দশভূজা কুমোরটুলির মেয়েরাও! থিম থেকে সাবেকি, কলকাতা থেকে বিদেশ কাঁপাচ্ছেন মহিলা শিল্পীরাই
Women of Kumartuli: কুমারটুলির মহিলা শিল্পীরা পাল্লা দিচ্ছেন পুরুষ শিল্পীদের সঙ্গে।
বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজোর আর বেশি দেরি নেই। হাতে গোনা কয়েকটা দিনের অপেক্ষার পর মা আসবেন। এই সময়ে তুঙ্গে থাকে প্রতিমা নির্মাণের প্রস্তুতি। কুমোরটুলিজুড়ে এখন একরাশ ব্যস্ততা। গোটা কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের বেশিরভাগই বংশপরম্পরা অনুযায়ী প্রতিমা নির্মাণ করে আসছেন। শত শত পুরুষ শিল্পীর ভিড়ে মহিলা শিল্পীরাও পিছিয়ে নেই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বংশপরম্পরাকে বাঁচিয়ে সংসারের জোয়াল টানছেন যাঁরা, তাঁরাই প্রকৃত অর্থে দশভূজা।পুরুষশাসিত কুমোরটুলির এই অঘোষিত দমনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অনন্য হয়ে উঠেছেন এইসব মহিলা শিল্পীরা। পুরুষশাসিত কুমোরটুলির মানচিত্র ছানবিন করে খুঁজে পাওয়া এই পৃথিবীবিখ্যাত মহিলা শিল্পীরা যেন অচলায়তনের পঞ্চক। যাঁরা এতদিনের বন্ধ উত্তরের জানলা খুলে ফেলেছেন তাঁদের কর্মকৃতির জোরে।
১৭৫৭-র পলাশির যুদ্ধ কলকাতার কর্মসংস্কৃতির খোলনলচে বদলে দিয়েছিলল। গতানুগতিকতার নোনা-ধরা দেওয়ালে নতুন করে রং পড়তে থাকে ইংরেজদের আগমনে। কোম্পানির ডিরেক্টরদের আদেশানুসারে জন জেফানিয়া হলওয়েল কোম্পানির মজুরদের জন্য পৃথক পৃথক অঞ্চল বন্টন করেন। এইভাবে আহির অর্থাৎ পাখির ব্যবসায়ীদের নিয়ে গড়ে ওঠে আহিরিটোলা, কলুদের নিয়ে গড়ে ওঠে কলুটোলা এবং একইভাবে বা মাটির শিল্পীদের নিয়ে গড়ে ওঠে কুমোরটুলি।
পুজোর মাসতিনেক আগে থেকে ব্যস্ততার নিরিখে কুমোরটুলির অন্দরমহলকেও ছাপিয়ে যায় কুমোরটুলি ঘাট। সুন্দরবন, গৌরীপুর থেকে এঁটেল মাটি, খড়বোঝাই লঞ্চ এসে লাগে কুমোরটুলি ঘাটে।বাগবাজার স্টেশন পার হয়ে গঙ্গার ধার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে ডানদিকে বৃহৎ অশ্বত্থ গাছের মতো শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ইতিউতি ছড়িয়ে পড়েছে কুমোরটুলি। মূলত ১ নং, ২ নং, ৩ নং, ৪০ নং বনমালী সরকার স্ট্রিটকেই কুমোরটুলির হৃদপিন্ড বলা যেতে পারে। কুমোরটুলির গলিতে গলিতে প্রতিমা গড়েন মৃৎশিল্পীরা। বাঁশের ওপর খড়ের কাঠামো, তার ওপর মাটির প্রলেপ, তার ওপর রং, সবশেষে মাথার চুল, হাত ও গলার অলংকার, অস্ত্রশস্ত্র- এছাড়া আছে শোলার কাজ, চাঁদমালা, চালচিত্র, সিংহের কেশর, ময়ূরের পাখা, পেঁচার, হাঁসের নানা কারুকাজ, মা দুর্গার হাতের অস্ত্র নানা সাইজের। প্রতিমাকে ঘিরে ছোট্ট ছোট্ট জলধারার মতো নানা বিচিত্র শিল্প ও শিল্পীর জীবিকার স্রোত মোহনার দিকে চলেছে।
আরও পড়ুন: জঙ্গল পরিষ্কার করে শুরু দুর্গাপ্রতিমা বানানো, যেভাবে গড়ে উঠেছে আজকের কুমোরটুলি
শিল্পী মালা পাল
মাধ্যমিকের বইয়ের পাতায় জায়গা করে নেওয়া মালা পালের খ্যাতি জাতীয় স্তরের বেড়া টপকে হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক। মূলত মিনিয়েচার কাজে শ্রেষ্ঠ মালা পাল কুমোরটুলির ছাঁচে তৈরি আঙুলের প্রথা ভেঙে বেরিয়ে এসে নিজের হাতে তৈরি করেন প্রতিমার আঙুল। ১৪ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে হাতেখড়ি হয় ঠাকুর বানানোয়।
শুধু প্রতিমাই নয়, মালা পালের তৈরি বিভিন্ন মাটির অলংকার ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীজুড়ে। থিমের পুজোর চটকদারি থাকলেও প্রাণ রয়েছে সাবেকি প্রতিমার আদলেই। সেখানে দাঁড়িয়ে খোদ কুমোরটুলিই থিমের পথযাত্রী। আর সেখানেই আক্ষেপ শিল্পী মালা পালের। মালা পালের কথায়, শুধু কলকাতায় নয়, তাঁর সাবেকি প্রতিমা ও শিল্পের ম্যাজিকে মজেছেন তাবড় প্রবাসী সমাজ। ওঁর বহুমুখী প্রতিভার আরও একটি নিদর্শন আড়াই প্যাঁচের মূর্তি গড়া। একটি হাতের কাজ, ঠাকুরের কাজ শেখানোর স্কুল তৈরি করেছেন তিনি।যেখানে মূলত তুলে আনা হবে মহিলা শিল্পীদের। বর্তমানে ৩৪ জনকে ঠাকুর তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি।
শিল্পী চায়না পাল
বাবার ছিল মুদির দোকান। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে কাজ শেখা চায়না পালের। চায়না পালের বিশেষত্ব মূলত এক চালির প্রতিমা। 'থিম পুজো না সাবেকি প্রতিমা?' প্রশ্নের উত্তরে চায়না পাল এগিয়ে রাখেন সাবেকি প্রতিমাকেই। বাজারের চাপে বারদুয়েক থিম পুজোর কাজ করলেও তাঁর টান রয়ে গিয়েছে শিকড়েই। কুমোরটুলির হালহকিকত নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই চায়না পালের।নিজের কাজ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাঁর মূল লক্ষ্য।একমাত্র মহিলা শিল্পী হিসেবে চায়না পাল জিতেছেন রাজ্যপালের পুরস্কার। তাঁর শিল্পের বাজার মূলত কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলি। নাগরিক প্রতিমা তৈরি করার চাপে প্রবাসী প্রতিমা তৈরির ফুরসত প্রায় মেলেই না চায়না পালের।
শিল্পী কাঞ্চি পাল
৪০ নং বনমালী সরকার স্ট্রিট যেখানে ১ নং-এ এসে মিশেছে, সেখানেই স্টুডিও আরেক প্রখ্যাত মহিলা শিল্পী কাঞ্চি পালের। কাঞ্চি পালের আশা, ভবিষ্যতে আরও মহিলা শিল্পী আসবেন কুমোরটুলিতে। সাবেকি প্রতিমা তৈরিই তাঁর মূল বিশেষত্ব। বহুদিন পর্যন্ত কুমোরটুলির ট্রেন্ড ছিল মহালয়ার ভোরে চণ্ডীপাঠের মন্ত্র কানে তুলে তবে দুর্গার চক্ষুদানের। কিন্তু পুজোর সংখ্যা যত বেড়েছে, তত চাপ বেড়েছে শিল্পীদের। এই প্রসঙ্গে শিল্পী কাঞ্চি পাল বলেন, "৩৫টা দুর্গার চোখ একদিনে আঁকতে গেলে সমস্যায় পরে যাব। তাই আগে থেকেই কাজ শুরু হয়।"
শিল্পী সুস্মিতা পাল
বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহিলা শিল্পী সুস্মিতা পাল। সম্পর্কে মালা পালের ভাইঝি সুস্মিতার অনবদ্য কাজ এবং স্বীকৃতিই তাঁর কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। সুস্মিতা কুমোরটুলির হাতে গোনা মহিলা শিল্পীদের মধ্যে একজন হয়েও তাঁদের থেকে অনেকখানি আলাদা। ঠাকুর গড়াটা বর্তমানে তাঁর পেশা হলেও সুস্মিতার পড়াশোনা মাস কম নিয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে স্নাতক এবং বারাসাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাঠ নিয়েছেন তিনি। শৈশব থেকে দাদু-বাবা-কাকার স্টুডিওয় কাটিয়েও কেবলমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর সুবাদে তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক বিধিনিষেধ ও অবহেলা। কিন্তু শিল্পীর প্রবল জেদ ও নিষ্ঠার কাছে হার মেনেছে সমাজ।সাংবাদিকতার পাঠ নিয়েও তাই প্যাশন ও রক্তের টানে ফিরে এসেছেন প্রতিমা শিল্পে। রুদ্র পাল বংশের নিজস্ব আর্ট ফর্ম রপ্ত করেছেন। রুদ্র পাল বংশ-র সিগনেচার ফর্ম হলো চক্ষুদানের অভিনবত্ব। যার সঙ্গে টক্করে হার মেনেছেন থিমপুজোর শিল্পীরাও। নতুন প্রজন্মের মহিলা শিল্পী বলতে সুস্মিতা একাই। সরকারের কাছ থেকে তেমন সাহায্য মেলে না। লগ্নি প্রচুর হলেও লাভ সব ক্ষেত্রে হয় না। কাজের দর পাওয়া যায় না সকলের থেকে। এই হতাশায় অনেকেই বংশপরম্পরা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন পেশা খুঁজে নিয়েছেন। স্বভাবতই মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে ছবি আঁকিয়েদের একটা তুলনা মনে এসে যায়। এই প্রসঙ্গে অনিতা অগ্নিহোত্রী তাঁর ‘কলকাতার প্রতিমাশিল্পীরা ‘গ্রন্থে লিখছেন:
আভাসে শোনা যায় মৃৎশিল্পের কৌলীন্য নেই। সে কি ব্যবসায় লাভের অংশ কম বলে? পেন্টিং বা ভাস্কর্যর বিপণনের একটা অন্যতম দিক হল, তার স্থায়িত্ব, যা থেকে নির্মিত হয় তার ঐতিহাসিক মূল্য। নবীন শিল্পী তার ছবিগুলিকে সযত্নে রক্ষা করেন।কিন্তু প্রতিমা শিল্পের অন্তিম পর্যায় হল বিসর্জন। বিসর্জনের ঘটনাটি পূজাবিধির মধ্যেই নিহিত থাকে।অর্থাৎ প্রতিমা শিল্পীর শিল্পকর্মের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করেন অন্য একদল মানুষ -পুরোহিত শ্রেণিরর স্থায়ী আধুনিক প্রতিভূ পুজো কমিটি। অবশ্য বিসর্জন যদি না থাকতো তবে ঠাকুর গড়ার বাজারে নিশ্চয় মন্দা আসত। কারণ নতুন প্রতিমার চাহিদা তৈরি হত না।কিন্তু শিল্পরুপ সংরক্ষিত না হয়ে বিসর্জিত হওয়ার মধ্যে দিয়েই কোথাও গিয়ে শিল্পীর সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পায়।
একক শিল্পীদের ক্ষেত্রে ঋণ পাওয়া যথেষ্ট সমস্যার।বেশি-সংখ্যক শিল্পী যদি কো-অপারেটিভ করে সংগঠিত হন, ব্যাঙ্ক সেই সমবায় সমিতিকে ঋণ দিতে পারে। এক্ষেত্রে সেই সমবায় সমিতির কাজ হলো, কোন শিল্পী কত ঋণ নেবেন,তার পরিশোধ ক্ষমতা কত ইত্যাদি বিবেচনা করে ঋণের অঙ্ক প্রস্তাব-সহ সুপারিশ করা। এখানেই সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন।
দলগতভাবে ঋণ নেওয়ার নানা অসুবিধা থাকায় এবং অন্যান্য নানাভাবে লগ্নি না হওয়ায় কুমোরটুলিতে নতুনভাবে কোনও কর্মী তৈরি হচ্ছে না, এমনটাই মনে করেন সুস্মিতা। ছোট মডেল গড়তে হাতের নৈপুণ্য লাগে। প্রতিমা গড়তে লাগে নৈপুণ্য ছাড়াও প্রয়োজন শারীরিক শক্তি। কাঠামোর কাজ, বিশেষ করে খড় বাঁধতে হাতের জোর লাগে যথেষ্ট। মেয়েদের দৈহিক শক্তি তুলনামূলকভাবে ভারী কাজে কম হলেও সকল প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে এইসব মেয়েরা নিজেদের কাজকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন সর্বত্র। মাটির কাজের পৃথিবীতে প্রতিমার মুখ তাঁদের মুখচ্ছবি আড়াল করে রাখে।
গ্রন্থ ঋণ:
কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, অনিতা অগ্নিহোত্রী, আনন্দ পাবলিশার্স