৬ বছর বয়সে জেতার জন্যে জানলা ভেঙেছিলেন, কাপটা দেখতে পাচ্ছেন মেসি
World Cup Football Final 2022: খেলার অতিরিক্ত সময়ে ১১৩ মিনিটের মাথায় জার্মান ফরওয়ার্ড মারিও গোটজের গোলে যখন বিশ্বজয় করল জার্মানি, সোনার ট্রফির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ছিলেন মেসি।
আর বাকি মাত্র একটা ধাপ! আর্জেন্টিনার অনেক সমর্থকই হয়তো বিশ্বাস করতে পারছেন না, আর মাত্র একটা ধাপ পেরোলেই লিওনেল মেসি ছুঁয়ে ফেলবেন দিয়েগো মারাদোনাকে। আর্জেন্টিনা এখন বিশ্বকাপের ফাইনালে! লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি, ৩৬ বছর পর শিরোপা জয় করে প্রয়াত ফুটবল-ঈশ্বর দিয়েগো মারাদোনাকে নিজেদের তৃতীয় বিশ্বজয়ের স্মারক উৎসর্গ করতে আর্জেন্টিনাকে পেরোতে হবে আর মাত্র একটা ধাপ। আর এই ধাপ পেরোতে পারলেই, মারাদোনার সঙ্গে মিশে গিয়ে চিরন্তন হয়ে যাবেন রোজারিওর গলি থেকে উঠে আসা মেসি।
গতকালের ম্যাচের শুরুটা খুব একটা ভালো ছিল না। প্রথম থেকেই বল পজিশন ধরে রেখেছিল ক্রোয়েশিয়া। ফলে বল পায়ে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন মেসিরা। কিন্তু হঠাৎ কোনও এক জাদুকরের নির্দেশে যেন পুরো খেলার রূপ বদলে গেল। বল নিয়ে ছুটতে শুরু করলেন জুলিয়ান আলভারেজ। তার কাঁধে ভর করেই ক্রোয়েশিয়ার কাঁটা তুলে ফেলল আর্জেন্টিনা। আলভারেজ যেন ছুটছেন তো ছুটছেনই! এই ২২ বছর বয়সী তরুণ যেন ছুটছেন শুধুমাত্র মেসি এবং মারাদোনার জন্য। আর্জেন্টাইনদের ৩৬ বছরের অপেক্ষা দূর করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন এই ২২ বছর বয়সী তরুণ। তাঁর দৌড় দেখে মনে হচ্ছিল, সামনে যদি দেওয়ালও রেখে দেওয়া যায়, তিনি সেটাও ভেঙে বেরিয়ে যাবেন।
একসময় সেই দৌড় থামল। ততক্ষণে আর্জেন্টিনা পৌঁছে গিয়েছে বিশ্বকাপের ফাইনালে। তবে আলভারেজের দ্বিতীয় গোলটিতে শুধুমাত্র তিনি একা নন, প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার হৃদস্পন্দন লিওনেল মেসি। যে অ্যাসিস্ট তিনি করলেন, সেই দৃশ্য দেখতে দেখতেই যেন কাটিয়ে দেওয়া যায় অনন্তকাল। আর মেসির স্বপ্নের ট্রফিও এখন শুধুমাত্র তাঁর স্পর্শ পাওয়ার অপেক্ষায়।
আরও পড়ুন- প্রথম বিশ্বকাপেই আগুন ঝরাচ্ছেন ২২ বছরের আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার! কে এই জুলিয়ান আলভারেজ?
এই গল্প শুরু হয়েছিল অনেক আগে। রোজারিওর রাস্তা ছেড়ে যুব ফুটবলে সেদিন প্রথম ফাইনাল খেলতে নেমেছিলেন লিওনেল মেসি। জিততে পারলে পুরস্কার ছিল স্বপ্নের বাইসাইকেল। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা। ম্যাচ শুরুর আগেই বাথরুমে আটকে পড়েন ছোট্ট মেসি। তখন তাঁর বয়স মাত্র ছয় বছর। সেই অবস্থায় কী করবেন তিনি বুঝতে পারছেন না। অনেককে ডাকাডাকি করলেন, কিন্তু কেউ শুনল না তাঁর ডাক। ম্যাচ তখন শুরু হয় হয় অবস্থা। অগত্যা বাথরুমের জানালা ভেঙে বের হয়ে এলেন মেসি। ঝড়, তুফান কিংবা টর্নেডো কিছুই সেদিন মেসিকে আটকাতে পারেনি। মাঠে নেমে করলেন হ্যাটট্রিক। আর হাতে পেলেন কাঙ্খিত বাইসাইকেলটিও।
বড় হতে হতে সেই বাইসাইকেলের স্বপ্ন পরিবর্তিত হয়ে গেল সোনালি ট্রফিতে। ততদিনে মেসি হয়ে উঠেছেন বিশ্ব তারকা। ইউরোপের ক্লাব লিগগুলির শেষ কথা। কিন্তু এই সোনালি ট্রফির জন্য জীবনের সমস্ত অর্জনকেও ফিরিয়ে দিতে রাজি ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠেও শিরোপা ছুঁতে না পারার বেদনা অনেক অনেক রাত মেসিকে ঘুমোতে দেয়নি। খেলার অতিরিক্ত সময়ে ১১৩ মিনিটের মাথায় জার্মান ফরওয়ার্ড মারিও গোটজের গোলে যখন বিশ্বজয় করল জার্মানি, সোনার ট্রফির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ছিলেন মেসি। সেই দৃশ্য হয়তো এখনও মেসির বুকে শেলের মতো বেঁধে। সেই মুহূর্তটি মেসির কাছে ফিরে এসেছে বারবার। ফিরে এসেছে দুঃস্বপ্ন হয়ে। সেদিন শুধু মেসি নয়, শিরোপা ছুঁতে না পারার যন্ত্রণায় শতশত আর্জেন্টাইনের রাতের ঘুম নষ্ট হয়েছিল। এদের মধ্যেই হয়তো অনেকে নিজেদের সর্বস্ব বাজি রেখে কাতারে এসেছেন শুধুমাত্র বিশ্বকাপ মেসির হাতে দেখবেন বলে। মেসির সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়া থেকে আর মাত্র একটি ধাপ পেরনোর অপেক্ষায়।
তবে ফুটবলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার সম্পর্ক বহু যুগ ধরে। আর্জেন্টিনার বিখ্যাত লেখক মাসিডোনিয়া ফার্নান্দেজ তাঁর 'অ্যান আর্জেন্টাইনস হেভেন' গল্পে লিখেছিলেন, কয়েকজন বন্ধু একদিন বারবিকিউ পার্টিতে জড়ো হয়ে ফুটবল নিয়ে আলাপ করতে করতে হঠাৎ লক্ষ্য করল, তাঁরা সবাই মারা গেছে। তবে আকস্মিক মৃত্যুর এই ঘটনা তাঁদের সবাইকে বিপুল আনন্দ দিয়েছে, কারণ তাঁদের বিশ্বাস, যদি কোনও মানুষ পোড়া মাংস খেতে খেতে ফুটবল নিয়ে আলোচনা করে তাহলে তাঁরা স্বর্গেই যাবে।
আজ হয়তো মেসির খেলা মাসিডোনিয়োর সঙ্গে স্বর্গে বসে উপভোগ করছেন মৃত মানুষরাও। মাসিডোনিয়ার এই গল্পই দেখিয়ে দেয়, আর্জেন্টাইনদের সঙ্গে ফুটবলের ভালোবাসা কতটা গভীর। ক্যাম্পেস, মারাদোনা এবং মেসিরা সেই শিকড়েরই মহীরুহু। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যাম্পেসের হাত ধরে প্রথমবার শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। এরপর ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মারাদোনা যা করেছেন, তা ফুটবলের ইতিহাসের সোনার হরফে লেখা হয়েছে। সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছেন মেসি। ২ দশক ধরে আর্জেন্টিনার আপামর সমর্থককে তিনি দিয়ে গিয়েছেন অপার আনন্দ। উরুগুয়ের কিংবদন্তি লেখক উদুয়ার্দো গালিয়ানো মেসিকে নিয়ে লিখেছিলেন, "মেসি যতটা আনন্দ নিয়ে খেলে তা আর কেউ পারেনা। সে একেবারে শিশুর মতো আনন্দ নিয়ে খেলে। খেলার আনন্দের জন্য সে খেলে, জেতার দায়িত্ব নিয়ে নয়।"
কিন্তু একটা সময় এসে, শুধু আনন্দের জন্য খেলাটা আর যথেষ্ট হয়নি। জেতা শুধু দায়িত্ব নয়, প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল অস্তিত্বের। তাই ফুটবলের এই খুদে জাদুকর বেছে নিয়েছিলেন ২০১৪ বিশ্বকাপকে। মারাকানায় রূপকথা রচনা করার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু ফিরেছেন অনেক কাছ থেকে। গোল্ডেন বল জিতেও মেসির মুখ বলে দিচ্ছিল বিশ্বকাপ জেতাটা মেসির জন্য কতটা আরাধ্য। এবার সেই স্বপ্নের জয়ের পথের আবারও অনেক কাছে মেসি। ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে আবারও বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছেছে আর্জেন্টিনা। তর্কাতীতভাবে সর্বকালের সেরা স্বীকৃতি থেকে সম্ভবত আর এক ধাপ দূরে রয়েছেন লিওনেল মেসি নিজেও।
গতকাল ম্যাচের শুরু থেকেই ছন্দে ছিল ক্রোয়েশিয়া। প্রথমার্ধের প্রায় পুরোটাই খেলা নিয়ন্ত্রণ করেছিল তারা। বড় ধরনের গোলের সুযোগ তৈরি করতে না পারলেও মাঝ মাঠে নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে। ম্যাচের ২৬ মিনিটে প্রথমবার সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। ডি বক্সের বাইরে থেকে এনজিও ফার্নান্দেজের দূরপাল্লার শট রুখে দেন লিভাকোভিচ। তবে ম্যাচে ৩২ মিনিটে ফার্নান্দেজের এক পাস থেকে ডি বক্সের ভেতরে বল পান আলভারেজ। আলভারেজকে ফাউল করেন ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক নিজেই। পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। স্পট কিক থেকে আর্জেন্টিনাকে লিড এনে দেন মেসি। এবারের বিশ্বকাপে নিজের পঞ্চম আর সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে নিজের ১১ তম গোল করলেন এই খুদে জাদুকর।
আরও পড়ুন- জিতল আর্জেন্টিনা, জাগল ভারত বাংলাদেশ, এই না হলে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল!
মেসির গোল উদযাপন করে শেষ করার আগেই আর্জেন্টাইন ভক্তদের আবারও আনন্দে ভাসান জুলিয়ান আলভারেজ। মেসির পাস থেকে বল পেয়ে মাঝমাঠ থেকে দুরন্ত গতিতে বল নিয়ে তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে অসাধারণ ফিনিশিং করে লিড দ্বিগুণ করেন আলভারেজ। সেই সময় ২-০ গোলে এগিয়ে রয়েছে আর্জেন্টিনা। বিরতির পর আবারও ছন্দময় মেসিরা। ৬৯ মিনিটে আবারও সেই মেসির নৈপুণ্য। কোয়াটার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এক অতিমানবীয় অ্যাসিস্টের পর এবার সেমিফাইনালেও হাজির সেই মেসি। চোখ ধাঁধানো একটি পাস দিয়ে গোল করতে কোনও সমস্যাই হয়নি জুলিয়ান আলভারেজের। ম্যানচেস্টার সিটির এই তারকা তখন নিজের স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলেছেন। বিশ্বকাপে নিজের চতুর্থ গোল করে সবার নজর কাড়লেন আলভারেজ। এরপরেও ম্যাচে ফেরার চেষ্টা করে ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু আর্জেন্টিনার রক্ষণের কাছে প্রতিহত সমস্ত আক্রমণ। ৩-০ গোলে বড় জয় নিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় আলবিসেলেস্তেরা।
নিজের খেলোয়াড় জীবনে সবকিছু জিতেছেন মেসি। তবে আন্তর্জাতিক শিরোপা ছিল তাঁর স্বপ্ন। আন্তর্জাতিক শিরোপা নেই, তুমি আর অমর নও- বহু বছর এই কথা শুনতে হয়েছে মেসিকে। একটা সময় যেন পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন ফুটবলের এই জাদুকর। কোপা আমেরিকা জিতে এক বছর আগে সেই আক্ষেপে কিছুটা প্রলেপ দিয়েছিলেন। তবে, নিন্দুকেরা কি তাতে থামে! সকলে বলল, তুমি তো জাদুকর, এবার বিশ্বকাপ জিতে দেখাও দেখি!
যে ছেলেটি একদিন জানলা ভেঙে বাইসাইকেল জেতার জন্য মাঠে নেমেছিল, সোনার ট্রফিটি জিততে তিনি নিজেকে শেষ করে দিতেও পারেন। নিজেকে বারবার প্রমাণ করে, বারবার ঘুরে দাঁড়িয়ে মেসি এখন স্বপ্নের ফাইনালে। নিজের শেষ বিশ্বকাপের ফাইনালে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের অপেক্ষা করছেন লিওনেল মেসি। আর আপামর আর্জেন্টিনা সমর্থকদের অপেক্ষা কেবল শেষ নাচটির। যে নাচে কোমর দোলাবেন কোটি কোটি আর্জেন্টিনা সমর্থক। ফুটবলের মহাতারকা হয়ে উঠবেন অমর। আর তাদের সঙ্গেই সেলিব্রেশনে যোগ দেবেন অন্যলোকে বসে থাকা 'কিং মারাদোনা'ও।