ওহে শান্ত লক্ষ্মীটি! এবার ওঠো, লড়ো, স্বপ্ন দেখো...
Lakshmi Concept of Woman : লক্ষ্মী যে আদৌ কোনও বন্ধনে আছেন সেই বোধটুকুও নেই! 'চয়েজ' নাম দিয়ে হালফ্যাশনের গিলোটিনে সে খিলখিলিয়ে মাথা রেখে দেয়।
দুর্গার ডান পাশে যে মহিলাটি থাকেন কখনই তাঁর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ জাগেনি। মূর্তি যাঁরা গড়েন, তাঁরা অদ্ভুত এক শিল্পী। মাটির শরীরে আস্ত ধারণাকে প্রাণ দেন। দেন বলেই দুর্গার একই অঙ্গে তেজ ও আশ্রয় ফুটিয়ে তোলেন। সরস্বতীর মধ্যে সেই প্রজ্ঞা, শান্তি কী অবলীলায় ধরা পড়ে যায়। লক্ষ্মীর মধ্যেও ধরা পড়ে, স্থির, ধীর, সংসারী। ধন সম্পদ ও প্রাচুর্যের দেবী। মেটেরিয়ালিস্টিক চাহিদা পূরণের বিশ্বস্ত গন্তব্য। বাস্তবটা ক্ষেপচুরিয়াস রকমের উল্টো! বিয়ে 'করে' ঘরে লক্ষ্মী 'আনতে' হয়। যাকে আনতে হয় তাঁর এমন গরিবগুর্বো দশা যে প্রাচুর্য দূর কী বাত, স্যানিটারি প্যাড কিনতেও বরের কাছে হাত পাততে হয়! সংসারে কোথায় কী খরচা হবে তাঁর সিদ্ধান্তের ধারও ধারে না কেউ। শাসক অবশ্য মাঝেমাঝে লক্ষ্মী সাজেন। তারপর ভাণ্ডার প্রকল্পে ৫০০ টি করে টাকা এই তামাম গরিব লক্ষ্মীদের দেওয়া হয়। মানে, সব লক্ষ্মীই বড়লোক নয়। কোনও কোনও লক্ষ্মী শাসক, কোনও কোনও লক্ষ্মী আজীবন শাসিত। শাসিত লক্ষ্মী সাত চড়ে রা কাড়ে না। কারণ লক্ষ্মী হওয়ার সিভিতে বোল্ড করে লিখে দিতে হয় সর্বংসহা শব্দটি। এই যে অদ্ভুত মহিলা, তাঁকে ভালো লাগবে কীভাবে! লাগেনি, লাগে না।
একবার এক ক্যামেরা শিল্পী একটি অডিশন দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমার ঠোঁট কি একটু বেশিই মোটা? তা সত্য। আমাকে কোনও কুমোরটুলি শিল্পী তো গড়েননি, প্রতি বিসর্জনেও একই ছাঁচে গড়ার কোনও চান্সই নেই! সর্বোপরি অভিনয় ঠোঁট দিয়ে তো করিও না। অভিনয় শিল্পে দেহকে ব্যবহার করতে হয় বলে শিখেছি, অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করতে শিখেছি। দুম করে এই লক্ষ্মী মহিলাটির কথা মনে এল, বাদশা বলে যে ভদ্রলোক র্যাপ করেন তাঁর একটা লাইনও মহাকাল মনে করিয়ে দিল, 'বডি তেরি মাখন জ্যায়সি’! মুকেশ গেয়ে উঠলেন 'চন্দন সা বদন’, নূতন জলের মধ্যে কেঁপে উঠলেন, লক্ষ্মী তাঁর শ্রী নিয়ে উঠে এলেন সম্মুখে। সুরূপা এলেন, ছায়ার মতো এসে, তফাতে দাঁড়িয়ে রইলেন কুরূপা! এবার এই লক্ষ্মীরে আমি কোথায় বসাই!
আরও পড়ুন- মায়ের জাত থেকে মাদারজাত! মাতৃত্ব দিয়ে মেয়েদের আসলে ঘুষই দেওয়া হয়
লক্ষ্মী মেয়ে হওয়ার যে যে ধাপ রয়েছে তাতে একটি করে সামাজিক কালসর্পের বাস। কালসর্প যাতে না কামড়ায় তার জন্য মেপে হাঁটতে হয়, মেপে হাসতে হয় (মোটা ঠোঁট হলে আরও সতর্ক হয়ে হাসতে হয়), সন্ধ্যে নামার আগে বাড়ি ফিরতে হয়, বসের উপর কথা বলতে নেই, দিদি নম্বর ১-এ বিশেষ মিউজিক বাজলে (উফফ কেন যে লেখাতে সঙ্গীত বাজানোর প্রযুক্তিটা আসেনি) 'পুরুষের মতো'ই জীবন কাটানোর গর্বে কাঁদতে হয়, কবিতার বদলে পুরুষরা ব্লাউজের প্রশংসা করলে স্মিত হাসতে হয়, প্রেমিকের মিসোজিনিস্ট জোকে 'হ্যাট' বলে লজ্জা পেতে হয় এবং মাঝেসাঝে মানে ওই ৮ মার্চ বিশেষ করে 'আমি নারী, আমি পারি' লেখা একটা স্টেটাস শেয়ার করতেই হয়, নাহলে রাষ্ট্রপতি ৩ দিনের ফাঁসি আর ৭ দিনের জেল দেন। তা তুমি কী পারো নারী? প্রথম কথা, তোমাকে সব পারতেই হবে এমন কোন আখ্যানে লেখা? দ্বিতীয় কথা, নারী বলে পারতে হবে কেন? লক্ষ্মী ঠাকুরকে কালারিপায়াট্টু দেখাতে বললে পারবে? শিবকে (স্টার জলসার মহালয়ার ওইটা নয়) কফি উইথ করণে র্যাপিড ফায়ার খেলতে বললে পারবে? 'আমি সব পারি' একটি খণ্ড সত্য, আসলে অনেক কিছুই তোমাকে পারতে দেওয়া হয় না। আর লক্ষ্মী সাজার ছদ্ম মাহাত্ম্যে, কেন পারতে দেওয়া হয় না সেই প্রশ্নটিও তুমি করো না।
প্রতিবছর কত কত ছাত্রী স্কুল ও কলেজ পাস করে বেরোন ভারতে? তাঁদের মধ্যে কতজন চাকরি খোঁজেন আর কতজন স্রেফ অন্যের বাড়ির লক্ষ্মী হয়ে যাওয়ার জন্য পার্লারে গিয়ে ঘষামাজা করে প্রস্তুত হন, সেই হিসেব কষলেই বোঝা যাবে মাহাত্ম্যের গোড়ায় কতখানি গলদ। এই ছাত্রীরা সরকারি টাকায় পড়ছেন বা পরিবারের। সরকারিই বেশি। সরকারের টাকা মানে আমাদের টাকা। তারপর এই এত বড় দেশের ওয়ার্কফোর্সে মহিলাদের অংশগ্রহণ দেখলে ট্যাক্স ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস উঠে যাওয়া উচিত। এই যে আমি দেখতে পাচ্ছি, গৃহবধূরা মানে ঘরের লক্ষ্মীদের একাংশ না থাকলে আমি এই বড় বড় কথা কীভাবে লিখতাম লেখা প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে অনেকেই তেড়ে আসছেন। হোমমেকিং এক বিশাল দায়িত্ব নিঃসন্দেহে, কিন্তু গর্বের নয়। যদি এতই গর্বের হতো অ্যাদ্দিনে এই গর্বের কাজ করার জন্য পুরুষদের লাইন পড়ে যেত। গৃহকর্মে নিপুণ হয়ে ওঠার জন্য ছেলেদের হুড়োহুড়ি লেগে যাওয়া উচিত ছিল। গৃহকর্মের সঙ্গে সরাসরি অর্থনীতি জড়িয়ে থাকলেই চাকা অন্যদিকে ঘুরে যেত। আসলে লক্ষ্মী অল্পেই সন্তুষ্ট! ছলছল চোখে আলতো থুতনি ধরে 'তুমি কী করে এত সামলাও মা' বললেই লক্ষ্মী একেবারে বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা। সে নির্বিকার বলে দিতে পারে, আমার ঘর সামলাতে ভালো লাগে। কারণ লক্ষ্মী যে অন্য কিছু সামলাতেও ততটাই দড় তা তো সে জানতেই পারেনি।
আরও পড়ুন- আইনি স্বীকৃতি মিলেছে, ‘ছক্কা’ ডাকা বন্ধ হবে কবে?
সুতরাং যা যা জানতে দেওয়া হয়নি, যা যা পারতে দেওয়া হয়নি, যা যা করলে বাধা এসেছে আমি তা তা করে আমার 'লক্ষ্মীত্ম' খোয়ানোর গর্ব করলেই বিশাল সাম্যবাদী হয়ে যাব। এই যে গত লাইনে ৬ বা 'যা যা' লিখলাম, তা তা করতে গিয়ে আশ্চর্যভাবে এমন কাজই 'অলক্ষ্মীজ' রা করছেন যা আদতে চূড়ান্ত মিসোজিনিস্ট! পুরুষদের যাবতীয় 'কুকাজ' আপন করে নিয়ে 'আমি নারী, আমি পারি'-র সিজন ২ খেলা চলছে। এই সিজন-২ তে সেই সব খেলাই আছে যা খেলিয়ে আসলে পুঁজিপতিদের দিব্য লাভ। এই খেলাতে বঞ্চনাকে প্রশ্ন নেই, সমান মাইনের দাবি নেই, রাজনীতিতে সমান অংশগ্রহণের সওয়াল নেই, পড়াশোনায় সমানাধিকারের লড়াই নেই, হেনস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন নেই। এমনকী এই সিজন ২ তে সব লক্ষ্মীর অংশগ্রহণের সুযোগও নেই। বহিরঙ্গে চিকণ হয়েছে সজ্জা, অন্দরে পলেস্তারা খসা। সেই কালসর্পও মরেনি, লক্ষ্মী 'মাই লাইফ মাই রুলজ-এর নামে আসলে কালসর্প নির্দেশিত সিঁড়িই উঠছে নামছে। সে এই খেলার লক্ষ্মীমন্ত পুতুল মাত্র। চিন্তনে সে অনন্য হয়ে উঠছে কোথায়?
কিছুকাল আগে একটি বিষয় শুরু করেছিলাম কয়েকজন। উড়ান বলে একটি সংগঠন করি ১৮ বছর ধরে। লিঙ্গসাম্য নিয়েই কাজ। বিয়ের আগে আইবুড়োভাত বলে একটি খাবার নষ্টের উৎসব পালিত হয়। কেন খাওয়ানো হয়? কারণ মেয়েটির আইবুড়িত্ব ঘুচতে চলেছে, বিয়ে করে সে আরেকটি জীবন শুরু করবে। তাই সেলিব্রেশন তো মাংতা হ্যায়। অবশ্যই মাংতা হ্যায়। আমি চাকরি শুরু করার পর, অন্য শহরে বাস শুরুর পর আমারও নতুন জীবন শুরু হয়েছিল। মারকাটারি নতুন জীবন, যেমন অনেকেরই হয়। একা একা নিজেকে সামলানোর মহাযজ্ঞ, পিছলে পড়া, লাথ খাওয়া, কান্না, আবার পেটের ভাত জোগাড় করে ১৩ ঘণ্টার চাকরি, বন্ধুহীন-স্বজনহীন শহরে একা একা থাকার মতো নতুন জীবন। ধীরে ধীরে নিজের দেহে ডানা পাওয়ার মতো নতুন জীবন। কেন এই জীবনে প্রবেশের আনন্দে চাকরিভাত খাওয়ানো হয় না? কেন একটি মেয়ের চাকরি পাওয়া পরিবার স্বজনের কাছে ততখানি গর্বের বা উদযাপনের নয়? আমরা কয়েকজন একদিন কবজি ডুবিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে উদযাপন করেছিলাম। অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মেয়ের চাকরি করাকে কতজনই বা গুরুত্ব দেন? ছেলে-বউ চাকরি করলেও সন্ধ্যায় গুষ্টির জন্য চা তো মেয়েরই বানানো কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। সংবেদনশীল স্বামী যদি বা মেলে, স্বজন মেলে না।
আরও পড়ুন- আমার বোনেরও বর্ণমালায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি! ভাষা আন্দোলনে অনুচ্চারিত মেয়েদের কথা
উড়ানের কথাই আবার বলি, অভিজ্ঞতা তো কম হচ্ছে না। একদিন বই টই লিখলে (প্রকাশক টাকা দিয়ে ছাপবেন না যদিও) ১০০০ পাতার উপন্যাস হবে। আসানসোলে আমাদের বইমেলা ছিল ব্যাপক উৎসব। বইমেলার মাঠে গোল করে আড্ডা, গান নাচ ছিল শহরের প্রাণ। আমাদের এক বন্ধু এলেন। গতবছরও গানে গানে নেচে মাঠে সে কী হুল্লোড়। নাচতে বলা হলো তাঁকে, নাচলেন না। কারণ শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে এসেছেন। বাড়ির 'লক্ষ্মী' বউ ধেই ধেই করে মাঠে নাচবে তা তো হয় না। সেই দিদি আর কখনই কোথাও নাচ করেছেন কিনা, বা কিছুই করেছেন কিনা জানি না। অথচ... শ্বশুরকুলকে দু'দণ্ডের শান্তি দিতে গিয়ে হে বনলতা, তোমার নাটোরও ফসকাল, বইমেলাও, এমনকী আস্ত জীবনটাই। যে গরিব লক্ষ্মীদের কথা প্রথমেই বলছিলাম, সেই লক্ষ্মী তো আসলে বিত্তে গরিব নয়। তাঁকে চিন্তনে এতই দৈন্য করে রাখা হয়েছে যে সে পড়েছে মহা দ্বিধায়! একদিকে বন্ধনভঙ্গের টান। কিন্তু বন্ধন কীভাবে ভাঙতে হবে তার চূড়ান্ত পেট্রিয়ার্কাল নজির সিনেমা সিরিজে ধোঁয়া-স্কচ-খিস্তি দিয়ে বাজার তৈরি করে দিয়েছে। অন্যদিকে, লক্ষ্মী যে আদৌ কোনও বন্ধনে আছেন সেই বোধটুকুও নেই! 'চয়েজ' নাম দিয়ে হালফ্যাশনের গিলোটিনে সে খিলখিলিয়ে মাথা রেখে দেয়। সে ভাবে, এমনটাই সে চেয়েছে, চেয়েছে কখন শারুক্ষান এসে তাঁকে তেপান্তর নিয়ে যাবে। নিজ চোখ থাকতেও সে কালো পটি বেঁধে শুনে যাবে সমাজের ধারাভাষ্য। কার 'চয়েজ'-এ সে লুডো খেলছে লক্ষ্মী বোঝেই না।
লক্ষ্মীটি, চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি। দেখো গাজার মানুষ মরে যাচ্ছে, যুদ্ধে মেয়েদের ধর্ষণ করা কেমন নীতি হয়ে যাচ্ছে, দেখো দলিত বলে ধর্ষণ করা কেমন জায়েজ হয়ে যাচ্ছে, দেখো একই চাকরিতে লক্ষ্মী আর কার্তিকের কেমন বেতনের ফারাক, দেখো চাষি-ডাক্তার বললে আজও কেমন পুরুষের ছবিই আমাদের মনে পড়ছে, দেখো রান্নার তেলের বিজ্ঞাপনে আজও পুরুষদের দেখা যায় না অথচ পুরুষদের জাঙিয়াতে মেয়েদের লাগে, কেন লাগে তুমি তো জানো লক্ষ্মী। জানো তো, কীভাবে গ্রামে গ্রামে মহিলাকে আজও পঞ্চায়েত সামলাতে দেওয়া হয় না, প্রোমোশন পেতে গেলে কত কী প্রস্তাব দাঁত কেলিয়ে এড়াতে হয়, জানো তো প্রেমের সম্পর্কে কীভাবে অধস্তন হয়ে থাকা আজও মেয়েদের পছন্দ, মার খেয়ে পাল্টা দিতে না জানায় কী সর্বনাশ হয়, জানো তো। এত সব জেনেও, কী যে খিচুড়ি আর লাবড়াময় সন্ধে কাটিয়ে ফিরে যাও। পাতলা ঠোঁট, চিকণ চুল, সর্বংসহা হতে কেউ বলেনি তোমাকে। ওঠো, লড়ো, সাম্যের স্বপ্ন দেখো। গ্রো আপ লক্ষ্মী।