কুস্তিও করতেন উনিশ শতকের মহিলারা! কীভাবে খোয়া গেল বাঙালি মেয়েদের অধিকার?
মাথায় রাখতে হবে, উপনিবেশ মহিলাদের সম্পত্তি, রোজগার আর ব্যবস্থাপনার অধিকার কেড়ে অধমর্ণ বানিয়ে দিল।
উপনিবেশপূর্ব, উপনিবেশের প্রথম সময়ের বাংলার মহিলারা কি একেবারেই অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন? অন্তত অষ্টাদশ শতকে বাংলার জনপরিসরে মন্দিরের গায়ের ছবি, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (না কি গণহত্যা), বাংলার বিশিল্পায়ন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর প্রায় আড়াই দশক পরে একটি সংবাদপত্রে চরকা কাটনির চিঠির বয়ান এই তত্ত্ব সমর্থন করে না। আজ আমরা স্পষ্টভাবে আমরা বলতে পারি, উপনিবেশের কালে, সরকারি স্তরে জোর খাটিয়ে ভদ্রবিত্ত বাড়ির মেয়েদের অন্তঃপুরে বন্ধ করার আগের প্রত্ন-নিদর্শন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা ছবিগুলো এবং প্রবন্ধ-শেষে চরকা কাটনির আকুতিভরা চিঠি। কোথাও ইটিন্ডায়, কোথাও কোতুলপুরে মন্দিরের গায়ে কাজ করা মেয়েদের ছবি আমাদের প্রায় ভুলে যাওয়া সময়কে মনে পড়িয়ে দেয়। বিশেষত, ঠাকুরবাড়ির পক্ষ থেকে ঘটা করে অন্তঃপুরবাসিনীকে প্রকাশ্যে বের করার ঘটনা আজকেও নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ঘটনারূপে চিহ্নিত হয়। তো এই ঘটনার পাঁচ দশক আগে 'সমাচার চন্দ্রিকা'-য় চিঠি, বা অষ্টাদশ, উনবিংশ শতকের মন্দিরের গায়ের মহিলাদের কর্মকাণ্ডের ছবি আমাদের অন্য ইতিহাসের দিকে নজর ঘোরাতে বাধ্য করে।
মহিলাদের কুস্তির ছবির মন্দিরটি বীরভূম জেলার একদা বর্ধিষ্ণু গ্রাম ইটিন্ডায় অবস্থিত। রীতিতে জোড়বাংলা মন্দির। কোনও স্থায়ী বিগ্রহ নেই। কালীপুজোর সময় কালীর মৃন্ময়ী রূপ প্রতিষ্ঠা করে পুজো করা হয়। বেশ কিছু অনন্যসাধারণ প্যানেল থাকলেও এই প্যানেলটি বেশ উল্লেখযোগ্য বলে আমার মনে হয়েছে। এখানে দুই মহিলা কুস্তিগিরের কুস্তির দৃশ্য দেখানো হয়েছে। একসময় নাকি অজয় নদ এই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো। আর অজয়ের হাত ধরেই ব্যবসা-বাণিজ্য, আর তাতেই এসেছিল এই গ্রামের সমৃদ্ধি। আজকের মরা অজয় নয়, তখন রীতিমতো নাব্যতা ছিল অজয়ের। অষ্টাদশ শতকের এই মন্দির আজও হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। বাঙালি মেয়েরাও যে শরীরচর্চাতেও কোনও অংশে কম ছিলেন না, তার প্রমাণ এই মন্দিরগাত্রে। পাঠকরা তো অতীব আগ্রহে WWE Women's Championship দেখেন, কিন্তু সেই একই দৃশ্য চিত্রায়িত বাংলার মন্দিরগাত্রে, তা কি আপনাদের নজরে আসবে না? তাছাড়া শরীরচর্চাতে নারীর কাজ কোতুলপুরে ভদ্র পরিবারের পঞ্চরত্ন শ্রীধর মন্দিরগাত্রে দেখতে পাই। এসবই প্রায় অজানা বাংলার অজানা নারীকে আমাদের সামনে তুলে ধরে।
উপনিবেশপূর্ব সময়ে বাংলার মহিলা কারিগরদের পুরুষ কারিগর-নিরপেক্ষ রোজগারের একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় এই প্রবন্ধে তুলে ধরছি। 'সমাচার চন্দ্রিকা', ৫ জানুয়ারি ১৮২৮, ২২ পৌষ ১২৩৪এর পত্রিকায় প্রকাশিত শান্তিপুরের এক কাটনির চিঠি আপনাদের অবগতির জন্য উল্লেখ করতেই হবে। চিঠি লেখা কাটুনি মহিলা পেশাদার সুতো-কাটিয়ে নন, তিনি আতান্তরে পড়ে চরকা কাটা শিখেছেন। সেই স্বশিক্ষিত বিধবা কাটুনি, চরকা কাটার রোজগারে তিন মেয়ের বিয়ে, শ্বশুরের শ্রাদ্ধ দিয়েছেন যতটা পারা যায় ঘটা করে, “রাঁড়ের মেয়্যে বলিয়া কেহ ঘৃনা করিতে পারে নাই।" মাথায় রাখবেন, 'সমাচার চন্দ্রিকা'-র সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রামমোহন রায়ের সঙ্গে বিবাদে 'সমাচার কৌমুদী' ছেড়ে এই পত্রিকার সম্পাদক হন। এই পত্রিকায় ব্রিটিশ কোম্পানির শাসনাধীন বাংলার অর্থনৈতিক গতি বিষয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং চিঠি প্রকাশ পায়। এই চিঠির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়েই আমরা নজর দেব মহিলাদের রোজগার বিষয়ে।
আরও পড়ুন: আসলে কলকাতার বয়স কত? যে ইতিহাস ছিল আড়ালে
“শ্রীযুত সমাচার পত্রকার মহাশয়। আমি স্ত্রীলোক অনেক দুঃখ পাইয়া এক পত্র প্রস্তুত করিয়া পাঠাইতেছি আপনারা দয়া করিয়া আপনারদিগের আপন ২ সমাচারপত্রে প্রকাশ করিবেন শুনিয়াছি ইহা প্রকাশ হইলে দুঃখ নিবারণকর্ত্তারদিগের কর্ণগোচর হইতে পারিবেক তাহা হইলে আমার মনস্কামনা সিদ্ধ হইবেক অতয়েব আপনারা আমার এই দরখাস্তপত্র দুঃখিনী স্ত্রীর লেখা জানিয়া হেয়জ্ঞান করিবেন না।
আমি নিতান্ত অভাগিনী আমার দুঃখের কথা তাবৎ লিখিতে হইলে অনেক কথা লিখিতে হয়। কিন্তু কিছু লিখি যখন আমার সাড়ে পাঁচ গণ্ডা বয়স তখন বিধবা হইয়াছি কেবল তিন কন্যা সন্তান হইয়াছিল। বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি আর ঐ তিনটি কন্যা প্রতিপালনের কোন উপায় রাখিয়া স্বামি মরেন নাই তিনি নানা ব্যবসায়ে কাল যাপন করিতেন আমার গায়ে যে অলঙ্কার ছিল তা বিক্রয় করিয়া তাঁহার শ্রাদ্ধ করিয়াছিলাম শেষে অনাভাবে কএক প্রাণী মারা পড়িবার প্রকরণ উপস্থিত হইল তখন বিধাতা আমাকে এমত বুদ্ধি দিলেন যে জাহাতে আমারদিগের প্রাণ রক্ষা হইতে পারে অর্থাৎ আসনা ও চরকায় সুতা কাটিতে আরম্ভ করিলাম প্রাতঃকালে গৃহকর্ম্ম অর্থাৎ পাটি ঝাট্টি করিয়া চরকা লইয়া বসিতাম বেলা দুই প্রহর পর্য্যন্ত কাটনা কাটিতাম প্রায় এক তোলা সুতা কাটিয়া স্নানে যাইতাম স্নান করিয়া রন্ধন করিয়া শ্বশুর শাশুড়ি আর তিন কন্যাকে ভোজন করাইয়া পরে আমি কিছু খাইয়া সরু টেকো লইয়া আসনা সূতা কাটিতাম তাহাও প্রায় এক তোলা আন্দাজ কাটিয়া উঠিতাম এইপ্রকার সূতা কাটিয়া তাঁতিরা বাটীতে আসিয়া টাকায় তিন তোলার দরে চরকার সূতা আর দেড় তোলার দরে সরু আসনা সূতা লইয়া যাইত এবং যত টাকা আগামি চাহিতাম তৎক্ষণাৎ দিত ইহাতে আমাদের অন্ন বস্ত্রের কোন উদবেগ ছিল না পরে ক্রমে ২ ঐ কর্ম্মে বড়ই নিপুন হইলাম কএক বৎসরের মধ্যে আমার হাতে সাত গণ্ডা টাকা হইল এক কন্যার বিবাহ দিলাম ঐ প্রকারে তিন কন্যার বিবাহ দিলাম তাহাতে কুটুম্বতার যে ধারা আছে তাহার কিছু অন্যথা হইল না রাঁড়ের মেয়্যে বলিয়া কেহ ঘৃনা করিতে পারে নাই কেননা ঘটক কুলীনকে যাহা দিতে হয় সকলি করিয়াছি ততপরে শ্বশুরের কাল হইল তাঁহার শ্রাদ্ধে এগার গণ্ডা টাকা খরচ করি তাহা তাঁতিরা আমাকে কর্জ্জ দিয়াছিল দেড় বৎসরের মধ্যে তাহা শোধ দিলাম কেবল চরকার প্রাসাদাৎ এত পর্য্যন্ত হইয়া ছিল এক্ষনে তিন বৎসরাব্ধি দুই শাশুড়ি বধূর অন্নাভাব হইয়াছে সূতা কিনিতে তাঁতি বাটীতে আসা দূরে থাকুক হাটে পাঠাইলে পুর্ব্বাপেক্ষা সিকি দরেও লয় না ইহার কারন কি কিছুই বুঝিতে পারি না অনেক লোককে জিজ্ঞাসা করিয়াছি অনেকে কহে যে বিলাতি সূতা বিস্তর আমদানি হইতেছে সেই সকল সূতা তাঁতিরা কিনিয়া কাপড় বুনে। আমার মনে অহঙ্কার ছিল যে আমার যেমন সূতা এমন কখন বিলাতি সূতা হইবেক না পরে বিলাতি সূতা আনাইয়া দেখিলাম আমার সূতা হইতে ভাল বটে তাঁহার দর শুনিলাম ৩।৪ টাকা করয়া সের আমি কপালে ঘা মারিয়া কহিলাম হা বিধাতা আমা হইতে দুখিনি আর আছে পুর্ব্বে বিলাতে তাবৎ লোক বড় মানুষ বাঙ্গালি সব কাঙ্গালী এক্ষণে বুঝিলাম আমা হইতেও সেখানে কাঙ্গালিনী আছে কেননা তাঁহারা যে দুঃখ করিয়া এই সূতা প্রস্তুত করিয়াছে সে দুঃখ আমি বিলক্ষণ জানিতে পারিয়াছি এমত দুঃখের সামগ্রী সেখানকার হাটে বাজারে বিক্রয় হইল না একারণ এ দেশে পাঠাইয়াছেন এখানেও যদি উত্তম দরে বিক্রয় হইত তবে ক্ষতি ছিল না তাহা না হইয়া কেবল আমারদিগের সর্ব্বনাশ হইয়াছে সে সূতায় যত বস্ত্রাদি হয় তাহা লোকে দুই মাসও ভালরূপে ব্যবহার করিতে পারে না গলিয়া যায় অতয়েব সেখনাকার কাটনিদিগকে মিনতি করিয়া বলিতেছি যে আমার এই দরখাস্ত বিবেচনা করিলে এদেশে সূতা পাঠান উচিত কি অনুচিত জানিতে পারিবেন। শান্তিপুর কোন দুঃখিনী সূতা কাটনির দরখাস্ত।"
মাথায় রাখতে হবে, উপনিবেশ মহিলাদের সম্পত্তি, রোজগার আর ব্যবস্থাপনার অধিকার কেড়ে অধমর্ণ বানিয়ে দিল। দেশ, সমাজে মহিলাদের জন্য যতটুকু ফাঁকফোকর ছিল, সেসব কেড়ে নিয়ে, স্তরে স্তরে অধিকারগুলো ছিন্ন করে সমাজ হয়ে উঠল চরমতম পিতৃতান্ত্রিক। ব্রিটিশ শাসকরা বাংলায় আসার আগে বাংলার মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার ছিল, বিশেষ করে বিধবাদের তো বটেই, বিবাহিত মহিলাদের অনেক সম্পত্তিতে পুরুষের হক ছিল না- আশ্চর্যের এই বিধানগুলো মনুস্মৃতি-অনুসারী- সেই সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নিল উপনিবেশ; এই প্রসঙ্গে পাঞ্জাবের প্রেক্ষিতে তিনটি বই বীণা তলোয়ারের 'ডাউরি মার্ডার', নীলাদ্রি ভট্টার 'দ্য গ্রেট এগ্রারিয়ান কনকুয়েস্ট', দেবোত্তম চক্রবর্তীর 'বিদ্যাসাগর নির্মাণ, বিনির্মান পুনর্নির্মানের আখ্যান' পড়া যেতে পারে। রানি ভবানী, দেবী চৌধুরাণীরা ছিলেন সমাজের ব্যবস্থাপক, জমিদার, আজকের ভাষায় সিইও। সেই ভূমিকাটাও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পরে কেড়ে নেওয়া হল। উপনিবশে মহিলাদের শুধু সম্পত্তির অধিকার গেল না, প্রকাশ্যে খেলাধুলোর অধিকার, উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশীদারির অধিকার, অর্থাৎ চরকা কাটা কেড়ে নিয়ে অন্যান্য কারিগরি থেকে রোজগার ধ্বংস করে তাদের বেরোজগার করে দেওয়া হল। ছিয়াত্তরের গণহত্যা, '৯৩-এর সম্পত্তির অধিকার হ্রাস অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, চলতে থাকা বিপুল বিশিল্পায়ন, তাঁতিদের উচ্ছেদ ইত্যাদির পরেও ১৮০৮-এর হ্যামিলটন বুকানন পাটনা, যেটা খুব বড় কাপড় উৎপাদনের এলাকা ছিল না, ৩ লক্ষ কাটনি দেখছেন! তাহলে পূর্ণ উৎপাদনের সময়ে ঢাকা, শান্তিপুর, কাশিমবাজার ইত্যাদি বাংলার হাজারও এলাকায় কত মহিলা চরকা কাটত? চরকা কাটা ছিল জাতপাতহীন একটি কারিগরি।
আগেই বলেছি, উপনিবেশপূর্ব সময়ে বাংলায় বহু মহিলা জমিদার ছিল, গৃহস্থ মহিলারা অধিকাংশ রোজগেরে ছিলেন, কারণ সুতো কাটা সমাজের সব স্তরের মহিলাই করতেন। এবং তাঁদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অর্থাৎ, তাঁরা সামাজিক সম্পত্তি বিকাশ, ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা করতেন, সেটাও কেড়ে নেওয়া হলো। আমরা দেখলাম, উপনিবেশ শুধু মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার কাড়ল না, তাঁর সামাজিক অংশগ্রহণ, দক্ষতা ব্যবহার করে রোজগার এবং তাঁর প্রশাসনিক ভূমিকা ধ্বংস হয়ে গেল।
উপনিবেশে কয়েক হাজার বছরের উত্তমর্ণ বাংলা অধমর্ণ হল।
কুস্তির ছবি: শুভদীপ সান্যাল
শরীরচর্চায় নারীর ছবি: বিপ্লব বরাট