দিকে উইলিয়াম শকলি, জন বারডিন, ওয়াল্টার ব্র্যাটেন - বিজ্ঞানী ত্রয়ীর চেষ্টাতেই তৈরি হয় আধুনিক ট্রানজিস্টার। আধুনিক ইলেকট্রনিক্স ব্যবস্থার সূত্রপাত সেখানেই। একবিংশ শতাব্দীতে, ডিজিটাল সভ্যতার দুরন্ত ঘূর্ণি এই ইলেকট্রনিক্স ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই ঘুরে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে কী এমন যন্ত্র এই ট্রানজিস্টার যার হাত ধরে ডিজিটাল বিপ্লব সম্ভব হয়েছে? ট্রানজিস্টার না থাকলে কেমন হতো আজকের দুনিয়া? যাকে ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রায় অচল, তার কাজকর্ম বুঝে নেওয়া যাক ।
আরও পড়ুন - পরিবেশ ও নিজেকে বাঁচাতে নজর দিন বাতিল হওয়া মোবাইল, কম্পিউটার. ল্যাপটপে
ট্রানজিস্টার কী? আর, সে কাজ করেই বা কীভাবে?
ট্রানজিস্টার হলো এমন এক ডিভাইস যার মধ্যে দিয়ে কোনও একটি যন্ত্রে বিদ্যুৎ পরিবহন বন্ধ করা যায়, আবার চালু করা যায়। বলা যেতে পারে এর কাজ অনেকটা সুইচ বা চাবির মতো। যেকোনও ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের (যেমন- কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদি) ভেতরে সার্কিট বোর্ড থাকে। আর তার মধ্যেই থাকে অসংখ্য ট্রানজিস্টার। আমরা যে মুহূর্তে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রে বৈদুতিন লাইন অথবা ব্যাটারির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ করি, সেই বিদ্যুৎ ওই যন্ত্রে কীভাবে কতটা যাবে সবটাই চালনা করে ট্রানজিস্টার। একটি ট্রানজিস্টার তার মধ্যে থাকা বিদ্যুতের পরিমাণকে বাড়িয়ে বা কমিয়েও দিতে পারে। ঠিক যেভাবে, জলের ট্যাংকের সঙ্গে লাগানো সুইচ বা চাবির সাহায্যে আমরা ট্যাংক থেকে বেরনো জলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
ট্রানজিস্টারগুলি সাধারণত সেমিকন্ডাক্টর নামক কিছু উপাদান থেকে তৈরি করা হয়। সেমিকন্ডাক্টরগুলি হল- সিলিকন, জার্মেনিয়াম-এর মতো বেশ কিছু মেটালয়েড। প্রথম ট্রানজিস্টার, জার্মেনিয়াম দিয়ে তৈরি হয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেশিরভাগ ট্রানজিস্টার সিলিকন দিয়ে তৈরির চল হয়। সেমিকন্ডাক্টরের বৈশিষ্ট্য বিদ্যুৎ পরবাহী বা অপরিবাহী উপাদানগুলির থেকে আলাদা। যেখানে বিদ্যুৎ পরিবাহী ধাতু ঘরের উষ্ণতায় বিদ্যুৎ পরিবহন করে, সেমিকন্ডাক্টর একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার ওপরেই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে। তাই, ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় তাদের কাজের উপযোগী করে তুলতে, উপাদানগুলির কেলাসের মধ্যে বিজাতীয় কোনও পদার্থ খুব কম পরিমাণে যোগ করা হয়। এই ঘটনাকেই ‘ডোপিং’ বলা হয়। সিলিকনে বোরন ও ফসফরাস ডোপিং করে যথাক্রমে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধারযুক্ত সেমিকন্ডাক্টর পাওয়া। তারপর, সেগুলি একে অপরের সঙ্গে জুড়ে তৈরি হয় একটি জংশন। এই জংশনে বিদুৎ সংযোগ করলে জংশনগুলি তার গঠন ও আধার অনুযায়ী বিদ্যুৎকে পরিচালনা করতে পারে। সেমিকন্ডাক্টরে ডোপিং করে তৈরি এই জংশনগুলিই একটি ট্রানজিস্টারের মৌলিক অংশ। আমরা যেসব মোবাইল ব্যবহার করে থাকি তাতে প্রায় কুড়ি লক্ষ ট্রানজিস্টার থাকে। কম্পিউটার, মোবাইলে থাকা এইসব ট্রানজিস্টার আকারে অতি ক্ষুদ্র, বলা ভালো আণুবীক্ষণিক হয়। আধুনিক ট্রানজিস্টার আকারে মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার। আমি, আপনি এই মুহূর্তে যে ল্যাপটপ বা মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখছি তাতে একটি প্রসেসর (চালনাকারী মূল অংশ) রয়েছে। এটা আসলে আর কিছুই নয়, কোটি কোটি ট্রানজিস্টারে ভরা একটি চিপ মাত্র।
ট্রানজিস্টার তৈরির প্রাক্কালে ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তির চেহারা কেমন ছিল?
ট্রানজিস্টার আসার আগে ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তি নির্ভর করত ভ্যাকিউম টিউবের ওপর। এই ভ্যাকিউম টিউব আদতে একটি বায়ুশূন্য গ্লাস বাল্ব। কাঁচের বাল্বটির দুই প্রান্তে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধার যুক্ত করা থাকে। মাঝে একটি গ্রিড বা ঝাঁঝরি থাকে। গ্রিডের আধার ও চরিত্র অদল-বদল করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিদ্যুৎ পরিবহনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ট্রানজিস্টারের তুলনায় ভ্যাকিউম টিউব ব্যবহারের একটি সুবিধা হল যে, এটি বিদ্যুৎ পরিবহনকে অনেক বেশি মাত্রায় বাড়িয়ে দিতে পারে। পৃথিবীর প্রথম ইলেকট্রনিক কম্পিউটার ENIAC, যা ১৯৪৩ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর গবেষণা পরিচালনা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, তাতে ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব ছিল। প্রায় আস্ত একটি হলঘরের সমান জায়গা জুড়ে থাকত সেই কম্পিউটার।
বোঝাই যাচ্ছে, ভ্যাকিউম টিউব দিয়ে কম্পিউটারের মতো আধুনিক ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র চালাতে কতখানি জায়গার প্রয়োজন পড়ত। শুধু তা কেন, ১৯৫১ সালে UNIVAC কম্পিউটার তৈরি হয়, তাতে ভ্যাকিউম টিউবগুলির আকার ছোট হয়ে গেলেও, যন্ত্রটি অন্তত প্রমাণ সাইজ বেডরুমের জায়গা নিত। দাম এতটাই বেশি ছিল যে কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তর কিংবা মাল্টিন্যাশনাল ব্যবসায়িক সংস্থা ছাড়া সে জিনিস কেনার সাধ্য কারও ছিল না । ব্যক্তিগত কম্পিউটারের ধারণাই ছিলনা সেসময়। তাহলে, বরং একটু জেনে নেওয়া যাক ট্রানজিস্টারকে ভর করে বড় বড় সব কম্পিউটার থেকে আজকের মুঠোফোন এল কীভাবে?
আরও পড়ুন - ভয়াবহ সঙ্কটে বাংলার ৮৬% পুরুষ! কোলে ল্যাপটপ রেখে ডেকে আনছেন মারাত্মক ঝুঁকি
ট্রানজিস্টার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কাহিনি
বাজারে আসা প্রথম ট্রানজিস্টার গ্যাজেটটি ছিল ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একটি কানে শোনার যন্ত্র। এর পরেই এসেছিল ট্রানজিস্টার রেডিও, যা ১৯৬০-এর দশক জুড়ে বিনোদন ও জনসংযোগ ব্যবস্থাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। পোর্টেবল ভ্যাকুয়াম টিউব রেডিও ছিল তখন। কিন্তু, ট্রানজিস্টার ছাড়া রেডিও জনপ্রিয় হয়ে উঠত না। ১৯৫৬ সালে এই বৈপ্লবিক আবিষ্কারের জন্য উইলিয়াম শকলি, জন বারডিন, ওয়াল্টার ব্র্যাটেন -এই তিন বিজ্ঞানী পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ট্রানজিস্টারের কল্যাণেই ১৯৭০ ও ৮০ -র দশক থেকে কম্পিউটারের আকার ক্রমশ ছোট হয়, ব্যক্তিগত ব্যবহারের উপযোগী হয়ে ওঠে। আজকাল কম্পিউটারের ভার পেরিয়ে ট্যাব বা স্মার্টফোনেই যাবতীয় ডিজিটাল সুবিধা পেয়ে যাচ্ছি। একবিংশ শতকে দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে স্পেস রকেট সবেতেই ট্রানজিস্টার অপরিহার্য। ভাবা যায়, ট্রানজিস্টার না থাকলে কী হতো! এমন কঠিন কল্পনা এখন থাক। বাজারে যেসব ট্রানজিস্টার পাওয়া যায় তার বেশির ভাগটাই সিলিকন দিয়ে তৈরি। ঠিক এই কারণেই, দেশের ইলেকট্রনিক্স হাবকে সিলিকন ভ্যালি নামে ডাকা হয়।
কিন্তু, এখনও পর্যন্ত যত স্বল্প জায়গায় ট্রানজিস্টার ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরি করা হচ্ছে, সেইটুকু জায়গাতেই আরো বেশি সংখ্যায় ট্রানজিস্টার ব্যবহার করে ভবিষ্যতে আরও দ্রুত ও কার্যকরী যন্ত্রপাতি তৈরি করা কতটা সম্ভব হবে তা নিশ্চিত নয়। বিশ্বজুড়ে আজ হু হু করে বাড়ছে ডিজিটাইজেশন। এর সঙ্গে বাড়ছে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের চাহিদা। বিষয়টি মাথায় রেখে বেশ কিছু গবেষক ট্রানজিস্টারে সিলিকনের ব্যবহার কমিয়ে আনতে চাইছেন। পাশাপাশি, তারা কম বৈদ্যুতিক শক্তি খরচকারি ডিজিটাল যন্ত্র তৈরি করতে চাইছেন। সেই সূত্রে গবেষকদের অনেকেই কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের উপর জোর দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সিলিকনের বদলে কার্বনকে তার নির্দিষ্ট একটি রূপে ব্যবহার করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। তবে কি ভবিষ্যতে পাল্টে যাবে ট্রানজিস্টারের চেহারা? উত্তর লুকিয়ে রয়েছে প্রযুক্তির আরও গবেষণায়।