প্রথম ম্যাচে হেরেও বিশ্বজয়! কেন রূপকথাকেও হার মানাবে মেসিদের এই যাত্রা?
World Cup Champion Argentina 2022: ইনফান্তিনোর হাত থেকে বিশ্বকাপ নিয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মেসি। আস্তে আস্তে ট্রফি হাতে নিয়ে এগিয়ে যান দলের দিকে এবং তারপর...
"মেসি ক্লাবের যতটা, দেশের ততটা নয়", "মেসির ইন্টারন্যাশনাল ট্রফি নেই", "মেসি কোনওদিনও মারাদোনা হতে পারবে না"- এই ধরনের যাবতীয় বিতর্ক থেমে গিয়েছে রবিবারের রাতে। চিরদিনের জন্য থেমে গিয়েছে। বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছেন মেসি। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। তখন হেরেছিল ‘মেসির আর্জেন্টিনা’। আর রবিবার জিতল আর্জেন্টিনা, জিতল মেসি, ডি'মারিয়া, আলভারেজ, এমিলিয়ানো মার্তিনেজের আর্জেন্টিনা। জিতল কোচ লিওনেল স্কালোনির আর্জেন্টিনা।
২০১৪ সালে হিগুয়েনের গোল মিসের পর মারিও গোর্তজের গোলে স্বপ্নভঙ্গ। ২০১৮ বিশ্বকাপে দশাসই পারফরমেন্স। শেষ ষোলো থেকে বিদায়ের পর মেসির সেই শূন্যদৃষ্টি আজ অতীত। সমস্ত তাচ্ছিল্য, অপমান, শোকের এবার সমাপ্তি। ৭ বারের ব্যালন ডি’অর জিতেও যেন সবটা জিতে ওঠা যাচ্ছিল না মেসির। কিন্তু রবিবাসরীয় মহারণে ফ্রান্সকে হারিয়ে আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের পর আর কোনও অপ্রাপ্তি রইল না লিওনেল মেসির। মারাদোনার সেই দৈবত্বকেও স্পর্শ করে ফেললেন তিনি। দিনের শেষে তিনিই হয়ে উঠলেন গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম, ‘গোট’। এবার থেকে তাঁর নাম উচ্চারিত হবে পেলে-মারাদোনাদের সঙ্গে। ৩৬ বছর পর মেসির হাত ধরেই শাপমুক্তি হল আর্জেন্টিনার।
তবে এই ঐতিহাসিক, মহাকাব্যিক পরিসমাপ্তিকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে একটি মহাকাব্যিক ম্যাচও। ইনফান্তিনো বলেছিলেন, এটি একটি দারুণ বিশ্বকাপ হবে। সমগ্র বিশ্বকাপ জুড়ে উঠে আসছিল বিভিন্ন অভিযোগ। রেফারিংয়ের মান খারাপ, স্টেডিয়াম বাজে- সব অভিযোগ দূরে সরিয়ে কাতার উপহার দিল বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বশেষ্ঠ ফাইনাল। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা। ম্যাচের প্রথম থেকেই একটা বিষয় স্পষ্ট, আর্জেন্টিনা জিততে চায় লিওনেল মেসির জন্য। মেসি বলে দিয়েছেন, এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু প্রতিপক্ষ যে ফ্রান্স! ফ্রান্সের আক্রমণ ভাগ অলিভার জিরু, কিলিয়ন এমবাপে, গ্রিজম্যান সম্বলিত এক অশ্বমেধের ঘোড়া। ফাইনালের আগে অনেকেরই চিন্তা ছিল এই আক্রমণকে আটকাবে কী করে আর্জেন্টিনা! এর আগে নেদারল্যান্ডস ম্যাচে কিছুটা হলেও খেই হারিয়ে ফেলেছিল আর্জেন্টিনার ডিফেন্স। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে যদিও তাদের ছন্দ ছিল ভালোই। কিন্তু আর্জেন্টাইন ডিফেন্সের সবচেয়ে সেরা খেলাটা বেরিয়ে এল ফাইনালে। প্রথমার্ধে ফ্রান্সকে চলতেই দিল না নীল-সাদা বিগ্রেড। কী জিরু, কী এমবাপে- সকলে আটকে গেলেন আর্জেন্টিনার অব্যর্থ ডিফেন্সের সামনে। এনজো ফারনান্ডেজ, রদ্রিগো ডি'পলরা মাঝমাঠ থেকেই রুখে দিলেন ফ্রেঞ্চ আর্মিকে। ২৩ মিনিটের মাথায় ডি'মারিয়াকে বক্সে ফাউল করায় পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। সেখান থেকে দলকে এগিয়ে দেন মেসি। ৩৬ মিনিটের মাথায় ব্যবধান আরও বাড়ান ডি'মারিয়া।
আরও পড়ুন- সেনাপতি মেসি, সঙ্গে বিশ্বস্ত মার্তিনেজ, যে মন্ত্রে ফাইনালে স্বপ্নপূরণ আর্জেন্টিনার
সকলেই ভাবছিলেন মেসি আর আলভারেজের কথা। আউট অব সিলেবাস এলেন ডি'মারিয়া। দ্বিতীয়ার্ধেও চলল নীল সাদা ঝড়। ম্যাচে প্রথম ৭০ মিনিট দাপট দেখাল আর্জেন্টিনা। তবে ফ্রান্সকে পুনঃরুজ্জীবিত করলেন কিলিয়ন এমবাপে। ম্যাচের বয়স তখন ৮০ মিনিট। পেনাল্টি থেকে একটি গোল শোধ করলেন এমবাপে। মাত্র এক মিনিট পর কোমানের পাস থেকেও আরও একটি গোল পিএসজি স্ট্রাইকারের। আর তাতেই সমতায় ফেরে ফ্রান্স। আসলে ডি মারিয়াকে তুলে নেওয়ায় খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে আর্জেন্টিনার ডিফেন্স ও সাপ্লাই লাইন। সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এমবাপে। আর ইনজুরি টাইমে মেসির নিশ্চিত গোল আটকে দিয়ে খেলা এক্সট্রা টাইমে নিয়ে গেলেন হুগো লরিস। তিনি তেকাঠির নিচে দাঁড়িয়ে ফ্রেঞ্চ দূর্গ না সামলালে ৯০ মিনিটেই বিশ্বজয় করতেই পারতেন মেসিরা।
এক্সট্রা টাইমে ১০৮ মিনিটের মাথায় ফের গোল করে দলকে এগিয়ে দেন লিও মেসি। সকলে যখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখনও একা দমে লড়ে গেলেন এমবাপে। তখনও গতবারের চ্যাম্পিয়নদের স্বপ্নভঙ্গ হতে দেননি এমবাপে। ১১৮ মিনিটের ঠান্ডা মাথায় পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ফের লড়াইয়ে ফিরিয়ে আনেন এমবাপে। আর সেই সঙ্গে কনিষ্ঠতম তারকা হিসেবে ফাইনালে হ্যাটট্রিকের নজির গড়লেন তিনি। একই সঙ্গে এমবাপে প্রমাণ করে দিলেন মেসি-রোনাল্ডো পরবর্তী সময়ে কেন তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার। এরপর খেলা গড়াল পেনাল্টি শুট আউটে।
এখানে গর্জে উঠলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। মাথা ঠান্ডা রেখে অসামান্য গোলকিপিং করলেন তিনি। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধেও তাঁর এই অসামান্য দক্ষতা আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে পৌঁছে দিয়েছিল এবং রবিবার বিশ্বকাপ জেতাল। স্বভাবতই টুর্নামেন্টে গোল্ডেন গ্লাভস পেলেন তিনি। এই খেলায় প্রথমে দুই গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। এরপর দুই গোল শোধ করে ফ্রান্স। একটা টাইমে ফের এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা এবং ১০ মিনিটের মাথায় গোল শোধ করে ফ্রান্স। অবশেষে পেনাল্টি শুট-আউট জিতে বিশ্বকাপ ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা। এই যদি ফুটবল বিশ্বে ঈশ্বরের তৈরি চিত্রনাট্য হয়, তবে এর চেয়ে সুন্দর চিত্রনাট্য আর হতে পারে না।
ম্যাচের শেষে গোটা টিমের চোখে জল। কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা বিশ্বকাপ জিতেছেন। গত বিশ্বকাপেও দর্শক আসনে বসেছিলেন আর্জেন্টিনার অতীন্দ্র প্রহরী এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। আজ তিনিই বিশ্বজয়ের নায়ক। টুর্নামেন্টে গোল্ডেন বুট পেয়েও বিন্দুমাত্র হাসি দেখা গেল না কিলিয়ন এমবাপের মুখে। টানা দু’বার বিশ্বজয়ের সুযোগ এত কাছে এসেও হাতছাড়া হলো তাঁর। তবে মেসির আবেগ ছিল চোখে পড়ার মতো। গোল্ডেন বল পাওয়ার পর যখন বিশ্বকাপকে চুমু খেলেন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল গোটা স্টেডিয়াম। ইনফান্তিনোর হাত থেকে বিশ্বকাপ নিয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মেসি। আস্তে আস্তে ট্রফি হাতে নিয়ে এগিয়ে যান দলের দিকে এবং তারপর...